ঢাকা     বুধবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

ডিজিটাল উপকূল-২

ডিজিটাল সুবিধায় প্রান্তিকে বেড়েছে প্রশাসনিক নজর

রফিকুল ইসলাম মন্টু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১৯, ১৭ এপ্রিল ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ডিজিটাল সুবিধায় প্রান্তিকে বেড়েছে প্রশাসনিক নজর



উপকূলের প্রান্তিক জনপদের আড়ালে থাকা খবর মুহূর্তেই চলে আসছে সংবাদমাধ্যমে। প্রশাসনের নজরে আসায় সমস্যা সমাধান হচ্ছে তড়িৎ গতিতে। কখনো দ্বীপাঞ্চলের খবর সাড়া ফেলছে জাতীয় পর্যায়ে। এর মধ্য দিয়ে প্রান্তিকের নাগরিকেরা উপকৃত হচ্ছেন; অন্ধকারে পড়ছে তথ্যপ্রযুক্তির আলো। অথচ এক সময় অন্তরালে থাকা অনেক খবর প্রকাশ হতো না। আড়ালেই রয়ে যেত। ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষের ভোগান্তি বাড়ত; সমস্যার সমাধান হতো না সহজে।

নোয়াখালীর দ্বীপ হাতিয়ার সুখচরের মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আগে তো আমাদের খোঁজখবর কেউ নিত না। অনলাইনের যুগ আইসা যেন আমাদের গুরুত্ব বেড়ে গেছে। অনেকেই আমাদের খোঁজ নিতে আসেন। এলাকার খবর দেখি মিডিয়ায়। এই খবর প্রশাসনের নজরে আসায় তারা ব্যবস্থা নেন।’

শীর্ষস্থানীয় নিউজ পোর্টালগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারের ফলে গণমাধ্যমে উঠে আসছে উপকূলের সব ধরণের খবর। দ্বীপ-চরের বহু এলাকা এখনও ঢেকে আছে গভীর অন্ধকারে। মহাজন-জোতদার-শোষক শ্রেণীর দাপটে কথা বলার সাহস নেই নিরীহ মানুষগুলোর। উপকূলের বহুগ্রামে এখনও বিদ্যুতের আলো পৌঁছেনি। কাঁচের ভেতর দিয়ে কীভাবে আলোর দ্যুতি ছড়ায়, তা আজও অজানা সেখানকার বহু মানুষের কাছে। পাকা রাস্তা কিংবা শহর দেখার সৌভাগ্য হয়নি অনেকেরই। কাদাপানিতে লেপটে থাকা জীবনের খবর রাখতেন না অনেকেই। সে অবস্থা এখন অনেকটাই বদলেছে।
 


জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বহুমূখী দুর্যোগে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে দেশের উপকূলীয় এলাকা। সাম্প্রতিককালে নদী ভাঙ্গন বেড়েছে। সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা। প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ কমে যাচ্ছে। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। এরই মধ্যে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বেড়ে যাওয়ায় ভয়াবহতার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। বদলে যাচ্ছে উপকূল এলাকার মানুষের জীবন জীবিকার ধরন। প্রভাব পড়েছে সুন্দরবনের ওপর। প্রকৃতির রূদ্ররূপ সুন্দরবনের অস্তিত্ব বিলীন করে দিচ্ছে। জোয়ারের পানির প্রভাব বেড়েছে। পানিতে বাড়ছে লবণাক্ততা। এর প্রভাব পড়ছে কৃষি ব্যবস্থার ওপর।

সূত্রগুলো বলছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে দেশের উপকূলীয় এলাকার জন্য অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ দুর্যোগের সংকেত। উপকূলীয় অঞ্চলজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। উপকূলের মানুষ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে রয়েছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক, মৎস্যজীবী থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশাজীবী জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকায় প্রভাব পড়ছে। বেড়েছে নানা ধরণের দুর্যোগ। প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীল মানুষগুলো খাদ্য নিরাপত্তাহীতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই খবরগুলো খুব একটা কেন্দ্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। এখন অনেক স্থানের খবর অনলাইন মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকেই জানতে পারছেন। প্রশাসনের স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় কর্মকর্তারা খবরগুলো তাৎক্ষণিকভাবে পাচ্ছেন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তারা দ্রুত ব্যবস্থাও নিতে পারছেন। লক্ষ্মীপুরের রামগতির টাংকি বাজারের আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আগে আমাদের এলাকার খবরাখবর মিডিয়ায় তেমন দেখিনি। এখন দেখছি। কোনো সমস্যা হলে প্রশাসনের লোকজনও আসেন।’

সূত্র বলছে, স্থানীয় পর্যায়ের অবকাঠামোগত সমস্যা ছাড়াও তাৎক্ষণিক কিছু খবর দ্রুত প্রচারিত হওয়ায় মানুষের জীবনে পরিবর্তন এসেছে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে বাল্যবিয়ে রোধে। অনলাইন গণমাধ্যমে খবর প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে তা পৌঁছে যাচ্ছে উপজেলা কিংবা জেলা প্রশাসনের কাছে। সেখান থেকে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে বাল্যবিয়ে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষের অজ্ঞতার কারণে যেসব এলাকায় অহরহ বাল্যবিয়ে হতো; সেসব এলাকা এখন বাল্যবিয়ে মুক্ত। এছাড়াও দরিদ্র ছেলেমেয়েদের স্কুলে পাঠানো, প্রতিবন্ধীদের ভাতা প্রদান, বয়স্ক ভাতা প্রদান এমনকি রাস্তাঘাট সংস্কারের মত খবরেও প্রশাসনের তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছেন।

লক্ষ্মীপুর জেলা তথ্য কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘বর্তমানে অনলাইন পত্রিকার কারণে প্রান্তিকের প্রায় সব ধরনের খবর পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসে সহজেই পাওয়া যায়। ফলে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া সহজ হচ্ছে। সমস্যা-সম্ভাবনার খবরের পাশাপাশি সরকারের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড এবং সচেতনতামূলক বার্তা জনগণের কাছে তুলে ধরতে অনলাইন গণমাধ্যমগুলো অগ্রণী ভূমিকা রাখছে। ফলে প্রান্তিক যুক্ত হচ্ছে কেন্দ্রের সঙ্গে।’
 


কমিউনিটি বেইজড অনলাইন গণমাধ্যম লক্ষ্মীপুর টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সম্পাদক সানা উল্লাহ সানু বলেন, ‘অনলাইন গণমাধ্যমের কল্যাণেই যে কোনো তথ্য সবার আগে প্রচারিত হচ্ছে। দায়িত্বশীল গণমাধ্যম ছাড়াও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে ও যে কোন তথ্য প্রচার করা যায়; তবে সে ক্ষেত্রে তা মানুষের গ্রহণযোগ্যতা পায় না। এক্ষেত্রে অনলাইন গণমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এক সময় খবরের জন্য পাঠক অপেক্ষা করতেন মুদ্রণ সংবাদপত্রের জন্য। এখন আর সে অপেক্ষা নেই। মুহূর্তেই সব খবর জানা যাচ্ছে।’ বরগুনা পুলিশ সুপার বিজয় বসাক (বিপিএম) বলেন, ‘অনলাইন মিডিয়ার বিকাশের আগে যে কোন খবর আমাদের কাছে পৌঁছাতে সময় নিতো। অনেক সময় অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবরও আমাদের কাছে পৌঁছাতোই না। অনলাইন মিডিয়ার ফলে এখন সব খবর মুহূর্তের মধ্যেই আমাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে এবং সাথে সাথেই আমরা ব্যবস্থা নিতে পারছি।’

তিনি আরো বলেন, ‘অনেক মানুষ অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানে; কিন্তু সময় বা সুযোগের অভাবে আমাদের কাছে জানাতে পারে না। এখন ফেসবুকের মাধ্যমে পৃথিবীর যে কোন প্রান্তে বসে তিনি সরাসরি আমাকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে পারছেন। এছাড়াও প্রিন্ট মিডিয়া একটি খবর পরের দিন ছাপা হয়; কিন্তু অনলাইন মিডিয়া যে কোন খবর তাৎক্ষণিক ছাপা হয়। এতে করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারছি। অনলাইন মিডিয়া বিকাশের ফলে আমাদের সমাজের অপরাধ প্রবণতা অনেক কমে গেছে।’

বরগুনা জেলা অনলাইন সাংবাদিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সুমন সিকদার বলেন, ‘একটা সময় আমাদের অগ্রজরা হাতে লিখে নিউজ পাঠাতেন। অনেক সময় ছাপা হতো, আবার কখনো ছাপাই হতো না নিউজ। ছাপা হলেও সে নিউজ এসে পৌঁছাতে পৌঁছাতে নিউজের গুরুত্ব কমে যেতো। ডিজিটাল যুগ আমরা এখন নিউজ কম্পিউটারে লিখে পাঠাচ্ছি খুব দ্রুততম সময়ের মধ্যে। কেউ কেউ নিউজ লেখার জন্য স্মার্ট ফোনও ব্যবহার করছেন।’ তিনি আরো বলেন, ‘অনলাইন মিডিয়া হওয়ার ফলে আমরা তাৎক্ষণিক সব ধরণের সংবাদ কেন্দ্রে পাঠাতে পারছি, সেই সাথে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের বলারও সুযোগ আছে। তাছাড়াও অনলাইন মিডিয়ার ফলে আমাদের ডেস্ক ইনচার্জ কিংবা অ্যসাইনমেন্ট এডিটরগণ বিভিন্ন অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিউজ দেখে আমাদের দিকনির্দেশনাও দিতে পারছেন।’

উপকূলের স্থানীয় বিভিন্ন পর্যায়ের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাজধানী ঢাকা থেকে বহু দূরের এই এলাকাগুলো সব দিক থেকে পিছিয়ে আছে। সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে এখানকার সাধারণ মানুষের কোন যোগাযোগ ছিল না। তথ্য-শূন্যতায় স্বাভাবিক জীবনযাপনে নেমে আসতো চরম দুর্ভোগ। দুর্যোগের সংকেত তাদের কাছে সঠিক সময়ে পৌঁছাতো না। ফলে প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বেড়ে যেত। কিন্তু ইন্টারনেট সুবিধা সে অবস্থায় পরিবর্তন এনেছে। বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের মাঝে বেড়েছে সচেতনতা। কুতুবদিয়ার তাবালর চরের বাসিন্দা সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘এক সময় আমরা অন্ধকারে ছিলাম। ঢাকায় কী হচ্ছে কিছুই জানতে পারতাম না। এখন জানতে পারি। রাজনৈতিক উত্তাপ কিংবা অন্য কোন কারণে পরিস্থিতি অশান্ত হয়ে উঠলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পাওয়া খবরেই এখন ভরসা। সঙ্গে সঙ্গে পাওয়া খবর আমাদের ভাবতে সাহায্য করছে, সিদ্ধান্ত নিতে সুযোগ করে দিচ্ছে। আবার আমাদের খবরও কেন্দ্রে পৌঁছাচ্ছে দ্রুত।’

অনলাইনে খবর প্রচার ছাড়াও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ বিভাগের ৯৯৯ নাম্বারে সরাসরি প্রান্তিক জনপদের মানুষের নানান অভিযোগ আসছে। সেসব অভিযোগের বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ তাৎক্ষণিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারছে। সাধারণ মানুষ সহজেই আইনি সেবা পাচ্ছেন। সমাজে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। জাতীয় জরুরি সেবা বিভাগের সহকারী পুলিশ সুপার মিরাজুর রহমান পাটোয়ারী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে যে কোনো নাগরিক ৯৯৯ নাম্বারে কল করে অভিযোগ জানাতে পারেন। এটা জরুরি সেবা নামে পরিচিত। বিভিন্ন ধরণের দুর্ঘটনা, যেমন আগুন লাগা, বাল্যবিয়ে, ডাকাতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানুষের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে আমরা ব্যবস্থা নেই। এর মাধ্যমে বহু ঘটনার নিষ্পত্তি হয়েছে। উপকূলের প্রান্তিক জনপদ থেকেও জরুরি সেবায় কল আসে। সেখানকার মানুষও যথাযথ সেবা পাচ্ছেন।’




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৭ এপ্রিল ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়