ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

জোটের শরিকদের নিয়ে ‘উভয়সংকটে’ বিএনপি

এসকে রেজা পারভেজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০১:৫৯, ৮ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জোটের শরিকদের নিয়ে ‘উভয়সংকটে’ বিএনপি

এস কে রেজা পারভেজ : ভোটের রাজনীতির কথা মাথায় রেখে বিএনপি তার রাজনৈতিক জোট বড় করলেও প্রায়ই জোটের শরিক দলগুলোকে নিয়ে উভয়সংকটে পড়ছে, যা কখনো কখনো বিএনপিকে অস্বস্তিকর পরিস্থিতির মুখে দাড় করাচ্ছে।

চারদলীয় জোটকে সম্প্রসারণ করে ১৮ দলীয় জোট গঠন এবং পরে জোটের পরিধি আরও বড় করে এখন ২০ দলীয় জোট। এই জোটের শরিক ছোট ছোট দলগুলোর নানা ধরনের টালবাহানা এবং নিজেদের কোন্দলের কারণে খণ্ড হয়ে যাওয়া ও শেষ পর্যন্ত জোট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা বিএনপিকে বারবার বিব্রত করছে বলে মানছেন দলটির নেতারা।

১৯৯৯ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি চার দলীয় ঐক্য জোট গঠন করে জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টি (একাংশ) এবং ইসলামী ঐক্যজোটকে নিয়ে। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে থাকা চারদলীয় জোট কলেবরে বেড়ে ১৮ দলীয় জোট হয়।

বিএনপি ছাড়া সে সময় জোটের শরিকরা ছিল জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিশ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), কল্যাণ পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), লেবার পার্টি, ইসলামিক পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাপ, ন্যাপ ভাসানী, মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, পিপলস লীগ ও ডেমোক্রেটিক লীগ। পরে পর্যায়ক্রমে জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) ও সাম্যবাদী দলের একাংশ এই জোটে যোগ দিলে তা ২০ দলীয় জোটে পরিণত হয়।

জোট গঠনের পর থেকেই বিএনপির মিত্র দলগুলোর মধ্যে ঝামেলা যেমন লেগেই আছে, তেমটি জোটের কর্মকাণ্ডের জন‌্য বিএনপিকে শুনতে হচ্ছে কটু কথা। মুক্তিযুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগের কারণে এই দলটিকে জোটের শরিক করা নিয়ে বিএনপিকে বারবার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে এখনো খোঁচা শুনতে হচ্ছে দলটিকে। কিন্তু বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েও বিএনপি ভোটের রাজনীতির কথা বিবেচনা করে জোট ভাঙেনি।

২০ দলীয় জোট গঠনের দুই বছরের মাথায় প্রথম জোট ভাঙার আঘাত লাগে। ২০১৪ সালে তৎকালীণ জোটের উল্লেখযোগ‌্য নেতা প্রয়াত শেখ শওকত হোসেন নিলুর নেতৃত্বধীন এনপিপি জোট ছেড়ে বেরিয়ে যায়। অভ‌্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে এ ঘটনা ঘটে। তবে এনপিপির তৎকালীন মহাসচিব ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ নিজেকে দলের চেয়ারম্যান ঘোষণা দিয়ে ২০ দলীয়  জোটের সঙ্গে থাকার ঘোষণা  দেন। তার সঙ্গে দলটির বড় একটি অংশ রয়ে যায় বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে। ফলে সংখ‌্যার দিক দিয়ে অক্ষুন্ন থাকে ২০ দলীয় জোট।

এরপর এনডিপির সেক্রেটারি আলমগীর মজুমদারের নেতৃত্বধীন একটি অংশ জোট থেকে বের হয়ে যায়। কিন্তু জোটে থেকে যায় এনডিপির চেয়ারম‌্যান গোলাম মুর্ত্তজার নেতৃত্বাধীন অংশ। জোটের আরেক শরিক ন্যাপ ভাসানীর চেয়ারম্যান শেখ আনোয়ারুল হকও একটি অংশ নিয়ে জোট থেকে বেরিয়ে যান। আর দলটির নেতা অ্যাডভোকেট আজহারুল ইসলামকে চেয়ারম্যান করে একটি অংশ থেকে যায় জোটের সঙ্গে।

তবে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট ভাঙার বড় ধাক্কাটি আসে গত বছরের ৭ জানুয়ারিতে, যখন ইসলামী ঐক‌্যজোটের চেয়ারম‌্যান আবদুল লতিফ নেজামী জোট ছেড়ে চলে যান। কিন্তু ইসলামী ঐক্যজোটের সিনিয়র সহ-সভাপতি ও বাংলাদেশ  নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবদুর রকিব নিজেকে ইসলামী ঐক্যজোটের নতুন  চেয়ারম্যান ঘোষণা করে বলেন, ‘আমরা ২০ দলীয়  জোটের সঙ্গেই আছি। আবদুল লতিফ  নেজামী ২০ দল ছেড়েছেন কিন্তু ইসলামী ঐক্যজোট ২০ দলীয় জোটের সঙ্গেই আছে।’

বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের দলগুলোর মধ্যে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সম্প্রতি ভাগ হয়ে গেছে লেবার পার্টি। অভ্যন্তরীণ কোন্দল আর ‘ভাগ-বাটোয়ারা’ নিয়ে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে রোববার (৫ নভেম্বর) নেতারা একে অন্যের বিরুদ্ধে ‘অর্থ আত্মসাতের’ অভিযোগ এনে বহিষ্কার-পাল্টা বহিষ্কার করেছে। দলটির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান তার মহাসচিব হামদুল্লাহ আল মেহেদীকে বহিষ্কার করে নতুন ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব করেছেন দলটির সি‌নিয়র ভাইস চেয়ারম্যান ইঞ্জি‌নিয়ার ‌মো. ফ‌রিদ উদ্দিনকে। এদিকে হামদুল্লাহ আল মেহেদীও পাল্টা বহিাস্কার করেছেন ইরানকে। দলের ভাইস চেয়ারম্যান এমদাদুল হক চৌধুরীকে চেয়ারম্যান মনোনীত করেছে তার অংশ। দলটির দুটি পক্ষ এখন আলাদাভাবে কর্মসূচি দিয়ে নিজেদের মূল ধারার বলে দাবি করছে এবং ২০ দলীয় জোটের অনুগত বলে জোটে আছে জানাচ্ছে।

এই পরিস্থিতিতে এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন অংশ থাকছে ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে ? যদিও এই বিষয়ে দুটি দলই বলছে, তারা জোটের সঙ্গেই আছে। তাহলে কি ২০ দলীয় জোটের পরিধি আরো বেড়ে ২১ দলীয় জোট হবে? কারণ এর আগে বিএনপি জোটের শরিক দলগুলোর মধ্যে ভাঙাগড়ার খেলায় এক অংশ জোট ভেঙে বেরিয়ে গেলেও একটি অংশ থেকে গেছে। কিন্তু লেবার পার্টির দুটি অংশই থাকতে চাইছে বিএনপি জোটে।

এদিকে একটি সমাধানে পৌঁছাতে লেবার পার্টির দুই পক্ষের সঙ্গেই বিএনপির দায়িত্বশীল একজন কথা বলছেন বলে জোটের একটি সূত্র রাইজিংবিডিকে জানিয়েছে। বিষয়টি কথাবার্তার পর্যায়ে রয়েছে। চুড়ান্ত হলে সেটি গণমাধ‌্যমের সামনে উপস্থাপন করা হবে বলে জানায় সূত্রটি।

জানতে চাইলে মঙ্গলবার সন্ধ‌্যায় এই বিষয়ে মোস্তাফিজুর রহমান ইরান রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘লেবার পার্টির কোনো অংশ নাই। লেবার পার্টি চেয়ারম‌্যান হিসেবে আমি ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবসের কর্মসূচি পালন করেছি। দলের নেতারাও সেখানে ছিলেন। আর ১৮ দলীয় জোট গঠন করার সময়ে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে আমিই স্বাক্ষর করেছি। সুতরাং কে কি বললো এটা নিয়ে আমি ভাবি না। ১৭ বছর লেবার পার্টিতে আছি, কেউ এসে বললেই লেবার পার্টি করে জোটের অংশ দাবি করতে পারবে না।’

এদিকে হামদুল্লাহ আল মেহেদী রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘আমরা বিএনপির মহাসচিবের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরাই জোটে আছি। ফাইনাল হলে সবই জানতে পারবেন।’

জোটের শরিক দলের এই ভাঙাগড়ার খেলায় জোটের ভাবমুর্তি নষ্ট হচ্ছে বলে মনে করছেন বিএনপির নেতারা। তারা বলছেন, জোট ভেঙে বেরিয়ে যাওয়া রোধ করতে এবং জোট অক্ষুন্ন রাখা নিয়ে উভয়সংকটে পড়তে হয় বিএনপিকে।

বিএনপির নেতাদের পর্যবেক্ষন হচ্ছে যে, সংখ‌্যার দিক থেকে জোটের পরিধি বড় হলেও শরিক অনেক দল ভোটের রাজনীতিতে খুব একটা কার্যকর ভুমিকা রাখতে পারবে না। ভোটের রাজনীতিতে কয়েকটি দল ছাড়া বাকিগুলোর তেমন ভুমিকা থাকবে না। কিন্তু নির্বাচনে ঠিকই শরিকদের কিছু আসন ছেড়ে দিতে হবে। এর বিনিময়ে বিএনপি কতটা লাভবান হবে সেটি কিন্তু কখনো হিসেবে আসেনি। উল্টো জোটের শরিক দলগুলোকে নিয়ে প্রায়ই বিএনপিকে অস্বস্তিকর অবস্থার মধ‌্যে পড়তে হচ্ছে। জামায়াতকে নিয়ে তো এক ধরনের অস্তস্তি আছেই। আবার কিছুদিন পর পর জোটের অন‌্য দলগুলোর নিজেদের মধ্যে ভাঙন ও জোট থেকে তাদের একাংশের বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনা বেশ বিব্রত করে বিএনপিকে।

লেবার পার্টির ভেঙে যাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বিএনপির নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের একজন রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘দলটি যে দুদিন আগে ভেঙেছে তা আপনার মাধ‌্যমেই জানলাম। মুলত, এসব দল বিএনপির আন্দোলনের জোট। সত‌্যিকার অর্থেই জোটের হাতে গোনা কয়েকটি দল ছাড়া বাকি দলগুলোর ভোটের রাজনীতিতে কিছুই করার নেই। কারণ, তাদের ভোট নেই। সংখ‌্যার বিচারে জোটের পরিধি বাড়াতেই বিএনপি জোটের এই রূপ এসেছে।’

তিনি বলেন, ‘জোটের মিত্র দলগুলোর উচিত তাদের মধ‌্যে ঐক‌্য অটুট রাখা। কিন্তু সেটি না করতে পেরে তারা যখন ব‌্যর্থ হয় তখন জোটের মূল দল হিসেবে বিএনপিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। অনেক ক্ষেত্রে হাস‌্য রসেরও সৃষ্টি হয়।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/৮ নভেম্বর ২০১৭/রেজা/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়