ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

সংশয়ের চোরাস্রোত নিয়ে বিশ্বকাপে ফেবারিট ভারত

মানজুর মাহমুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৫১, ২৮ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
সংশয়ের চোরাস্রোত নিয়ে বিশ্বকাপে ফেবারিট ভারত

মানজুর মাহমুদ : অপেক্ষা ব্যাপারটা কঠিন। এটা সবচেয়ে ভালো বোঝে প্রেমিক-প্রেমিকারা। আর ক্রিকেটপ্রেমীরা? তারাও বেশ ভালোই বোঝেন। প্রিয় দলের ম্যাচের জন্য তাদের অপেক্ষা পুরো বছরজুড়ে। আর অপেক্ষা যদি হয় বিশ্বকাপের মতো আসরের, তাহলে তো কথাই নেই। দিন গুনে গুনে অপেক্ষা করতে থাকেন ক্রিকেটপ্রেমীরা। সেই অপেক্ষা প্রায় শেষ। আর একদিন পরই ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে পর্দা উঠতে যাচ্ছে ক্রিকেট বিশ্বকাপের ১২তম আসরের।

বিশ্বকাপের বাজনা বাজলেই বিভিন্ন ধরনের হিসাব-নিকাশ শুরু হয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কোন দল সবচেয়ে ফেবারিট, কারা শিরোপার দাবিদার, কে আন্ডারডগ হয়ে বিশ্বকাপে যাচ্ছে বা কারা হয়ে উঠতে পারে জায়ান্ট কিলার; এসব নিয়ে অনেক আলোচনা, বিশ্লেষণ চলছে ক্রিকেট দুনিয়ায়। আর এই আলোচনায় শিরোপার দাবিদার হিসেবে যেসব দলের নাম নেওয়া হচ্ছে, তাদের মধ্যে ভারত অন্যতম।

এবারের বিশ্বকাপে বিরাট কোহলির দলকে বলা হচ্ছে ‘মোস্ট ফেবারিট।’ উপমহাদেশের এই ক্রিকেট পরাশক্তিও নিজেদেরকে শিরোপার অন্যতম দাবিদার মনে করছে। অভিজ্ঞ ও তারুণ্যের মিশেলে যে দলটি নিয়ে বিশ্বকাপে গেছে ভারত, তাতে এই দলটিকে বিশেষ সমীহ দিতেই হচ্ছে ক্রিকেটের মহাযজ্ঞে অংশ নিতে যাওয়া বাকি দলগুলোকে।

ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিং; তিন বিভাগেই দারুণ শক্তিশালী দলটি দেশকে তৃতীয় শিরোপা এনে দেওয়ার স্বপ্নে বিভোর। কিন্তু যাদেরকে নিয়ে এত আলোচনা, ভাবা হচ্ছে মোস্ট ফেবারিট হিসেবে; সেই ভারত দলেই আছে সংশয়ের চোরাস্রোত। সেটাও কি না তাদের সব সময়ের প্রধান অস্ত্র ব্যাটিং নিয়ে। টপ অর্ডার বা লোয়ার মিডল অর্ডার নিয়ে ভাবনা না থাকলেও ১৯৮৩ ও ২০১১ বিশ্বকাপজয়ী ভারতকে কিছুটা ভাবতে হচ্ছে তাদের মিডল অর্ডার নিয়ে।

টপ অর্ডারের চার ব্যাটসম্যানকে নিয়ে ভারতের বিন্দু পরিমাণ চিন্তা নেই। উদ্বোধনী ব্যাটসম্যান হিসেবে রোহিত শর্মা ও শিখর ধাওয়ানের ওপর সব সময়ই আস্থা আছে তাদের। কোনো কারণে উদ্বোধনী জুটি পরিবর্তন করতে হলে লোকেশ রাহুল ভারতের ইনিংস উদ্বোধন করতে সদা প্রস্তুত, একই সঙ্গে ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান সামর্থ্যবানও। তিন নম্বরে নেমে ব্যাট হাতে শাসন করছেন বিরাট কোহলি; এটা আগে থেকেই অনেকে কল্পনায় এঁকে রাখছেন। অবিশ্বাস্য ধারাবাহিকভাবে ব্যাটিং করা কোহলির ব্যাটে সেই শাসনের দেখা মিললে সেটা হবে খুবই স্বাভাবিক ও বাস্তবসম্মত দৃশ্য।

পরের তিনটি পজিশনের মধ্যে দুটি পজিশন নিয়ে মূলত ভারতকে বারবার পরিকল্পনা সাজাতে হচ্ছে। ভারতের সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির জায়গা নিয়ে সেভাবে চিন্তায় পড়তে হচ্ছে না ভারতকে। যদিও এর আগে ধোনির ভূমিকা নিয়েও কথা উঠেছিল। তারপরও ধোনিতে আস্থা রাখবে ভারত। চার ও অথবা পাঁচ, যে পজিশনেই ধোনি ব্যাটিং করুক না কেন, ভারত চিন্তামুক্ত থাকতে পারবে।



ধোনি যদি চারে ব্যাটিং করেন তাহলে পাঁচ এবং ছয় নম্বর জায়গা নিয়ে কিছুটা অস্বস্তিতে থাকবে ভারত। আর যদি ধোনি পাঁচে ব্যাটিং করেন, তবে চার এবং ছয় নম্বর নিয়ে ভাবতে হবে তাদেরকে। কারণ পাঁচে ব্যাটিং করা বিজয় শঙ্কর ভারতের হয়ে ম্যাচই খেলেছেন মাত্র ৯টি। তাতে আহামরি একটি ইনিংসও নেই। কিছুদিন আগে শেষ হওয়া আইপিএলেও ডানহাতি এই অলরাউন্ডার উজ্জ্বল পারফরম্যান্স করতে পারেননি। এই পজিশনটি নিয়ে ভাবতেই হবে ভারতকে।

ছয় নম্বরে ব্যাটিং করা কেদার যাদব বেশ ছন্দে আছেন, সেটাও বলার উপায় নেই। সর্বশেষ ১০ ইনিংসের মধ্যে মাত্র একটি ইনিংসে বলার মতো ব্যাটিং করতে পেরেছেন ডানহাতি এই অলরাউন্ডার। এ ছাড়া আইপিএলে চরম হতাশার সময় পার করেছেন তিনি। বল হাতে তাকে তো দেখাই যায়নি, ব্যাট হাতে উইকেটে গেছেন আর ফিরেছেন। এ ছাড়া আইপিএলে পাওয়া চোটও কিছুটা ভাবনায় রেখেছে কেদার যাদবকে।

পরের দুটি জায়গা নিয়ে সেভাবে ভাবতে হচ্ছে না ভারতকে। সাত নম্বরে হার্দিক পান্ডিয়া এবং আট নম্বরে রবীন্দ্র জাদেজার ওপর ভরসা রাখতে চায় ভারত। এর বাইরেও কোনো পরিকল্পনা থাকলে দিনেশ কার্তিককে বিবেচনায় নিতে পারে তারা। ডানহাতি অভিজ্ঞ এই ব্যাটসম্যানকে চার থেকে ৭ পর্যন্ত, যেকোনো জায়গায় কাজে লাগাতে পারবে ভারত।

ভারত সব সময়ই ব্যাটিংনির্ভর দল। কিন্তু এবারের বিশ্বকাপে ভারতের প্রধান শক্তি হয়ে উঠতে পারে তাদের বোলিং বিভাগ। আর এই প্রধান শক্তির প্রধান অস্ত্র হতে পারেন ডানহাতি পেসার জাসপ্রিত বুমরাহ। বল হাতে সব সময়ই কান্ডারীর ভূমিকায় দেখা যায় তাকে। যদিও চোট কাটিয়ে মাঠে ফেরা বুমরাহ শেষ আইপিএলে বিশেষ কিছু করতে পারেননি। তবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচ দিয়ে নিজের ফিরে আসার জানান দিয়ে রেখেছেন তিনি। ওই ম্যাচে ৪ ওভারে মাত্র ২ রান খরচায় একটি উইকেট নেন তিনি। ৪ ওভারের ২ ওভারই মেডেন নেন বুমরাহ।

পেস আক্রমণকে আরও ধারালো করার জন্য ভারত দলে আছে ভুবনেশ্বর কুমারের মতো অভিজ্ঞ পেসার। শেষ আইপিএলে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে বেশ ভালো সময়ই কাটিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া ইংল্যান্ডের মতো উইকেটে ভুবনেশ্বর কার্যকরী বোলার হয়ে উঠবেন, এমন আশা করতেই পারে ভারত।



সুযোগ বুঝে মোহাম্মদ শামিকে ব্যবহার করতে পারে তারা। তুরুপের তাস হিসেবে তারা ব্যবহার করতে চাইবে লেগ স্পিনার যুজবেন্দ্র চাহালকে। এর বাইরে চার অলরাউন্ডারের কাছ থেকেও বোলিং সুবিধা পাবে তারা। যার মধ্যে রবীন্দ্র জাদেজা হয়ে উঠতে পারেন প্রতিপক্ষের জন্য হুমকিস্বরুপ। সব মিলিয়ে চিরায়ত ব্যাটিং শক্তির সঙ্গে এবার গোছালো বোলিং আক্রমণ পেয়েছে ভারত। তাই মিডল অর্ডারে চোরাসংশয় থাকলেও সেটা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাচ্ছে না দুইবারের চ্যাম্পিয়নরা। বিরাট কোহলি, মহেন্দ্র সিং ধোনিরা কেবল শিরোপাতেই দৃষ্টি দিয়ে রাখছেন।

বিশ্বকাপে ভারত
বিশ্বকাপে অংশ নেওয়া পুরনো দলগুলোর মধ্যে ভারত অন্যতম। বিশ্বকাপের প্রতিটি আসরেই অংশ নিয়েছে তারা। উপমহাদেশের ক্রিকেট দলগুলোর মধ্যে ভারতই সবচেয়ে সফল। এই অঞ্চলের দলগুলোর মধ্যে সর্বোচ্চ দুটি বিশ্বকাপ জিতেছে তারা। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিশ্ব কাঁপানো দুটি আসরে সুবিধা করতে পারেনি ভারত। প্রথম দুই বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় বিশ্ব ক্রিকেটের এই পরাশক্তি।

দুটি বিশ্বকাপ খেলে শিরোপা জেতার রাস্তাটা ভালোভাবেই চিনে নেয় ভারত। যে কারণে শিরোপার স্বাদ নিতে বেশি সময় অপেক্ষা করতে হয়নি তাদের। তৃতীয় বিশ্বকাপেই বাজিমাত করে ভারত। ১৯৮৩ সালে কপিল দেবের নেতৃত্বে বিশ্ব শাসন করে উপমহাদেশের প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপ ঘরে তোলে তারা।

পরের আসরেও খারাপ সময় যায়নি তাদের। শেষ চার পর্যন্ত উঠে যায় ভারত। এর পরের আসরটা মন্দা গেছে শচীন-গাঙ্গুলিদের দেশের। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তানের বিশ্বজয় করার আসরের প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় ভারত। ১৯৯৬ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ওঠা দলটি ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সুপার সিক্স খেলে বিদায় নেয়।

সর্বশেষ চারটি বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি দাপট দেখিয়েছে ভারত। ২০০৩ বিশ্বকাপে ফাইনাল খেলে তারা। তবে অস্ট্রেলিয়ার দাপটে শিরোপা ছুঁয়ে দেখা হয়নি ভারতের। ২০০৭ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নেওয়া ভারত ২০১১ বিশ্বকাপে রাজত্ব কায়েম করে। মহেন্দ্র সিং ধোনির নেতৃত্বে দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপ জেতে ভারত। এই আসর দিয়েই বিশ্বকাপ জেতার অপেক্ষা ফুরায় মাস্টার ব্লাস্টার শচীন টেন্ডুলকারের। সর্বশেষ বিশ্বকাপে সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নেয় উপমহাদেশের এই ক্রিকেট পরাশক্তি।



ইংল্যান্ডের মাটিতে ভারত

ইংল্যান্ডের মাটিতে ওয়ানডেতে ভালো করা দলগুলোর মধ্যে ভারত অন্যতম। ইংলিশদের মাটিতে ১১টি দলের বিপক্ষে ৭৪টি ওয়ানডে খেলেছে ভারত। এর মধ্যে তিনটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়েছে। বাকি ৭১ ম্যাচের মধ্যে ৩৬টিতেই জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে তারা। অর্থাৎ, ইংল্যান্ডের মাটিতে অর্ধেকেরও বেশি ম্যাচ জিতেছে ভারত। ৩৪টিতে হেরেছে এবং একটি ম্যাচ টাই হয়েছে।

ইংল্যান্ডে স্বাগতিকদের বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি ৪১টি ওয়ানডে খেলেছে ভারত। ইংলিশদের বিপক্ষে তাদের জয়ের গড় খুব একটা ভালো নয়। ১৬টি ম্যাচ জিতলেও হারতে হয়েছে ২১টিতে। একটি টাই ও তিনটি ম্যাচ পরিত্যক্ত হয়। ইংল্যান্ডের মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সবেচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে তারা। সাত ম্যাচের পাঁচটিতেই জয় পেয়েছে ভারত। ক্রিকেটের জনক দেশে একটি দলের বিপক্ষে এখনও জয়হীন তারা। নিউজিল্যান্ডে বিপক্ষে তিনটি ম্যাচের তিনটিতেই হেরেছে ভারত।

২০১৫ বিশ্বকাপের পর ওয়ানডেতে ভারত
২০১৫ বিশ্বকাপের পর উল্লেখসংখ্যক ম্যাচ খেলেছে ভারত। চার বছরে ৮৬টি ওয়ানডে খেলেছে এবারের বিশ্বকাপের শিরোপার অন্যতম দাবিদার দলটি। এর মধ্যে দুটি ম্যাচ টাই ও একটি পরিত্যক্ত হয়েছে। বাকি ৮৩টি ওয়ানডের মধ্যে ৫৬টিতেই জিতেছে ভারত। হার মানতে হয়েছে ২৭ ম্যাচে। এ সময়টায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সবচেয়ে বেশি ১৮টি ওয়ানডে খেলেছে তারা। জয় এসেছে ৯টিতে এবং হার ৯টিতে।

ইংল্যান্ডের মাটিতে যে দলের বিপক্ষে এখনও জয়হীন ভারত, গত চার বছরে সেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সবেচেয়ে বেশি ওয়ানডে জিতেছে বিরাট কোহলির দল। ১৩ ম্যাচের ৯টিতেই জয় তুলে নিয়েছে তারা। গত চার বছরে ওয়ানডেতে ভারতের জয়ের গড় দারুণ হলেও শেষের দিকে অবশ্য সেটা থাকেনি। শেষ ১০ ম্যাচের ৬টিতে জিতলেও কোহলিবাহিনী হার মেনেছে ৪টি ম্যাচে। সর্বশেষ ৩ ম্যাচের তিনটিতেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে হেরেছে ভারত, সেটাও আবার ঘরের মাঠেই।

ভারতের বিশ্বকাপ স্কোয়াড: বিরাট কোহলি (অধিনায়ক), রোহিত শর্মা (সহ-অধিনায়ক) শিখর ধাওয়ান, লোকেশ রাহুল, বিজয় শঙ্কর, মহেন্দ্র সিং ধোনি, কেদার যাদব, দিনেশ কার্তিক, যুজবেন্দ্র চাহাল, কুলদীপ যাদব, ভুবনেশ্বর কুমার, জাতপ্রিত বুমরাহ, হার্দিক পান্ডিয়া, রবীন্দ্র জাদেজা ও মোহাম্মদ শামি।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মে ২০১৯/মানজুর/পরাগ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়