ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

দুর্লভ সংগ্রহশালা ‘ঢাকা কেন্দ্র’

আশরাফুল ইসলাম আকাশ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৫, ২১ এপ্রিল ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
দুর্লভ সংগ্রহশালা ‘ঢাকা কেন্দ্র’

আশরাফুল ইসলাম : পুরান ঢাকাকেই মনে করা হয় ঐতিহ্যবাহী স্থান। ইটপাথরের এই পুরান ঢাকায় যান্ত্রিকতার ভিড়ে একখণ্ড সবুজের দেখা মেলে ঢাকা কেন্দ্রে। যা নিজেই এক টুকরো ঐতিহ্য।

এখানে রয়েছে নানা প্রজাতির গাছ। রয়েছে ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে দুর্লভ এক সংগ্রহশালা। পুরান ঢাকার মোহিনী মোহন দাস লেনে মিলবে একটি চৌকোনা বাড়ি। এটিই ঢাকা কেন্দ্র।

১৯৯৭ সালে পুরান ঢাকার স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব প্রয়াত মাওলা বখশ সরদারের ছেলে আজিম বখশ নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন মাওলা বখশ সরদার মেমোরিয়াল ট্রাস্ট। এর পাঁচটি প্রকল্প আছে। একটি হচ্ছে পুরান ঢাকার ইতিহাস ও ঐতিহ্যচর্চা। এরই ফসল হলো ঢাকা কেন্দ্র। কেন্দ্রের দোতলায় আছে ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্য সংক্রান্ত সাত হাজার বই সমৃদ্ধ পাঠাগার। এ ছাড়া পুরান ঢাকাবাসীর ব্যবহার্য নানা সামগ্রী, ছবি, ঐতিহাসিক নানা দলিল, মানচিত্র, বুড়িগঙ্গার পারে পত্তন হওয়া সেই আদি নগরের বর্ণিল স্মৃতিচিহ্ন। বসবাসযোগ্যতার নিরিখে আজকের বিশ্বের সবচেয়ে অনুপযোগী শহরটিকে মেলাতে পারেন না দর্শনার্থীরা। বই আর নানা নিদর্শনের সঙ্গে উদ্যানহীন শহরে বৃক্ষশাখার দোলানো বাতাস পাওয়া যায়। দোতলায় অন্তত ১০০ প্রজাতির অর্কিডের বাগান যে কাউকে যান্ত্রিক অসহ্য নগরীর বিষন্নতা থেকে খানিকটা হলেও মুক্তি দিবে। যান্ত্রিক নগরে এ যেন একখণ্ড সবুজ ঢাকা। কিছু মানুষের উদ্যোগ, নিরন্তর শ্রম একটি প্রতিষ্ঠানকে কোন জায়গায় নিয়ে যেতে পারে, তা দেখেও বিস্মিত হন অনেকেই।

 



পাঠাগারের পাশে ছোট জাদুঘরে পুরান ঢাকার বনেদি কয়েকটি পরিবারের ওপর আলাদা করে গ্যালারি আছে। এখানে এসব পরিবারের দুর্লভ সব ছবি, পানের ডিব্বা থেকে শুরু করে রান্নার তৈজস, হুঁকা, শাড়ি-কাপড়, লবণদানি স্থান পেয়েছে। সংগ্রহশালায় রয়েছে ১৮৯৬ সালে তৈরি একটি জমির দলিল। এর ভাষার অভিনবত্ব আগ্রহী গবেষকের খোরাক যোগায়। এ ছাড়া ঢাকায় প্রথম স্থাপিত মোটর সারাই কারখানার নানা যন্ত্রাংশ, প্রাচীন মানচিত্র, পুরনো ভবনের ইট-নকশা রয়েছে। অসংখ্য দুর্লভ সংগ্রহ রয়েছে এই ঢাকা কেন্দ্রে।

প্রায় দুই দশক ধরে পাঠাগারটি অজস্র পাঠক, গবেষকের প্রয়োজন মিটিয়ে চলেছে। এই নগরের কোনো কিছু নিয়ে অনুসন্ধানী কাজ করতে গেলে ঢাকা কেন্দ্র ছাড়া অনেকটা অসম্ভব বলে জানালেন ঢাকা বিষয়ক গবেষক মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য সংক্রান্ত বই পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। অনেকেই এখানে আসেন এসব বইয়ের সন্ধানে। পেয়েও যান কাঙ্খিত বই। এখানে আবদুল করিমের ঢাকাই মসলিন, আবু যোহা নূর আহমদের উনিশ শতকের ঢাকার সমাজজীবন, কেদারনাথ মজুমদারের ঢাকার বিবরণ ও ঢাকা ব্রাহ্ম সমাজের ইতিহাস, নাজির হোসেনের কিংবদন্তীর ঢাকা, নির্মল গুপ্তের ঢাকার কথা, যতীন্দ্রমোহন রায়ের ঢাকার ইতিহাস, রফিকুল ইসলামের ঢাকার কথা, সত্যেন সেনের শহরের ইতিকথা, হরিদাস বসুর ঢাকার কথা। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের লেখা ঢাকার ওপর সবই মিলবে এখানে। ঢাকার নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা নিয়ে প্যাট্রিক গেডেস বই লিখেছিলেন ১৯১৭ সালে, ‘ঢাকা : অ্যা স্টাডি ইন আরবান হিস্ট্রি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’। ইংরেজি ভাষায় লেখা ভারতীয় ও ব্রিটিশ লেখকদের আরও অনেক দূর্লভ বইয়ের বিরাট সংগ্রহশালা এই ঢাকা কেন্দ্র। এই পাঠাগারে যে কেউ যেতে পারেন। বেলা চারটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত খোলা থাকে। তবে যারা গবেষণার কাজে আসেন, তারা অধিক সময় এখানে বসে কাজ করতে পারেন। বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক বন্ধ থাকে।

গবেষণার কাজে পাঠাগারে এসেছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী তোফায়েল আহমেদ। তিনি ঢাকার নৃ-তাত্ত্বিক ইতিহাস নিয়ে কাজ করছেন। তিনি বলেন, এমন শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবেশ কোথাও দেখিনি। সব ধরনের সহায়তা পেয়েছেন তিনি।

 



ঢাকা কেন্দ্রের চেয়ারম্যান আজিম বখশ থাকেন গুলশানে। কিন্তু পারিবারিক স্মৃতিবাহী এ কেন্দ্রের টানে প্রতিনিয়ত ছুটে আসেন। সার্বিক বিষয়ে দেখভাল করেন তিনি। পাঠাগারে আসা অনেকেই তাকে ঢাকার জীবন্ত ইতিহাস নামে অভিহিত করেন। বাংলাদেশের যে প্রান্তে ঢাকাকেন্দ্রিক যা কিছু পান, তা সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন তিনি। সাদাসিধে আজিম বখশ সবাইকে আপন করে নেন। দর্শনার্থীরা তার সঙ্গে আলাপচারিতায় মেতে উঠেন।

আজিম বখশ বলেন, এই কেন্দ্র যদি কারও সামান্য উপকারে আসে, সেটিই আমার সার্থকতা। এতো আয়োজনের পরেও পাঠকের সংখ্যা কম বলে কিছুটা হতাশা প্রকাশ করেন তিনি। তার মতে, ফরাশগঞ্জের যারা স্থানীয় বাসিন্দা, তাদের ছেলেমেয়েদের মধ্যে পাঠাগারমুখী হওয়ার আগ্রহ কম।

তিনি আরো বলেন, ঢাকার সবচেয়ে পুরনো এলাকা ফরাশগঞ্জ। তখনকার দিনে ঢাকার সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ছিল এখানে। লঞ্চঘাট, নাট্যমঞ্চ, গানের দল, পাঠাগার সব মিলিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশ থাকত। সেই দিন তো আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তবু বর্তমান মানুষের কাছে সেই দিনগুলোর বার্তা পৌঁছে দিতে চাই।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ এপ্রিল ২০১৭/আশরাফুল/হাসান/উজ্জল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়