ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

জাপার কঠিন সময়, এরশাদের স্বপ্ন অধরা

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:১৫, ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জাপার কঠিন সময়, এরশাদের স্বপ্ন অধরা

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন: ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। এই নির্বাচনই প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির শেষ নির্বাচন। বছরের শেষ মুহূর্তে এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়াই ছিল তার ধ্যান জ্ঞান ও একমাত্র লক্ষ্য।

এক বছর ধরে এরশাদ নিজেই বলে আসছেন, ‘জীবনের শেষ সময়ে এসে গেছি, ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনই আমার শেষ নির্বাচন। এই নির্বাচনে লড়াই করে ক্ষমতায় যেতে চাই। সরকার গঠনই আমার জীবনের শেষ প্রত্যাশা। বিরোধী দলে নয়, সরকার গঠনই আমার জীবনের শেষ স্বপ্ন।’

সেই ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন পুরণে সুখ-অসুখ নিয়ে গত একবছর মাঠে-ময়দানে চষে বেড়িয়েছেন জাপার চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদ। কোটি কোটি টাকা খরচ করে সভা-সমাবেশ করেছেন। মনোনয়নের টোপ দিয়ে প্রকাশ্য ও গোপনে দলে ভিড়িয়েছেন অনেক বিত্তশালীকে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিবন্ধিত-অনিবন্ধিত অর্ধশতাধিক দল নিয়ে রাজনৈতিক জোট গঠন করে চমকও দেখিয়েছেন তিনি।

সবকিছুর লক্ষ্য একটাই, শেষ বয়সে এসে এরশাদের আরেকবার ক্ষমতায় যাওয়া। আর তার মধ্য দিয়ে জাতীয় পার্টিকে বাঁচিয়ে রাখাই ছিল দলটির চেয়ারম্যানের উদ্দেশ্য।

কিন্তু বছর শেষে জীবনের এই শেষ সময়ে এসে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের। ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় নির্বাচনে ভোটে বিজয়ী হয়ে এরশাদের দল ক্ষমতা গ্রহণ করছে না- সেটা এখনই নিশ্চিত করে বলা যায়। বরং ২০১৮ সাল এরশাদ ও দলের জন্য চরম বিপর্যয়ের বছর। নেতাকর্মীরা পার করছেন কঠিন সময়। এই অবস্থা থেকে নতুন বছর দলটি ঘুরে দাঁড়াতে পারবে কিনা তা নিয়েই চিন্তিত তারা।

জানা গেছে, একাদশ নির্বাচনে এরশাদের অনুপস্থিতিতে জাতীয় পার্টির এমন কঠিন অবস্থা ও বিপর্যয় দেখে দলটির নেতাকর্মীরা চরম হতাশ হয়ে পড়েছেন। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন অনেকেই। প্রার্থী হয়েও মাঠে সক্রিয় নেই অনেক নেতা। তাদের বক্তব্য, কী হবে নির্বাচন করে। পার্টির চেয়ারম্যান বিদেশে। ঢাল নেই তলোয়ার নেই- এই হচ্ছে আমাদের অবস্থা।

চরম হতাশায় ক্ষোভে দু:খে প্রাক্তন হুইপ শওকত চৌধুরী, আমির হোসেন ও অনেক প্রার্থী নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে পড়েছেন। শুধু তাই নয়, জাতীয় পার্টি ও দলটির চেয়ারম্যানের ভবিষ্যত নিয়েও নেতাকর্মীদের হতাশা প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। তাদের অনেকে এখন থেকে জাতীয় পার্টি ছাড়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন।  

জাপাকে ক্ষমতায় নিয়ে যেতে নির্বাচনী মাঠে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল যার, কঠিন অসুখ নিয়ে সেই এরশাদের সময় কাটছে এখন সিঙ্গাপুরে হাসপাতালের বিছানায়। তার অনুপস্থিতিতে একাদশ নির্বাচনকে ঘিরে বর্তমানে কঠিন সময় পার করছে এরশাদের জাতীয় পার্টি। এখন আর ক্ষমতায় যাওয়া নয় বরং এরশাদের মৃত্যুর পর জাতীয় পার্টির হাল কে ধরবেন, কী হবে দলটির অবস্থা- এ নিয়ে নতুন করে ভাবনায় পড়েছেন নেতাকর্মীরা।

জাতীয় পার্টি কঠিন সময় পার করছে স্বীকার করে এরশাদের প্রেস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সেক্রেটারি সুনীল শুভ রায় বলেন, ‘একাদশ নির্বাচনকে ঘিরে জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে এমন দু:সময় আর আসেনি। নেতাকর্মীরা কঠিন সময় পার করছে। অথচ চলতি বছরের এই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাবো- এটাই ছিল আমাদের একমাত্র লক্ষ্য উদ্দেশ্য। কিন্তু শেষ সময়ে এসে সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল।

জানা গেছে, মঞ্জুর হত্যা মামলার মতো গুরুত্বপূর্ণ মামলার আতঙ্ক নিয়ে অসুস্থ্য এরশাদ চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছেন। তার অবর্তমানে এই নির্বাচনে যার সার্বিক নেতৃত্ব দেওয়ার কথা সেই পার্টির জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যান রওশন এরশাদ বয়সের ভারে ন্যুব্জ হয়ে নিজের নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ময়মনসিংহে। ছোট ভাই দলের কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের আর দলের নতুন মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙা আছেন নির্বাচনী মাঠে। এই অবস্থায় সারাদেশে নির্বাচনী মাঠে যারা রয়েছেন তাদের দেখার কেউ নেই। বিভিন্ন এলাকায় জাপা প্রার্থীরা প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসী হামলাসহ নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হলেও কেন্দ্র থেকে বিবৃতি দেওয়ার কেউ নেই। যে যার সামর্থ্য অনুযায়ী নির্বাচনী গণসংযোগ চালিয়ে এলেও প্রতিনিয়ত প্রতিপক্ষের প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে এরশাদ তথা দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে এই অবস্থায় লাঙলের বিজয় ছিনিয়ে আনা কঠিন বলে মনে করছেন নেতাকর্মীরা। তাছাড়া মহাজোট মনোনীত জাপার অনেক প্রার্থী দুর্বল এবং অজনপ্রিয়। এসব আসনে নৌকার সমর্থকরা বহিস্কারের ভয়ে মুখে মহাজোট মনোনীত জাপা প্রার্থীদের কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও মূলত তারা লাঙলের বিরুদ্ধে লিপ্ত। শুধু তাই নয়, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান এরশাদ তৃণমূলের মতামত ছাড়া অনেক জায়গায় ত্যাগীদের বাদ দিয়ে বিতর্কিতদের মনোনয়ন দেওয়ায় নির্বাচনে অনেক আসনে লাঙলের জামানত হারানোর আশঙ্কা করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। সব মিলিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখা এরশাদের জাতীয় পার্টির অবস্থা এখন ছন্নছাড়া। বরং অসুস্থ্যতা ও বার্ধক্য এরশাদের ভবিষ্যতকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। আর তার অনুপস্থিতিতে জাতীয় পার্টি এখন বিপর্যস্ত ও অভিভাবকহীন বলে মনে করছেন অনেক নেতাকর্মী।

জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা বলেন, ‘যখনই ক্ষমতায় যেতে জাতীয় পার্টি প্রস্তুত থাকে, ঠিক সেই মুহূর্তে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান আলহাজ হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও তার দলকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। চলতি বছরের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যখন আমরা ক্ষমতায় যাওয়ার দ্বার প্রান্তে, তখনই পার্টির চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চক্রান্ত শুরু হয়। তবে অতীতের মতো সব প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে পার্টির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে নতুন বছরে আমরা আবার ঘুরে দাঁড়াবো ইনশাআল্লাহ।’

জানা গেছে, একেক সময় একেক কথা বলা, সিদ্ধান্তহীনতা, বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, মনোনয়ন বাণিজ্য, ত্যাগীদের বাদ দিয়ে বিতর্কিতদের দলে পদায়ন ও মনোনয়ন, স্ত্রী রওশন এরশাদের সঙ্গে বিরোধে জড়ানো, ছোট ভাই জিএম কাদেরকে অবিশ্বাস ও কোনঠাসা করে রাখা, সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক না রাখাসহ নানা কারণে ২০১৮ সাল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জন্য বিপর্যয়ের বছর। তাছাড়া শারিরিক অসুস্থতা সাবেক রাষ্ট্রপতিকে ছিটকে ফেলেছে স্বাভাবিক জীবন যাপন থেকে। সব মিলিয়ে এই বছরে ক্ষমতায় যাওয়া এরশাদের জীবনের শেষ স্বপ্ন পুরণ হলো না।

 

 


রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ ডিসেম্বর ২০১৮/নঈমুদ্দীন/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়