ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘শহরে গিয়ে কেউ ভালো থাকতে পারে না’

আমিনুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১২, ২৮ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘শহরে গিয়ে কেউ ভালো থাকতে পারে না’

লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের পাশের চা বাগানের শ্রমিক বাসু

আমিনুল ইসলাম : তার নাম বাসু। এর আগে-পরে কিছু নেই। নিজের জন্ম তারিখ কিংবা সাল দূরের কথা এখন পর্যন্ত বয়স কত হয়েছে জানেন না। নেই উল্লেখ করার মতো কোনো স্বপ্ন। কাজ করেন চা বাগানে। এই চা বাগানই তার কাছে স্বর্গ। কিন্তু তারপরও বাসু যে বৃত্তের মধ্যে আটকা পড়েছেন সেই জীবনবৃত্ত ভাঙার সাহস তার নেই। সাহস থাকবেই বা কী করে? বাইরের জগৎ সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। চা বাগানের বাইরেও যে একটা জগৎ থাকতে পারে সেটা তারা জানেন না কিংবা তাদের জানতে দেওয়া হয় না। বৃত্তবন্দি তাদের জীবন। ছোট্ট টিলার মতো তাদের জগৎটাও ছোট। যেখানে তারা চা গাছ আঁকড়ে ধরে আর চায়ের পাতায় স্বপ্ন বুনে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেন।

নাগরিক সুবিধা তারা পান না বললেই চলে। নিয়মানুযায়ী যেমন আবাসন পাওয়া দরকার সেটাও হয়তো তারা পান না। লেবার লাইনের স্যাঁতস্যাঁতে ঘর। সেখানেই গরু-ছাগল নিয়ে তাদের বাস। অনাহারে থাকলেও চা বাগানই তাদের কাছে স্বর্গ। এই স্বর্গ ছেড়ে বাইরে কোথাও তারা যেতে চান না। যে চা বাগানের ধূলো মেখে বড় হয়েছেন, চায়ের গাছের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়ে উঠেছেন, সেটা তো তাদের কাছে আপনের চেয়েও আপন। চা বাগানের ছায়াবৃক্ষের মতো তারা কিছু পেলেও এখানে আছেন, না পেলেও এখানে আছেন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে ভ্রমণে গিয়ে চা শ্রমিক বাসুর সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা হয় রাইজিংবিডি ডটকমের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক আমিনুল ইসলামের। সেই কথোপকথনের চুম্বক অংশ পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো :

প্রশ্ন : নাম কী আপনার?
বাসু :
বাসু।

প্রশ্ন : শুধু বাসু? আগে-পরে কিছু নেই?
বাসু :
না। শুধু বাসু।

প্রশ্ন : কবে থেকে এই চা বাগানে কাজ করছেন?
বাসু :
আমরা তিন পুরুষ এখানে আছি। আমার দাদা এখানে কাজ করেছেন। আমার বাবা-মা কাজ করেছেন। আমার জন্ম এই চা বাগানে। আমি আমার ছোটবেলা থেকে কাজ করছি। আমার সঙ্গে এখন আমার স্ত্রীও চা বাগানে কাজ করছে। হয়তো ভবিষ্যতে আমার সন্তানও চা শ্রমিক হিসেবে কাজ করবে।

প্রশ্ন : কেমন মজুরি পান?
বাসু :
দৈনিক আমরা ৮৫ টাকা মজুরি পাই। পাশাপাশি দৈনিক আধা কেজি করে আটা পাই। সপ্তাহ শেষে সাড়ে তিন কেজি আটা পাই। প্রতি কেজি আটার দাম নেওয়া হয় ১.২৫ টাকা।

প্রশ্ন : কাজ করতে হয় কতক্ষণ?
বাসু :
শীতকালে আমাদের কাজ করতে হয় সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত। বর্ষা মৌসুমে সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। শীতকালে কাজ কম থাকে। এসময় পাতা কুড়াতে হয়। চা গাছ ছেটে দিতে হয়। বর্ষকালে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চা পাতা সংগ্রহ করতে হয়। গাছের যত্ন নিতে হয়।

প্রশ্ন : এই মাত্র ৮৫ টাকা দৈনিক মজুরি পান। তা দিয়ে কী ভালোভাবে থাকতে পারছেন?
বাসু :
এই তো বেশ আছি। তাই দিয়েই তো চলে যাচ্ছে জীবন।

প্রশ্ন : চা বাগান ছেড়ে শহরে যান না কেন?
বাসু :
শহর ভালো না। সেখানে গিয়ে কেউ ভালো থাকতে পারে না। আগে এখান থেকে অনেকে শহরে গিয়েছিল। কিন্তু তিন-চার বছর পর ফিরে এসেছে। থাকতে পারেনি।

প্রশ্ন : আপনি কখনো ঢাকা শহরে গিয়েছেন?
বাসু :
না, ঢাকা যাওয়া হয়নি। ঢাকায় তো আমাদের কেউ থাকে না। আর বাপ-দাদার স্মৃতি বিজড়িত জায়গা ছেড়ে কোথাও যাওয়ার ইচ্ছাও নেই।

 



প্রশ্ন : আপনার জন্ম কত সালে, বর্তমানে বয়স কত?
বাসু :
জন্ম কত সালে সঠিক বলতে পারব না। বয়স সঠিক কত তাও বলতে পারব না। খেয়াল করিনি।

প্রশ্ন : আপনার জীবনে কোনো স্বপ্ন আছে?
বাসু :
কী আছে জীবনে? বড় কোনো স্বপ্ন নেই। ভালো থাকতে পারাটাই স্বপ্ন।

প্রশ্ন : এই বাগানে আপনারা কতজন কাজ করেন?
বাসু :
বর্তমানে ৭৩০ জন কাজ করছি। আমরা স্থায়ী শ্রমিক। কুড়ি তোলার মৌসুমে এটা বাড়ে। তখন হাজারের উপরে লোক এই বাগানে কাজ করে। আরো ৩০০ এর মতো অস্থায়ী শ্রমিকও কাজ করে।

প্রশ্ন : এখনে কোন কোন ধর্মের লোক কাজ করে?
বাসু :
সব ধর্মেরই আছে। সনাতন ধর্মের আছে। মুসলমান আছে। খ্রিষ্টান আছে। আরো অন্যান্য ধর্মের লোক আছে। আমরা সবাই মিলে-মিশেই কাজ করি। কোনো বিভেদ নেই আমাদের মধ্যে।

প্রশ্ন : আপনি কী কখনো স্বপ্ন দেখেন যে চা বাগানের বাইরে কিছু করবেন? কিংবা আপনার অনাগত সন্তান একদিন চা শ্রমিকের বাইরে কিছু হবে?
বাসু :
তেমন স্বপ্ন তো দেখিই। কিন্তু হবে কিনা জানি না। কারণ, আমরা যা বেতন পাই, তা দিয়ে তো অনেকের ঠিকমতো সংসারই চলে না। বাচ্চাকে পড়াশোনা করাব কীভাবে? টাকার অভাবে আমার বাবাও আমাকে পড়াশোনা করাতে পারেননি। হয়তো আমিও পারব না আমার সন্তানকে পড়াতে।

প্রশ্ন : চা বোর্ড তো আপনাদের সন্তানদের জন্য কাছাকাছি স্কুল তৈরি করেছে। সেখানে তো পড়তে খুব বেশি টাকা লাগে না। তারপরও কেন বাচ্চাদের পড়ান না আপনারা?
বাসু :
স্কুল আছে। কিন্তু যে সামান্য খরচ লাগে সেটাই তো আমরা দিতে পারি না। বই কেনা, খাতা-কলম কেনা, কাপড়-চোপড় কেনার সামর্থ থাকে না। তাছাড়া নানা কারণে বাচ্চাদের আমরা স্কুলে পাঠাতেও পারি না।

প্রশ্ন : সময় দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
বাসু :
জ্বি, ধন্যবাদ।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মার্চ ২০১৭/আমিনুল/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়