ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

এশিয়ায় গণিত শাস্ত্রে সর্বোচ্চ কৃতিত্ব হাওরের কিশোর বসুর

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:০৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
এশিয়ায় গণিত শাস্ত্রে সর্বোচ্চ কৃতিত্ব হাওরের কিশোর বসুর

হাসান মাহামুদ : এই বাংলায় যুগে যুগে জন্মেছেন অনেক কীর্তিমান, বিশ্ববরেণ্য এবং ইতিহাসের কিংবদন্তি। অনেক বাঙালি-বাংলাদেশি কীর্তিমান মনীষী আছেন যারা বাঙালি-বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের জাতিগত পরিচয় সমৃদ্ধ করে গেছেন। বাংলা তথা বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করে গেছেন সম্মানিত স্থানে।

এই একবিংশ শতাব্দীতে এসে যখন কোনো বাঙালি ভারতের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন, আমরা তখন বাঙালি হিসেবে গর্বিত হই, শিহরিত হই। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ইন্ডিয়া সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন একজন বাঙালি। তিনি শিশির কুমার ঘোষের ইন্ডিয়ান লীগের সাথে জড়িত ছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যে কয়েকজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন তার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। তিনি উপমহাদেশের প্রথম এবং একমাত্র ‘র‌্যাংলার’ স্যার আনন্দমোহন বসু। বাঙালি রেনেসাঁর অন্যতম স্থপতি উপমহাদেশ বিখ্যাত এক সমাজ সংস্কারক। অথচ এই মহান মনীষী বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে জন্ম নেওয়া এবং বেড়ে ওঠা একজন মানুষ।

ভারতের রাজনীতিতে আনন্দমোহন বসুর অনেক অবদান রয়েছে। তিনি সৌরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জির সঙ্গে যৌথভাবে ১৮৭৬ সালে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৪ সাল পর্যন্ত এই সংগঠনের সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এবং পরবর্তী সময়ে আজীবন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের সদস্য এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট মেম্বার ও ফেলো সদস্য ছিলেন। সবকিছুকে ছাপিয়ে তিনি ১৮৯৮ সালে মাদ্রাজে অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সম্মেলনে সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন।

আনন্দমোহন বসুর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব, তিনি এই উপমহাদেশে গণিত শাস্ত্রে সর্বোচ্চ টাইটেল বা উপাধিধারী একমাত্র বাঙালি। গত একশ’ বছরেও এই কৃতিত্ব আর কেউ অর্জন করতে পারেনি।

কৃতিত্বপূর্ণ এই উপাধিকে বলা হয় ‘র‌্যাংলার’। ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত শাস্ত্রের ওপর সর্বোচ্চ জ্ঞান ও অর্জনের জন্য এই উপাধি দেওয়া হয়। এই উপাধি পাওয়া একদিকে যেমন মারাত্মক কঠিন কাজ, তেমনি তখনকার সময়ে কোনো একজন বাঙালির জন্য এই উপাধি স্বপ্নেও কল্পনা করার মতো ছিল না।

অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকে প্রায় দু’শ বছর বাংলার মাটিতে ইংরেজরা তাদের শাসন ব্যবস্থা বলবৎ রাখে। ইতিহাস বলে, ইংরেজরা এই অঞ্চলকে শোষণের পাশাপাশি সবসময়ই দমিয়ে রাখতো এবং তুচ্ছজ্ঞান করতো। সে হিসেবে ইংরেজদের শাসনাধীন এই অঞ্চলের একজন কিশোর গণিত শাস্ত্রে সর্বোচ্চ উপাধি বয়ে আনবে, এটা নিশ্চয়ই সহজ ছিল না! কিন্তু আনন্দমোহন বসুর পাণ্ডিত্য এবং অর্জন এতোটাই উচ্চ পর্যায়ের ছিল যে, বিষয়টি দমিয়ে রাখা যায়নি। সে হিসেবে বলা যায়, আনন্দমোহন বসুর এই অর্জন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে গোটা ভারতবর্ষের বিজয়।

১৮৭৪ সাল। ইংরেজরা রাজার জাত আর গোটা ভারতবর্ষ তাদের দাস- এ ধারণাই ছিল উপমহাদেশে ইংরেজ শাসকদের মাঝে বদ্ধমূল। কিন্তু, সবাইকে অবাক করে দিয়ে খবরটা আসে খোদ ইংল্যান্ড থেকেই। ইংল্যান্ডের ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিষয়ক সর্বোচ্চ পরীক্ষায় তিনটি বিষয়ে প্রথম শ্রেণি অর্থাৎ সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ‘র‌্যাংলার’ উপাধি পেয়েছেন ভারতবর্ষের একজন বাঙালি। তাঁর নাম আনন্দমোহন বসু। গত একশ বছরেও এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় কেউ এই কৃতিত্ব অর্জন করতে পারেনি। আনন্দমোহন বসু এই প্রেক্ষাপটে শতাব্দী জুড়ে আসীন আছেন অনন্য এক উচ্চতায়।

এই মহান মনীষীর আজ ১৭০তম জন্মবার্ষিকী। আনন্দমোহন বসু ১৮৪৭ সালের আজকের দিনে (২৩ সেপ্টেম্বর) বর্তমান কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা উপজেলার জয়সিদ্ধি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তৎকালীন ময়মনসিংহ জজ আদালতের পেশকার পদ্মলোচন বসু ছিলেন তার পিতা। আনন্দমোহন বসুর মায়ের নাম ছিল উমা কিশোরী দেবী। তিনি একজন গৃহীনি ছিলেন।

আনন্দমোহন বসু ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে মেধা তালিকায় নবম স্থান অধিকার করে মেট্রিক পাস করেন। এরপর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ এবং বিএ উভয় পরীক্ষায় মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। তিনি ১৮৭০ সালে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন এবং ১৮৭৮ সালে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য বিলেতে পাড়ি জমান। আনন্দমোহন বসু ছিলেন ক্যামব্রিজে পড়া প্রথম ভারতীয় বাঙালি। তিনি ভারত উপমহাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিত শাস্ত্রে সর্বোচ্চ ‘র‌্যাংলার’ উপাধি লাভ করেন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ব্রাহ্ম সমাজের সমর্থক ছিলেন। বিজ্ঞানী জগদীশ চন্দ্র বসুর বোন স্বর্ণ প্রভা দেবীকে বিয়ে করে পরে তিনি নিজেকে ব্রাহ্ম সমাজের একজন পরিপূর্ণ অনুসারী হিসেবে গড়ে তোলেন। কিন্তু এ নিয়ে ব্রাহ্ম সমাজের তরুণ সদস্যরা ভিন্নমত পোষণ করলে ১৮৭৮ সালে তিনি শিবনাথ শাস্ত্রী, শিবচন্দ্র দেব এবং উমেষ চন্দ্র দত্তকে নিয়ে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ২৭ এপ্রিল ১৯৭৯ সালে ছাত্রসমাজ নামে সাধারণ ব্রাহ্ম সমাজের একটি ছাত্র সংগঠন চালু করেন।

একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে তখনকার সময় তার অনেক সুখ্যাতি ছিল। এর প্রমাণ পাওয়া যায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণে তার অবদান পর্যবেক্ষণ করলে। তিনি কলকাতা সিটি স্কুল ও সিটি কলেজের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ১৮৮৩ সালে ময়মনসিংহে নিজ বসতবাড়িতে কলকাতা সিটি কলেজের একটি শাখা চালু করেন এবং ১৯০১ সালে এই প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় ময়মনসিংহ কলেজিয়েট স্কুল। ১৯৩৬ সালে তার মৃত্যুর পর কলেজ সেকশনটি বন্ধ হয়ে যায়। দুই বছর পর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মি. ব্ল্যাকউড কলেজটি ফের চালুর উদ্যোগ নেন এবং এ সময় কলেজটির নাম পরিবর্তন করে আনন্দমোহন বসুর নামে অর্থাৎ আনন্দমোহন কলেজ নামকরণ করা হয়। তিনি কলকাতা শিক্ষা কমিশনের সদস্য ছিলেন।

ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। অবিভক্ত ভারতের প্রধান রাজনৈতিক দল জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি পদ অলঙ্কৃত করেই থেমে থাকেননি বরং গণমানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে তিনি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সোচ্চার ছিলেন।

১৯০৬ সালের ২০ আগস্ট মাত্র ৫৯ বছর বয়সে পক্ষাঘাত রোগে ভুগে কলকাতায় জগদীশ চন্দ্র বসুর বাড়িতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ক্ষণজন্মা এই বরেণ্য ব্যক্তি মৃত্যুকালে কোনো বংশধর রেখে যাননি। আর তাই বংশ পরম্পরার রাজনৈতিক সংস্কৃতির এই ভারত উপমহাদেশে মৃত্যু-পরবর্তীকালে তাকে যেমন কেউ স্মরণ করে না ভারতে, তেমনি তার মাতৃভূমি এই বাংলাদেশেও। এটি আমাদের জন্য অবশ্যই দুঃখের এবং লজ্জার বিষয়।

আমরা যেমন তাকে স্মরণ করি না, তেমনি তার রেখে যাওয়া পৈতৃক বাড়িটি পর্যন্ত স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সরকারের কিছু অসাধু কর্মচারীর যোগসাজশে এলাকার একজন প্রভাবশালী লোককে লিজ দেওয়া হয়, যা নিয়ে এলাকায় জনমনে প্রশ্ন আছে। অথচ সরকার চাইলে প্রাসাদতুল্য বাড়িটিকে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে নিয়ে সংরক্ষণ করতে পারে, যা কিনা প্রাচীন নির্মাণশৈলির একটি স্থাপত্য নিদর্শন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

যদিও এলাকার সচেতন যুবসমাজ এই কীর্তিমান পুরুষের স্মৃতি সংরক্ষণে এক সময় গড়ে তুলেছিল বসু স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ, তাদের দাবি ছিল এই বাড়িটিতে যেন একটি কলেজ নির্মাণ করা হয়। এই যুবকদের আরো অনেক আগে বসুর স্মৃতিগাথা শুধু বাড়ি নয়, তার জমিদারির ৬শ’ একর ফসলি জমি, বসতবাড়ি, জোড়াপুকুর, খেলার মাঠ, কষ্টিপাথরের মূর্তিসহ যাবতীয় সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল হয়ে গেছে। এমনকি আনন্দমোহন বসুর স্মৃতিঘেরা বসতবাড়িটিও দখলমুক্ত করা যায়নি কখনো। অবহেলা আর অযত্নে বাড়িটি যেন এক ভূতের বাড়িতে পরিণত হয়েছে।

সবকিছু ছাপিয়ে কীর্তিমান এই মনীষী আমাদের কাছে অবহেলিত। বাংলায় প্রবাদ আছে, কীর্তিমানের মৃত্যু নেই। কিন্তু বর্তমান বাস্তবতা যেন ভিন্ন কথাই বলছে।

একজন নিবেদিত প্রাণ শিক্ষানুরাগী, বিচক্ষণ কর্মযোগী ও রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গীয় রেনেসাঁর উত্তরণে তিনি অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন। ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’- এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ভারতীয় উমহাদেশে ছাত্ররাজনীতির গোড়াপত্তনকারী, উনিশ শতকের নারী জাগরণের অগ্রদূত এবং উপমহাদেশের প্রথম ও একমাত্র ‘র‌্যাংলার’ এ মানুষটির শারীরিক মৃত্যু ঘটলেও তিনি অনন্য এক ‘মৃত্যুঞ্জয়ী’।

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭/হাসান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়