ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘দেশ স্বাধীনের পর নজরুলের গানে ছুরি চালানো হয়েছে’

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:০০, ২৭ আগস্ট ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘দেশ স্বাধীনের পর নজরুলের গানে ছুরি চালানো হয়েছে’

তাঁর পরিচয় তিনি নজরুলসঙ্গীত শিল্পী। কিন্তু তাঁর আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাতনী। সে সুবাদে খিলখিল কাজী তার দাদুকে কাছ থেকে দেখেছেন, জেনেছেন। বর্তমানে তিনি নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি নজরুলের জীবন ও কর্ম নিয়ে গবেষণা করছেন।

১৯৭৯ সালে খিলখিল কাজীর বাবা কাজী সব্যসাচী মারা যাবার পর ১৯৮৫ সালে তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন এবং এখানেই বসবাস করছেন। আজ ১২ ভাদ্র বিদ্রোহী কবির মৃত্যুবার্ষিকী। দিনটিকে স্মরণ করে আমরা খিলখিল কাজীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম এ সময়ে দেশে নজরুল চর্চা, এ বিষয়ে অগ্রগতি, নজরুলের বিদ্রোহী চেতনা ইত্যাদি প্রসঙ্গে। তাঁর সঙ্গে কথোপকথনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহাত সাইফুল।

 

রাহাত সাইফুল : বাংলাদেশে নজরুলসংগীত চর্চার বর্তমান অবস্থা কী?

খিলখিল কাজী : নজরুলের গানের চর্চা ঠিকই হচ্ছে। বাংলাদেশে নজরুলের অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান আছে, একাডেমি আছে। এখান থেকে কতজন শিক্ষা নিয়ে বেরিয়ে আসেন সেটা দেখার বিষয়। দেখুন, এ ধরনের শুধু প্রতিষ্ঠান থাকলেই হবে না। আমাদের দেশে অনেকগুলো টিভি চ্যানেল রয়েছে। এসব চ্যানেল সারা বছর কি নজরুলসংগীত প্রচার করে? করে না। কোনো নাটক প্রচার করে? করে না। এতগুলো নাটক প্রতিনিয়ত প্রচার করা হয়  সেখানে কোথাও দাদুর কোনো ছবি থাকে না, তাঁর গানও থাকে না।  

 

রাহাত সাইফুল : বর্তমানে নজরুলসংগীত কতটা ব্যবহার হচ্ছে?

খিলখিল কাজী : নজরুলের গানে এমন কোনো দিক নেই যা সে স্পর্শ করেনি। মেহনতী মানুষের গান থেকে শুরু করে একেবারে উঁচু তলার মানুষের কথাও সেখানে রয়েছে। এর বাইরে ভালোবাসার, জাগরণের, দেশাত্ববোধক গান তিনি করেছেন। বিট্রিশবিরোধী আন্দোলনে দাদুর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে হাজার হাজার যুবক আন্দোলনে যোগদান করেছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়ও কিন্তু দাদুর গান, কবিতা রেডিওতে শোনানো হয়েছে। মানুষ তখন অনুপ্রাণিত হয়েছে। আমি তখন ছোট ছিলাম। মা রেডিও শুনতেন।

পহেলা বৈশাখ এলেই ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ গানটি গাওয়া হতো। এখন এসব উঠে গেছে। দাদুর ‘চল্‌ চল্‌’ রণসংগীতটি এত বড় একটা উদ্দীপনামূলক গান সেটাও কিন্তু এখন হচ্ছে না। আগে দেখেছি বঙ্গভবনে কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি এলে রণসংগীত বাজানো হতো। সেটা আর এখন বাজানো হচ্ছে না। শুধু বঙ্গভবনে নয়, সারা বাংলাদেশে এখন আর কোথাও এ গানগুলো বাজানো হয় না।

 

রাহাত সাইফুল : নজরুলসংগীত বর্তমানে সঠিকভাবে গাওয়া হচ্ছে কী?

খিলখিল কাজী : প্রেমের কবি, বিদ্রোহী কবি, মানবতার কবি, তারুণ্যের কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি বিরাট একটি জায়গাজুড়ে রয়েছেন।

আমরা যারা তাকে নিয়ে গবেষণা করছি, লেখালেখি করছি, গান গাইছি তারাও ঠিকভাবে করছি না। একমাত্র প্রফেসর রফিকুল ইসলাম দাদুর জন্য কাজ করেছেন। এখনও তিনি কাজ করছেন। এরপর সেভাবে নজরুলকে নিয়ে কাজ করতে আমরা দেখছি না। দাদু তাঁর সংগীতকে বেশি নাড়াচাড়া করতে পছন্দ করতেন না। তিনি এক জায়গায় জগত ঘটককে বলেছিলেন, ‘দেখ জগত, আমার গানগুলো অচিরেই হারিয়ে যাবে।’

কিছু শিল্পী বাংলাদেশে এখন আছেন, আমি তাদের নাম বলতে চাচ্ছি না। তারা নজরুলের গান এত কঠিন করে গাইছেন যে, নতুন প্রজন্ম সাহস করছে না। দাদু সবসময় বলেছেন, ‘সুরটাকে ঠিক রেখে তুমি তোমার মত গাও।’

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর নজরুলের গানের উপরে অনেক ছুরি চালানো হয়েছে। কিছু কিছু শিল্পীরা গানের সুর পবির্বতন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের গানের সুর পরির্বতন করা যায় না।  

 

রাহাত সাইফুল : বললেন, নতুন প্রজন্ম সাহস পাচ্ছে না। অর্থাৎ সবার জন্য কি তাহলে নজরুলসংগীত নয়?

খিলখিল কাজী : নজরুলকে যারা ভালোবেসেছেন শুধু তারাই কেন গাইবেন? সারা দেশের মানুষ তাঁর গান গাইতে পারেন। দাদুর গান সব ধরনের শিল্পীরা গাইতে পারেন। তার গান সবার মুখে শুনতে চাই। দাদুর গানে অনেক বৈচিত্র্ আছে। আমি বাবার কাছে শুনেছি। দাদুর গান গ্রামে-গঞ্জে সব জায়গার মানুষের মুখে মুখে ছিলো। দিনে দিনে তা হারিয়ে গেছে। কঠিনভাবে উপস্থাপনা করার জন্য। দাদুর গানটি খুব সহজ করে ছোটদের মনে ঢুকাতে হবে। ছোটরাই ধীরে ধীরে নজরুলসংগীত শিখবে।

 

রাহাত সাইফুল : শেখার কথা বললেন; নজরুলসংগীত শিক্ষায় কতটা অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করেন?

খিলখিল কাজী : নজরুলসংগীতের সরকারি প্রতিষ্ঠান বলে ওদের কিছু দায়বদ্ধতা থাকে। তারা ছয় মাসে, এক বছরের কোর্স শেষ করছে। সেখান থেকে শিল্পী তারিশ নিয়ে বের হচ্ছে। এতেই শেষ নয়! আমাদের দেশে যারা গুণী শিল্পী রয়েছেন তারা জেলায় জেলায় ঘুরে নবীন শিল্পীদের নিয়ে আসতে পারেন। এটাও কিন্তু তারা করছেন না।

 

রাহাত সাইফুল : মৃত্যুর এত বছর পর নজরুল কি তার সঠিক অবস্থানে আছেন?

খিলখিল কাজী : তার জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। কিন্তু তিনি যা দিয়ে গেছেন, যা বলে গেছেন, সে কাজগুলো আমরা করছি না। তাঁর রচনাগুলো অবশ্যই ইংরেজিতে অনুবাদ করে বিদেশে পৌঁছে দিতে হবে। নজরুলকে নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, তারা কেন এটা করছেন না? তাঁর জীবন ও রচনাবলী আজকে কিন্তু বিদেশীদের কাছে পৌঁছে যেত। আজকে যে জাতিগত হানাহানি চলছে। নজরুলের চেতনা ধারণ করে এই কাজগুলো করলে এমন কখনও হতো না।

 

রাহাত সাইফুল : বিদেশে বর্তমানে নজরুল কতটা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে?

খিলখিল কাজী : এখন বিদেশে নজরুল জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন। নজরুলের জীবন, নজরুলের নানান দিক নিয়ে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা হয়। আমেরিকার দুটো বিশ্ববিদ্যালয়, চীন, জাপানসহ কয়েকটি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে নজরুল পড়ানো হচ্ছে।

 

রাহাত সাইফুল : জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে নজরুলের গান-কবিতা-গদ্য কতটা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করেন?

খিলখিল কাজী : অবশ্যই প্রাসঙ্গিক। নজরুল সবসময় বলেছেন, ‘ধর্মের নামে ভণ্ডামি, জাতিগত লড়াই চলবে না’। তিনি এগুলো বহু কবিতা, বহু গানে দৃঢ়ভাবে উচ্চারণ করেছেন। সকল ধর্মের মানুষকে এক কাতারে নিয়ে আসার জন্য, সর্বোচ্চ মানবতার জন্য তিনি উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। এখন এক ফোনের মাধ্যমে আমরা সব কিছু জেনে যাচ্ছি। অথচ দাদু অনেক বছর আগেই বলে গেছেন, ‘দেখবো এবার জগৎটাকে আপন হাতের মুঠোয় করে’।

 

রাহাত সাইফুল : নজরুলকে নিয়ে আপনি বর্তমানে কী করছেন?

খিলখিল কাজী : আমি নজরুল ইন্সটিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য। নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করছি। এছাড়া  

ছোটদের একটা বই তৈরি করছি। অনেকটাই লেখা হয়ে গেছে। বইটির মাধ্যমে ছোটদের কাছে নজরুলকে পৌঁছে দিতে চাই।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৭ আগস্ট ২০১৬/রাহাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়