ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

তাজরীনে অগ্নিকাণ্ড : সাক্ষী না আসায় ঝুলে আছে বিচার

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:০০, ২৪ নভেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তাজরীনে অগ্নিকাণ্ড : সাক্ষী না আসায় ঝুলে আছে বিচার

মামুন খান : আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ১১২ শ্রমিকের প্রাণহানির ঘটনার পাঁচ বছর পার হলেও শেষ হয়নি মামলার বিচার কাজ। সাক্ষী হাজির না হওয়ায় অনেকটা থমকে আছে বিচার।

২০১২ সালের এই দিনে (২৪ নভেম্বর) আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশন কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে অন্তত ১১২ জন নিহত এবং শতাধিক শ্রমিক আহত হন। ঘটনার পরদিন আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম একটি মামলা করেন। ২০১৩ সালের ২২ ডিসেম্বর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিদর্শক একেএম মহসিনুজ্জামান খান আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু করেন আদালত। এরপর থেকে আসামিপক্ষের লোকজনের আর্থিক প্রলোভনের কারণে সাক্ষীরা আদালতে হাজির হচ্ছেন না বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। এখন পর্যন্ত ১০৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ৭ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। আর সাক্ষীদের মধ্যে দুইজন মালিকের পক্ষেই সাক্ষ্য দিয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে ভুক্তভোগীরা সুবিচার পাবেন কিনা- তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন শ্রমিক নেতারা।

গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশরেফা মিশু বলেন, ‘তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডের পাঁচ বছর পার হয়ে গেল। কিন্তু এখনও মামলার বিচার শেষ হলো না- এটা অত্যন্ত দুঃখজনক। শতাধিক শ্রমিকের প্রাণ যারা কেড়ে নিলো তারা জামিন নিয়ে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।’

তিনি বলেন, ‘মামলায় পুলিশ যাদের সাক্ষী করেছে, তাদের এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার যাদের সাক্ষী করা হয়েছে, তারা আদালতে এসে উল্টো সাক্ষী দিচ্ছেন। মালিকপক্ষ প্রভাবশালী হওয়ায় তারা শ্রমিককে বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন ও হুমকি দিয়ে সাক্ষী দেওয়া থেকে বিরত রাখছেন। সবকিছু মিলিয়ে আসামিদের বাঁচানোর জন্য একটা তৎপরতা আগের থেকেই চলে আসছে।’ শ্রমিকদের পক্ষ থেকে তিনি এই মামলার বিচার কাজ দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি জানান।

২০১৫ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা জেলা জজ এসএম কুদ্দুস জামান এ মামলার অভিযোগ গঠন করেন। পরবর্তী সময়ে মামলাটি বিচারের জন্য অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রথম আদালতে স্থানান্তর করেন। সর্বশেষ চলতি মাসের ৮ নভেম্বর এ মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু এদিনও পুলিশ আদালতে কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। এজন্য রাষ্ট্রপক্ষ সময় আবেদন করেন। তা মঞ্জুর করে আগামী ১১ জানুয়ারি পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য করেন বিচারক প্রদীপ কুমার রায়। এ মামলায় মোট সাক্ষী ১০৪ জন। এখন পর্যন্ত সাতজনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। এখনও ৯৭ জনের সাক্ষ্য বাকী রয়েছে। আদালত সাক্ষীদের প্রতি অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।

ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি খোন্দকার আবদুল মান্নান বলেন, ‘সাক্ষী হাজির না হওয়ার কারণে মামলাটির বিচার শেষ হচ্ছে না। সাক্ষীদের আদালতে হাজির করে মামলার বিচারকাজ ত্বরান্বিত করার সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা রাষ্ট্রপক্ষের রয়েছে।’

সংশ্লিষ্ট আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের অতিরিক্ত কৌঁসুলী কাজী শাহানারা ইয়াসমিন  বলেন, ‘সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সাক্ষীদের প্রতি অজামিনযোগ্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। কিন্তু তারপরও সাক্ষীরা হাজির হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘এ মামলায় অধিকাংশ সাক্ষী হলেন তাজরীনের কর্মচারী। আর তারা ছিল ওই এলাকার ভাড়াটিয়া। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা যখন তদন্ত করেছেন, তখন তিনি সাক্ষীদের বর্তমান ঠিকানা লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু স্থায়ী ঠিকানা নেননি। যে কারণে বর্তমান ঠিকানায় সমন গেলে পুলিশ তাদের খুঁজে পায় না। এজন্য আমরা কিছু সাক্ষী আনতে পারিনি। তবে যাদের স্থায়ী ঠিকানা রয়েছে, তাদের পর্যায়ক্রমে আমরা সাক্ষ্য দিতে আদালতে নিয়ে আসবো।’

তিনি আরও বলেন, ‘কিছু সাক্ষীকে আর্থিক প্রলোভন দেখানো হয়েছে। আদালতে কয়েকজন সাক্ষী মালিক পক্ষের অনুকূলে কথা বলেছেন। ঘটনার পর গার্মেন্টস মালিক বেশকিছু সাক্ষীকে ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। আর সেই ক্ষতিপূরণের কারণেই অনেকে আদালতে সাক্ষী দিতে চান না। আর সাক্ষী দিলেও তারা মালিকপক্ষের হয়েই সাক্ষ্য দিচ্ছেন। ৭ জনের মধ্যে এ রকম দু’জন সাক্ষী ছিলেন- যারা মূল কথা বলতে চাননি।’

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর তাজরীন গার্মেন্টসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে ১১১ জন পোশাক শ্রমিক ও কর্মী নির্মমভাবে নিহত হন। আহত হন ১০৪ জন শ্রমিক। গার্মেন্টস কারখানাটিতে এক হাজার একশ’ ৬৩ জন শ্রমিক কাজ করতেন কিন্তু দুর্ঘটনার সময় ৯৮৪ জন শ্রমিক সেখানে কর্মরত ছিলেন। নিহত ১১১ জনের মধ্যে তৃতীয় তলায় ৬৯ জন, চতুর্থ তলায় ২১ জন, পঞ্চম তলায় ১০ জন, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন হাসপাতালে মারা যান ১১ জন। লাশ শনাক্ত হওয়ায় ৫৮ জনকে তাদের আত্মীয় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। বাকী ৫৩ জনের লাশ শনাক্ত না হওয়ায় তাদের অশনাক্ত অবস্থায় জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়। ওই ঘটনায় আশুলিয়া থানার এসআই খায়রুল ইসলাম অজ্ঞাত পরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় নাশকতার পাশাপাশি অবহেলাজনিত মৃত্যুর দণ্ডবিধির ৩০৪(ক) ধারা যুক্ত করা হয়। মামলাটি তদন্তের পর ২০১৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর ১৩ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন সিআইডির পুলিশের ইন্সপেক্টর একেএম মহসীনুজ্জামন।

ভবনটির নকশায় ত্রুটি ও জরুরি নির্গমনের পথ না থাকায় এবং আগুন লাগার পর শ্রমিকরা বাইরে বের হতে চাইলে নিরাপত্তা কর্মীরা অগ্নিকাণ্ডকে অগ্নিনির্বাপন মহড়া বলে শ্রমিকদের কাজে ফেরত পাঠিয়ে কলাপসিবল গেট লাগিয়ে দেয় বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।

মামলার আসামিরা হলেন, প্রতিষ্ঠানের মালিক দেলোয়ার হোসেন, চেয়ারম্যান মাহমুদা আক্তার, লোডার শামীম, স্টোর ইনচার্জ (সুতা) আল আমিন, সিকিউরিটি ইনচার্জ আনিসুর রহমান, সিকিউরিটি সুপার ভাইজার আল আমিন, স্টোর ইনচার্জ হামিদুল ইসলাম লাভলু, অ্যাডমিন অফিসার দুলাল উদ্দিন, প্রকৌশলী এম মাহবুবুল মোর্শেদ, সিকিউরিটি গার্ড রানা ওরফে আনোয়ারুল, ফ্যাক্টরি ম্যানেজার আব্দুর রাজ্জাক, প্রোডাকশন ম্যানেজার মোবারক হোসেন মঞ্জুর ও শহীদুজ্জামান দুলাল।

আসামিদের মধ্যে মো. শহিদুজ্জামান দুলাল, মোবারক হোসেন মঞ্জু, মো. রানা ওরফে আনোয়ারুল ও মো. শামিম মিয়া পলাতক রয়েছেন।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ নভেম্বর ২০১৭/মামুন খান/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়