ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

যা ঘটলো আতিয়া মহলে

রফিকুল ইসলাম কামাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:৫৮, ২৮ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
যা ঘটলো আতিয়া মহলে

রফিকুল ইসলাম কামাল, সিলেট : আতিয়া মহল। সিলেট মহানগরীর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়ায় পাশাপাশি চার তলা ও পাঁচ তলা দুটি ভবনের সমন্বয়ে এই বাড়ি। প্রাক্তন সরকারি কর্মকর্তা উস্তার আলীর মালিকানাধীন আতিয়া মহল নামের ভবন এখন সর্বত্র আলোচিত। জঙ্গি আস্তানার কারণে এ ভবন সারা দেশে নজর কেড়েছে। সেনা কমান্ডো অভিযানে আতিয়া মহলে আস্তানায় থাকা চার জঙ্গি নিহত হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ঘেরাওয়ের মধ্যে থাকা আতিয়া মহলে সেনা কমান্ডোরা অভিযানে রয়েছেন। পুলিশ সূত্র জানায়, ভেতরে জীবিত কোন জঙ্গি নেই। বর্তমানে ভবনকে বিস্ফোরকমুক্ত করার কাজ চলছে।

অতি সম্প্রতি চট্টগ্রামের সীতাকু-ে ধরা পড়ে দুই জঙ্গি। তাদের কাছ থেকে সিলেটে জঙ্গি আস্তানার বিষয়টি জানতে পারে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট (সিটিটিসি)। তবে জঙ্গি আস্তানা ঠিক কোথায়, তা নিশ্চিত হতে পারেনি সিটিটিস। আস্তানার সন্ধানে শুরু হয় গোয়েন্দা তৎপরতা। সিটিটিসির ডিসি মনিরুল ইসলাম গত শুক্রবার এই তথ্য জানিয়েছেন।

গোয়েন্দা তৎপরতার এক পর্যায়ে দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ি পাঠানপাড়ায় আতিয়া মহলে পাঁচ তলা ভবনের নিচতলায় একটি ফ্ল্যাটে জঙ্গিদের আস্তানা থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হন গোয়েন্দারা। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে জঙ্গি আস্তানার বিষয়টি চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হওয়ার পর রাত ৩টার দিকে ওই ভবন ঘেরাও করে ফেলে পুলিশ। ফ্ল্যাটের ফটকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় তালা। শুরু হয় বাংলাদেশে এ যাবৎকালে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা শ্বাসরুদ্ধকর জঙ্গিবিরোধী অভিযান।

শুক্রবার আতিয়া মহলের বাইরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি টের পায় নিচ তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকা জঙ্গিরা। সকাল ৭টার দিকে বিস্ফোরণ ঘটায় তারা। সকালে পুলিশের সাথে যোগ দেয় র‌্যাব, ডিবি, এসবি, পিবিআইয়ের সদস্যরা। নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা শুরুতেই আতিয়া মহলের চার তলা ভবনের ১২টি ফ্ল্যাটের সকল বাসিন্দাকে নিরাপদে সরিয়ে নেন। তবে পাঁচ তলা ভবনটির নিচ তলায় জঙ্গি আস্তানা হওয়ায় সে ভবনের বাকি ২৯টি ফ্ল্যাটে থাকা বাসিন্দাদের সরিয়ে আনার ঝুঁকি তারা নেননি।

শুক্রবার দুপুরে আত্মসমর্পণ করতে জঙ্গিদের প্রতি একাধিকবার হ্যান্ড মাইকে আহবান জানায় পুলিশ। তবে সে আহবানে সাড়া দেয়নি জঙ্গিরা। বেলা ১টার পর জঙ্গিদের ফ্ল্যাট থেকে নারী ও পুরুষ কণ্ঠে উচ্চস্বরে বলা হয়, ‘তোমরা (পুলিশ) শয়তানের পথে আছো, আমরা আল্লাহর পথে। দেরি কেন, দ্রুত সোয়াত পাঠাও। আমাদের সময় কম।’

শুক্রবার বিকেলে ঘটনাস্থলে আসে পুলিশের সোয়াত টিম। তারা আতিয়া মহল ঘিরে ফেলে। পুলিশ ও বাড়ির মালিককে সাথে নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন সোয়াত টিমের সদস্যরা। সেদিন রাত ৮টার দিকে সেনাবাহিনীর প্যারা-কমান্ডো ইউনিটের একটি দল ঘটনাস্থলে আসে। তবে রাতেই তারা ফিরে যায়। ওই সময় সিলেট মহানগর পুলিশ কমিশনার গোলাম কিবরিয়া জানান, পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে এসেছে প্যারা-কমান্ডো ইউনিট।

শুক্রবার দিবাগত রাতে চূড়ান্ত অভিযান হতে পারে, এমনটা মনে করা হয়েছিল। তবে চরম উৎকণ্ঠায় সে রাত পেরিয়ে যায়। শনিবার সকাল ৮টার দিকে শতাধিক সেনা প্যারা-কমান্ডো আসেন শিববাড়িতে। সোয়া ৯টার দিকে ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল আনোয়ারুল মোমেনের নেতৃতে শুরু হয় কমান্ডোদের অভিযান। তাদের প্রথম লক্ষ্য ছিল ২৯টি ফ্ল্যাটে আটকা পড়া নিরীহ লোকদের উদ্ধার করা। সে পরিকল্পনায় শত ভাগ সফল হন তারা। কোনো ধরনের হতাহতের ঘটনা ছাড়াই আতিয়া মহলের পাঁচ তলা ভবনে আটকা পড়া ২৯টি ফ্ল্যাটের ৭৮ জন বাসিন্দাকে উদ্ধার করেন তারা। তাদের মধ্যে ৩০ জন পুরুষ, ২৭ জন মহিলা ও ২১ জন শিশু।

শনিবার বেলা ২টার দিকে জঙ্গিদের ফ্ল্যাট ঘিরে শুরু হয় প্যারা-কমান্ডোদের অভিযান। আতিয়া মহলের আশপাশ থেকে সাংবাদিক, উৎসুক জনতাসহ সবাইকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর শুরু হয় গোলাগুলি। দফায় দফায় গুলি ও বিস্ফোরণের প্রচ- শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো শিববাড়ি। সেদিন বেলা সোয়া ২টা, ২টা ৩১ মিনিট, বিকাল ৪টা ৫৬, ৫৭ ও ৫৮ মিনিটে শক্তিশালী বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।

শনিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে অভিযানের বিষয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন সেনা সদর দপ্তরের গোয়েন্দা পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান। তাঁর ব্রিফিং শেষ হওয়ার কয়েক মিনিটের মধ্যেই আতিয়া মহলের প্রায় আড়াইশ’ গজ দূরে প্রচ- শব্দে দুই দফা বোমা বিস্ফোরণ হয়। এ বোমা বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই নিহত হন চার জন। পরে হাসপাতালে মারা যান আরো দুজন। নিহতদের মধ্যে  পুলিশের দুই কর্মকর্তা রয়েছেন। এছাড়া র‌্যাব সদর দপ্তরের ইনটেলিজেন্স উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্ণেল আবুল কালাম আজাদ, উপপরিচালক মেজর আজাদসহ অন্তত ৪০ জন আহত হন।

দুই দফায় এ বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় পরিস্থিতি আরো উদ্বেগজনক ও আতঙ্কময় হয়ে ওঠে। উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ে সবার মাঝে। শনিবার দিবাগত রাতে দফায় দফায় গুলি-বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায় আতিয়া মহল থেকে। মধ্যরাতেই আতিয়া মহলের আশপাশের প্রায় দুই তিন বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ।

রোববার সকাল ৯টা ৫৭ মিনিট থেকে ফের শুরু হয় বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দ। ১০টা ৭ মিনিটে ফের প্রচ- শব্দে কেঁপে ওঠে শিববাড়ি এলাকা। এরপর ১১টা ৪৩ মিনিট ও ২টা ৪১ মিনিটে প্রচ- বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। ওইদিন বেশ কয়েকবার আতিয়া মহলে প্যারা-কমান্ডোর বুলেট প্রুফ আর্মারড ভেহিকেল ঢুকতে ও বেরোতে দেখা যায়। ওইদিন বিকেলে সেনা সদর দপ্তরের গোয়েন্দা পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ফখরুল আহসান প্রেস ব্রিফিংয়ে জানান, আতিয়া মহলে দুই জঙ্গি নিহত হয়েছে। ভেতরে আরো এক বা একাধিক জীবিত জঙ্গি থাকতে পারে। ভবনের ভেতর জঙ্গিরা বিস্ফোরক ছড়িয়ে রাখায় অভিযান চালাতে সময় লাগছে।

রোববার দিবাগত রাত কিছুটা শান্ত ছিল আতিয়া মহল। তবে সোমবার সকাল সাড়ে ৬টা থেকে ফের শুরু হয় গোলাগুলি। এদিন কয়েকবার আতিয়া মহল থেকে গুলি ও বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। দুপুর নাগাদ ধোঁয়া উড়তে দেখা যায়। সন্ধ্যায় প্রেস ব্রিফিংয়ে ফখরুল আহসান জানান, সেনা কমান্ডোদের অভিযানে চার জঙ্গি নিহত হয়েছে। তাদের মধ্যে তিন জন পুরুষ, একজন মহিলা। ভেতরে আর জীবিত জঙ্গি থাকার সম্ভাবনা নেই। দুই জঙ্গির লাশ পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুজনের লাশ উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। তাদের গায়ে সুইসাইডাল ভেস্ট লাগানো আছে।

সোমবার দিবাগত রাত থেকে মঙ্গলবার। পুরো শান্ত আতিয়া মহল। কোনো ধরনের গুলি বা বিস্ফোরণের শব্দ কিছুই ছিল না। সেনা কমান্ডোরা আতিয়া মহলের বিস্ফোরক নিষ্ক্রিয়করণ ও দুই জঙ্গির লাশ উদ্ধারের চেষ্টা করেন।

মঙ্গলবার দুপুরে দুই জঙ্গির ময়নাতদন্ত শুরু হয়। এজন্য ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসকদের তিন সদস্যের বোর্ড গঠন করা হয়। এক পুরুষ ও এক নারী জঙ্গির লাশের মধ্যে নারীকে কথিত মর্জিনা বেগম বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে পুলিশ জানিয়েছে, জঙ্গিদের পরিচয় শনাক্ত করতে ডিএনএ টেস্ট করা হবে।

আলোচিত আতিয়া মহলের মালিক উস্তার আলী। তিনি সিলেট আমদানি-রপ্তানি অফিসে ক্লার্ক হিসেবে যোগ দিয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে অবসরে যান। বছর চারেক আগে নিজের স্ত্রীর নামে আতিয়া মহল নির্মাণ করেন তিনি। পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ের জনক উস্তার আলী গত শুক্রবার জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে একটি বেসরকারি বাণিজ্যিক কোম্পানির কর্মকর্তা পরিচয়ে কাওছার নামের এক ব্যক্তি ভবনের নিচ তলার একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয়। সাথে তার স্ত্রী মর্জিনা বেগম ছিল।




রাইজিংবিডি/সিলেট/২৮ মার্চ ২০১৭/কামাল/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়