ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

মরাগাছ কি মৃত?

জায়েদ ফরিদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৫১, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মরাগাছ কি মৃত?

দেশি পাতি মাছরাঙা, সূত্র: HBW Aliv

জায়েদ ফরিদ: অন্ধকার বাঁশঝাড়ের ধার ঘেঁষে কালচে পানির ডোবা। মরা ডালের উপর বহুক্ষণ একঠায় বসে আছে মাছরাঙা পাখিটা। একদম নড়াচড়া নেই, যেন খেলনা দোকান থেকে কেনা এক মাছরাঙা পুতুল বসিয়ে রাখা হয়েছে ডালে। খলপা-বেড়ার জানালায় চোখ রেখে বিরক্ত হয়ে উঠি আমি, এইভাবে কতক্ষণ বসে থাকবে পাখিটা? পেছন থেকে দিদির উত্তর আসে, ‘তোর আসলে বসে বসে মাছরাঙার শিকার দেখা ভালো। ধৈর্যও বাড়বে আর ছটফটানিও কমবে। যখন পড়ার টেবিলে বসবি তখন নিজেকে ভাববি মাছরাঙা।’ নিজেকে মাছরাঙা ভাবতে ভালোই লাগে আমার, যেন কোনো কিছু পাওয়ার আশায় আমিও বসে আছি একঠায়।

ডালের আগায় মাছরাঙা পুতুলটা একটুও নড়ে না। অগত্যা নিজের চোখদুটোকেই নড়াতে থাকি আমি। পাখিকে বাদ দিয়ে এবার গাছটাকে দেখি। কিশোর চোখে গাছটাকে বেশ মোটা মনে হয়; সারা গায়ে অসংখ্য ছিদ্র। ছালবাকলা উঠে গেছে গাছের, কী গাছ তা বোঝার উপায় নেই। এবার জিজ্ঞাসা করি, ‘গাছের গায়ে এত ছিদ্র কেন দিদি?’

আমেরিকার কাঠঠোকরা, সূত্র: TomGrey


কোনো জবাব নেই। দিদি কখন চলে গেছেন পেছন থেকে, টের পাইনি। এঁদো ডোবার নীরবতা ভেঙে হঠাৎ ঝুপ করে শব্দ হয় জলে। এতক্ষণে তাহলে মাছরাঙা জল থেকে তুলে আনলো মাছ। নাহ্‌, মাছ নয়, হাত-পাওয়ালা ব্যাং। মাছরাঙা ব্যাং খায় নাকি! এই অদ্ভুত বিষয়টি জানানোর জন্য দিদিকে খুঁজতে থাকি। উঠানের কোণে রান্না করছেন দিদি, আমের খড়ি দিয়ে। ধোঁয়ায় ভরে গেছে চারদিক। তার ইশারায় ফিরে আসি খলপা-ঘরের জানালায়। মাছরাঙা পাখিটা নেই, তার বদলে দেখছি এক কাঠঠোকরা পাখি। মরাডাল খামচে ধরে চারদিক দিয়ে ঘুরছে আর গর্তে ঠোঁট ঢুকিয়ে পোকা বের করে খাচ্ছে। চঞ্চল কাঠঠোকরা পাখিটাকেই দেখতে থাকি আমি, ভুলে যাই মাছরাঙা, এমন কি দিদিকেও।

মরাকাঠের গায়ে কেন গর্ত হয় তা সত্যিকার জেনেছি বহুকাল পরে। আরও জেনেছি, বনাঞ্চলে এমন মরাগাছ থাকতে হয় বিঘাপ্রতি অন্তত গোটা দুই। মরাগাছের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে অসংখ্য প্রাণী যেখানে বাসা বেঁধে বাচ্চা ফোটায় পরাগায়নকারী ভ্রমর, কাঠবিড়ালী, কাঠঠোকরা, চামচিকা, প্যাঁচা ও আরও কিছু পাখি। আমাদের উপমহাদেশে মরাগাছের জীববৈচিত্র নিয়ে কোনো ব্যবহারযোগ্য পরিসংখ্যান এখনো নেই। আমেরিকায় অন্তত ৮৫ রকমের পাখি, ৫০ রকমের স্তন্যপায়ী, ডজনখানেক সাপ এবং কিছু উভচর প্রাণীও মরাগাছ ব্যবহার করে খাদ্য, মেটিং, বিশ্রাম, প্রহরা, বাসা তৈরি ইত্যাদি কাজে। এ ছাড়াও অনেক অমেরুদণ্ডী প্রাণী, বিটলস্, পিঁপড়া, মাকড়সা, সহস্রপদীও বাস করে গাছে, যাদের কেউ খাদক, কেউ খাদ্য। ফরেস্ট সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী গোটা আমেরিকায় প্রায় ১২০০ রকম প্রাণী মৃত বা অর্ধমৃত গাছের উপর নির্ভরশীল।

ভূপাতিত বৃক্ষের শেষ দশা, সূত্র: Plumas National Forest


যাবতীয় পক্ষীনীড়ের মধ্যে কাঠের কোটরই শ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত। ঝড়বৃষ্টি, বৈরি আবহাওয়া ও খাদক থেকে নিরাপত্তাও অনেক বেশি। কুটোকাটা দিয়ে নির্মিত খোলা বাসায় এই সুবিধাগুলো নেই। এসব মজবুত কাঠের বাড়ি কাঠঠোকরা-জাতীয় পাখিই সবচেয়ে ভালো বানাতে পারে। লম্বাটে চোখা ঠোঁট দিয়ে মরা কাঠে বাসা বানানো তাদের জন্য অল্প সময়ের কাজ। এদের মাথার খুলিও আবৃত থাকে মোটা শকপ্রুফ হাড় দিয়ে, কাঠে ছিদ্র করতে গিয়ে যাতে মস্তিষ্কে কোনো সমস্যা না হয়। বাসা বানিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে সপরিবারে কাঠঠোকরা চলে যায় অন্যত্র, প্রয়োজনে নতুন করে বাসা তৈরি করে। পুরানো বাসায় আস্তানা করে অন্য পাখি যারা কাঠ খোদাই করে বাসা বানাতে পারে না। পাখি ছাড়াও মরাগাছে বাস করে ইঁদুর-জাতীয় ছোটখাট প্রাণী, কিছু অমেরুদণ্ডী প্রাণী, ছত্রাক ও ব্যাক্টেরিয়া। সব মিলিয়ে তৈরি হয় এক অভাবনীয় জীববৈচিত্র। তাই ইদানীং জীববিজ্ঞানীরা একে মৃত গাছ না বলে বলতে চাইছেন ‘ওয়াইল্ডলাইফ ট্রি’ (Wildlife tree), অরণ্যবিদ্যায় ইংরেজিতে যার প্রচলিত নাম স্ন্যাগ  (Snag)।

বর্তমানে মানুষই গাছের সবচেয়ে বড় হন্তারক হলেও নানাপ্রকার প্রাকৃতিক কারণে গাছের মৃত্যু হয়। খরা, বজ্রপাত, দাবানল, বার্ধক্য, রোগবালাই ইত্যাদি কারণে এদের মৃত্যু হলেও এর সঙ্গে ‘বিভার’ (Beaver) নামক প্রাণীর নাম যোগ করা যায় যারা একপ্রকার ‘কি-স্টোন’ (Keystone) প্রজাতি। ভূদৃশ্য বা ল্যান্ডস্কেপ পরিবর্তনে মানুষের পরই বিভারের স্থান। কানাডার জাতীয় প্রাণীটার আদিবাস সবিশেষে উত্তর আমেরিকা হলেও ইউরোপ ও এশিয়ার কিছু অঞ্চলেও এদের দেখা যায়। বিভার বড়সড় তীক্ষ্ণদন্ত‘রোডেন্ট’ বা ইঁদুর-জাতীয় প্রাণী। এরা আস্পেন, ম্যাপেল, চেরি, উইলো ইত্যাদি পুষ্ট গাছের গোড়া কেটে আহার করে এবং বাসা তৈরির মালামাল সংগ্রহ করে। গাছ কাটার পর শীর্ণ খালের উপর ভূপাতিত হলে ‘বিভার সেতু’ নির্মিত হয়। এই সেতুর উপর দিয়ে সহজেই প্রাণীরা এ-বন সে-বন করে ঘুড়ে বেড়াতে পারে খাদ্যের অন্বেষণে। বিভারের ক্ষুরধার দাঁত লোহার যৌগ দিয়ে বাঁধাই করা থাকে বলে রং হয় কমলা। দ্রুত বড় হতে থাকে এই দাঁত, তাই যতই গাছ কাটুক তারা সমস্যা হয় না। বিভার অত্যন্ত কর্মচঞ্চল প্রাণী যারা রাতারাতি ডালপালা কেটে, মাটি, ঘাস আর টুকরো কাঠ জড়ো করে বাঁধ তৈরি করে ফেলতে পারে। এই বাঁধ কয়েক ফুট উঁচু এবং দুইশ ফুট লম্বা হতে পারে। বাঁধ তৈরি হলে বেষ্টনীর মধ্যে প্রায় স্রোতহীন জলের উপর তৈরি হয় বিভারদের ভাসমান আস্তানা। পারিবারিক নিরাপত্তার কারণে বিশাল ভাসমান বাসার তলদেশে থাকে প্রবেশমুখ যাতে সহজে কোনো শত্রু প্রবেশ করতে না পারে।

বিভার বাঁধ, সূত্র: Odyssey


বিভার যে সব গাছ কেটে ফেলে সেসব গাছের গোড়া থেকে গজারির মত কপিস (Coppice) বা নতুন গাছের জন্ম হয়। সংখ্যা নিয়ন্ত্রণে থাকলে বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য এরা উপকারী প্রাণী। বিভারের মূল্যবান রোমশ চামড়া ও দেহাভ্যন্তরের সেন্ট গ্লান্ডের জন্য মানুষ এদের বংশ প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছিল। এখন প্রাক্তন বিভার-অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে নতুন করে আবার প্রবর্তন করা হয়েছে এদের, যদিও ৫০ মিলিয়নের তুলনায় এখনও এদের সংখ্যা ১০-১৫ মিলিয়ন মাত্র।

একটি মরাগাছের কাঠ কিভাবে ধীরে ধীরে ক্ষয়প্রাপ্ত হয়ে মাটিতে মিশে যায় তা বেশ জটিল ব্যাপার। ছত্রাক আর উইঁপোকা ছাড়া কাঠের দুটি উপাদান 'সেলুলোজ' ও তার বন্ধনকারী 'লিগনিন' সহজে ধ্বংস হয় না। উইঁপোকাও প্রকৃতপক্ষে সরাসরি কাঠ হজম করতে পারে না, তবে এদের অন্ত্রে যে মাইক্রো-অরগ্যানিজম থাকে তা সেলুলোজ ভেঙে ফেলতে পারে। ছত্রাক একপ্রকার এনজাইম নির্গত করে উদ্ভিদের সেলুলোজ খেয়ে ফেলার জন্য। প্রথমে গাছের রসকাষ্ঠ (Sapwood) নষ্ট হয় এবং পরে সেই পচন গভীরে ছড়িয়ে পড়লে সারকাঠও নষ্ট হতে শুরু করে। ছত্রাকের এই আক্রমণ প্রতিহত করার চেষ্টা করে গাছ, কিন্তু সক্ষম না হলে অন্যান্য খাদক মস, স্লাগ ইত্যাদির আক্রমণের শিকার হয়। উপর থেকে ক্রমশ নিচের দিকে ভেঙে গুঁড়িয়ে যেতে থাকে আক্রান্ত গাছ এবং এক সময় সম্পূর্ণ মাটিতে মিশে যায়, যা বায়োডিগ্রেডেশন (Biodegradation) নামে পরিচিত। এই অবক্ষয়ের জন্য ১০-১৫ বছর স্বাভাবিক সময় মনে হলেও দানবীয় 'সিকোয়া' বা 'রেডউড' জাতীয় মহীরুহের তাতে কয়েকশত বছর লেগে যাওয়া বিচিত্র নয়। কার্বন ও পুষ্টিসমৃদ্ধ গাছ ঝুরো হয়ে গেলে জলীয় বাষ্প ধরে রাখে এবং অন্য গাছ জন্মাতে সাহায্য করে। এই অবক্ষয়প্রাপ্ত কাষ্ঠচূর্ণ দিয়ে কিছু পাখি স্নান করে, ধূলিস্নানের মতই। এতে পাখির শরীরের যে সব উকুন বা মাইট থাকে সেগুলো শ্বাসরূদ্ধ হয়ে মারা পড়ে। শরীরের তৈলাক্ত ভাবও চলে যায় এবং পাখি যখন ঠোঁট দিয়ে পালক বিন্যাস করে তখন দেহের অনেক ময়লা দূর হয়ে যায়।

গাছ কাটা বিভার, সূত্র: Science Byu


যখন কোনো মরাগাছ মাটির পরিবর্তে জলে গিয়ে পড়ে তখনো তারা মাছ ও জলজ প্রাণীর জন্য পুষ্টির আধার হিসাবে কাজ করে এবং তার শরীরে আশ্রয় নেয়। আমাদের দেশে মাছ ধরার জন্য গাছের ডাল ভিতরে রেখে ত্রিকোণাকার শাগরা পাতা হয় নদী-খালের কিনারে। চিংড়িসহ কয়েক রকমের ছোট মাছ নিরাপত্তা, পরিবেশ ও পুষ্টির জন্য শাগরাতে বাস করতে পছন্দ করে। অর্ধভাসমান গাছের গুঁড়িতে নৌচলাচল ব্যাহত হবে মনে করে অস্ট্রেলিয়ার মারে-ডার্লিং নদীর গর্ভ থেকে যখন অজস্র মরাকাঠ তুলে নেয়া হলো তখন বিপর্যয় দেখা দিল বিখ্যাত আঞ্চলিক মাছ 'মারে-কড' নিয়ে। কারণ এসব তুলে ফেলা মরাকাঠের ভিতর তারা নিরাপদে বংশবিস্তার করত। মৃত পাইনগাছের 'লগ' দিয়ে ফিনল্যান্ডে দামী আসবাব তৈরি হয় যা 'কেলো ফার্নিচার' নামে পরিচিত। বনবৃক্ষের আধিক্য থাকার কারণে এটি একটি আঞ্চলিক ব্যাপার, বাকি পৃথিবীর জন্য তা প্রযোজ্য নয়।

আমাদের উইপমহাদেশে গ্রামাঞ্চলে প্রায়শ জ্বালানির অভাব হয় বলে মরাগাছের অস্তিত্ব থাকে না। তবে ধারণা করি, যেহেতু একটি মৃত গাছের পূর্ণ জৈব অবক্ষয়ে সময় লাগে তাই জ্বালানির টান পড়লে বরং কাঁচা গাছের অতিরিক্ত ডালপালা কেটে খড়ি করে নেয়া মন্দ নয়। এতে নতুন ডাল গজাবে, পুরানো মৃতগাছ বা 'ওয়াইল্ডলাইফ প্ল্যান্ট'গুলো রক্ষা পাবে, জীববৈচিত্র ও প্রাকৃতিক ভারসাম্যও বজায় থাকবে প্রকৃতিতে। বিঘাপ্রতি গোটাকয়েক মৃত গাছ রাখা বেশ জরুরি হয়ে পড়েছে আমাদের। এমন কি আমাদের উঠানে বা বাগানের গাছ ছোঁয়াচে রোগে মরে না গেলে তা কাটার দরকার দেখি না। কদর্য মনে হলে মরাগাছের চারদিকে কিছু লতা গাছ লাগিয়ে সুশোভিত করা যেতে পারে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/ ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮/হাসনাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়