ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মনের জোরে বেঁচে আছে মুক্তামণি

আহমদ নূর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:০৭, ১২ জুলাই ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মনের জোরে বেঁচে আছে মুক্তামণি

আহমদ নূর : দুই চোখের নিচে কালি পড়েছে। চুল এলোমেলো। শরীরটা অনেক শুকনো এবং রক্তশূন্য। তবু হাসপাতালের কেবিনে যে-ই তাকে দেখতে যাচ্ছেন, তার সঙ্গেই অকপটে কথা বলছে মেয়েটি; যেন শৈশবের চাঞ্চল্য তার প্রতিটি কথায় উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু সেটি বেশিক্ষণ স্থায়ী হতে পারে না। অজানা এক রোগ, যার কিছুই জানেন না চিকিৎসকেরা, যেটি কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে মেয়েটিকে। তার বাবা মনে করেন, এত জটিল রোগ সয়ে শুধু মনের জোরে বেঁচে আছে মুক্তামণি।

শরীরের চেয়ে ভারি হাত। নড়াচাড়া করতে বাবা-মায়ের সাহায্য নিতে হয় মেয়েটিকে। হাতে অনেক যন্ত্রণা। এত ধকল সয়ে কীভাবে সে বেঁচে আছে সেটি এখন অনেকের কাছে বিস্ময়। সবাই বলছেন, মেয়েটির অনেক ধৈর্য আছে, অনেক সহনশীল। যন্ত্রণা সঙ্গে নিয়ে বেঁচে থাকার সক্ষমতা আছে তার।

মুক্তামণি (১২) সাতক্ষীরা সদর উপজেলার দক্ষিণ কামারপাড়ার এক মুদি দোকানির মেয়ে। মুক্তামণি ও তার যমজ বোন হীরামণি বাবা ইব্রাহিম হোসেন ও আসমা খাতুনের ঘর আলোকিত করতে পৃথিবীতে এসেছিল ১২ বছর আগে। মেয়ে দুটিকে পেয়ে যে তিনি অনেক খুশি ছিলেন, অসুস্থ মেয়ের প্রতি ইব্রাহিম হোসেনের যত্ন ও আবেগ দেখলেই তা বোঝা যায়। মেয়ের এ অবস্থার কারণ বর্ণনা করতে করতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে বার্ন ইউনিটের একটি কেবিনে অঝোরে কাঁদছিলেন তিনি।

গতকাল মঙ্গলবার ভোরে মুক্তামণিকে উন্নত চিকিৎসা দিতে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন ইব্রাহিম হোসেন। হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন সকাল ১০টায়।

মুক্তামণির বিরল রোগের খবর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার চিকিৎসার ব্যয় বহনের ঘোষণা দিয়েছেন।

মুক্তামণির এ অবস্থা হলো কীভাবে? এ বিষয়ে তার চাচা আহসান হাবিব রাইজিংবিডিকে জানান, ‍মুক্তামণির বয়স যখন ২ বছর, তখন তার ডান হাতের কনুইয়ের ওপর একটি ফোঁড়া হয়। পরে বুকে ও বগলে ফোঁড়ার মতো হয়। তখন তা এখনকার মতো ভয়াবহ ছিল না। স্থানীয় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক থেকে শুরু করে সাতক্ষীরা-খুলনার বড় চিকিৎসকেরা তার চিকিৎসা করেছেন। তারা এটিকে সামান্য টিউমার মনে করেছিলেন। আড়াই বছর আগে ওই ফোঁড়া বিস্তৃত হলে মুক্তামণি আরো অসুস্থ হয়। পরে ঢাকার পিজি (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়) হাসপাতালের আর্থোপেডিক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কৃষ্ণ প্রিয় রায়ের কাছে নিয়ে আসলে তিনি ৯ মাস টিবি রোগের চিকিৎসা দেন। এরপর থেকে মুক্তামণির হাত আশঙ্কাজনক হারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও ফুলে যায়।

মুক্তামণির এই অবস্থার জন্য তার রোগ শনাক্ত করতে না পারা ও কৃষ্ণ প্রিয় রায়ের ৯ মাসের ভুল চিকিৎসাকে দায়ী করছেন আহসান হাবিব।

 



তিনি বলেন, স্থানীয় চিকিৎসকদের চিকিৎসায় মুক্তামণি সুস্থ হয়ে না ওঠায় তাকে আমরা ঢাকায় নিয়ে আসি। প্রথমে তাকে নিয়ে যাই সিআরপি হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসকেরা তার চিকিৎসায় অপারগতা প্রকাশ করেন এবং পিজি হাসপাতালে নিতে বলেন। পিজিতে আনার পর পঙ্গু হাসপাতালে রেফার করা হয়। পঙ্গু হাসপাতাল থেকে বলা হয় ডা. কৃষ্ণ প্রিয় রায়ের কাছে নিয়ে যেতে। তার কাছে নিয়ে আসলে ৯ মাস টিবি রোগের চিকিৎসা করেন। এতে মুক্তামণির শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হয়।

তিনি বলেন, গত ছয় মাস মুক্তামণির চিকিৎসা বন্ধ ছিল। কারণ, ঢাকায় নিয়ে আসার পর তাকে ভালো করতে পারিনি। এর পর খুলনা বা সাতক্ষীরার ডাক্তাররা যখন শোনেন ঢাকার বড় হাপসাতালে চিকিৎসকেরা তাকে সুস্থ করতে অপারগ হয়েছেন তখন তারা আর চিকিৎসা করতে চাননি। শেষে খুলনার আদদ্বীন হাসপাতালে নিয়ে গেলে তারা বলেন, আল্লাহ আল্লাহ করতে। আর মেয়েকে ভালো-মন্দ যা কিছু আছে তা খাওয়াতে। কারণ সে বেশি দিন বাঁচবে না।

মুক্তামণির বাবা ইব্রাহিম হোসেন বলেন, মেয়েটি আমার কলিজার টুকরা। তার চিকিৎসার জন্য কি না করেছি। সাতক্ষীরা, যশোর, খুলনার সব বড় বড় ডাক্তার দেখিয়েছি। কেউ আসল রোগ ধরতে পারেননি। এ জন্য মেয়েটা আমার দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, ওর সাথে কথা বললে কেউ বুঝতে পারবে না যে শরীরের ভেতর নাম না জানা ভয়ঙ্কর এক রোগের সঙ্গে সে বসবাস করছে। সে এতো অসুস্থ, তার পরও একা বাথরুমে যাওয়ার চেষ্টা করে। সাবলীলভাবে সবার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে।

মুক্তামণি স্কুল ছেড়েছে আড়াই বছর আগে। তখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ত। আজানা রোগের সঙ্গে লড়াই করে স্কুলে যাওয়া হয়নি তার।

এখন সুস্থ হতে চায় মুক্তামণি। স্বাভাবিকভাবে চলতে চায়। খেলতে চায় সহপাঠীদের সঙ্গে। এজন্য সবার দোয়া চেয়েছে মুক্তামণি ও তার বাবা ইব্রাহিম হোসেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ জুলাই ২০১৭/নূর/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়