ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘আমার মৃত্যুর পরও গানগুলো মানুষ শুনবে’

রাহাত সাইফুল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৭:১০, ২২ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘আমার মৃত্যুর পরও গানগুলো মানুষ শুনবে’

আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল। জনপ্রিয় গীতিকার, সুরকার এবং সংগীত পরিচালক। তার অসংখ্য গান শ্রোতাপ্রিয় হয়েছে। দেশের প্রথম শ্রেণির প্রায় সব সংগীতশিল্পীদের নিয়ে তিনি কাজ করেছেন। প্রবীণদের পাশাপাশি কাজ করেছেন নবীনদের সঙ্গেও। অ্যালবাম প্রকাশের পাশাপাশি চলচ্চিত্র-সংগীতেও তার রয়েছে অসামান্য অবদান। এই অঙ্গণে তার শুরুটা হয়েছিল ১৯৭৮ সালে  ‘মেঘ বিজলি বাদল’ সিনেমায় সংগীত পরিচালনার মাধ্যমে। ১৯৮৪ সালে মুক্তি পায় ‘নয়নের আলো’। এ সিনেমার ‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যেখানে’, ‘আমি তোমার দুটি চোখের দুটি তারা হয়ে থাকব’ গানগুলো দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়। কালজয়ী সুরকার ও গীতিকার আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল আজ চলে গেলেন না ফেরার দেশে। তার মৃত্যুতে শিল্পাঙ্গণে বইছে বিষণ্ন বাতাস। ২০১৬ সালের ৮ নভেম্বর রাইজিংবিডির এই প্রতিবেদক তার সাক্ষাৎকার নেন। আলাপচারিতায় তিনি সংগীতের কপিরাইটসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেন। শোকস্তব্ধ এই দিনে তার স্মৃতির প্রতি অতল শ্রদ্ধায় সাক্ষাৎকারটি পুনরায় প্রকাশ করা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রাহাত সাইফুল।

রাহাত সাইফুল : গান চুরির ঘটনা ইদানিং আমাদের দেশে অহরহ ঘটছে। বিষয়টা আপনি কীভাবে দেখছেন?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : আমাদের দেশে ভালো ভালো গান তৈরি হচ্ছে। গান তৈরি হওয়ার পর কপিরাইটের একটা বিষয় থাকে। সকল গানের কপিরাইট করা উচিৎ। শিল্পী, সুরকার, গীতিকার একসঙ্গে এগিয়ে আসে না। এ তিনজন কখনো একত্র হয় না। একটা গান কপিরাইট করতে শিল্পী, সুরকার ও গীতিকারকে একত্র হতে হবে। সমন্বয় করতে হবে। এই সমন্বয়টা হচ্ছে না বলেই গান চুরির ঘটনা অহরহ ঘটছে। এটা অন্যায়।

রাহাত সাইফুল : আপনার লেখা জনপ্রিয় গানসহ অন্যান্য গানগুলো কি কপিরাইট করা হয়েছে?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : ৭১ সাল থেকে এ পর্যন্ত কয়টা গানের কপিরাইট আছে? আমার এতগুলো গানের মধ্যে একটাও কপিরাইট করা নেই। আমার গান নিয়ে যুদ্ধ করার মতো অস্ত্র আমার কাছে নেই। কপিরাইটের পেপার যতক্ষণ পর্যন্ত আমার কাছে না আসবে ততক্ষণ পর্যন্ত যে কোনো মানুষই আমার গান নিয়ে যেতে পারবেন। কেন কপিরাইট করতে পারিনি এই দোষ শুধু আমার একার নয়। এই দোষ শিল্পী, সুরকার ও গীতিকারের। আমার গানের গীতিকার ও সুরকার তো আমিই। আমি এগিয়ে এলেও শিল্পীরা এগিয়ে আসেনি। আমাদের সমন্বয়ের এতো অভাব যে, কপিরাইট করতে পারছি না।
ভারতে প্রতিটি গান কপিরাইট করা হয়। ওরা কপিরাইট ছাড়া গান করে না। ওদের গান কেউ নিলে কোটি কোটি টাকার মামলা হয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের এ দেশে কপিরাইটের বিষয়ে কারো আগ্রহ নেই। যে যেভাবে পারছেন গান করে যাচ্ছেন। ১৬ ডিসেম্বর এলেই দেখবেন সবক’টি টেলিভিশনে চলবে ‘সব কটি জানালা খুলে দাও না’। দেখবেন সেখানে কোথাও সুরকার বা গীতিকারের নাম নেই। কার গান? তার অনুমতি লাগবে কি না? অথবা তাকে পয়সা দিতে হবে কি না- এগুলো নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।

রাহাত সাইফুল : এগুলো বন্ধ করার উপায় কী বলে মনে করছেন?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : এগুলা আমরা বন্ধ করতে পারব না। কারণ আমাদের অধিকার সত্ব নেই, তাই রাইটও নেই।

রাহাত সাইফুল : এ সমস্যার মূল কারণ কী শুধুই সমন্বয়হীনতা?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : আমি হাজার হাজার গান করেছি। এসব গানের মধ্যে দেখা গেছে দুইশ গান জনপ্রিয় হয়েছে। জনপ্রিয় ওই দুইশ গান শিল্পীদের হয়ে যায়। ধরুন, এন্ড্রু কিশোর ‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি’ গানটি গেয়েছেন। ওটা কিশোরের গান হয়ে গেছে। ওটা আমার গান আর নেই। সব সময় সুরকার-গীতিকার পেছনে পরে থাকেন। একটি গান যখন জনপ্রিয় হয় না, তখন দোষ হয় সুরকার–গীতিকারের। আর যখন গানটি জনপ্রিয় হয়ে যায় তখন গানটি শিল্পীর হয়ে যায়। তখন শিল্পী আর কোনো কাগজপত্রে সাইন করেন না। এটা হলো সমস্যা। শিল্পী তখন ওই গান লন্ডন, আমেরিকার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেয়ে বেড়ান। কোটি কোটি টাকা উপার্জন করেন।

রাহাত সাইফুল : মোবাইল কোম্পানি আপনাদের গান ব্যবহার করছেন। সেখান থেকে আপনাদের কী কোনো সম্মানী দেয়া হচ্ছে?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : একটি পয়সাও পাই না। আমি দু’বার মামলা করেছি। দু’বারই হেরেছি। অনুপম কোম্পানির কাছে আমার বারোশ গান আছে। অনুপম একটা অ্যামাউন্ট দিয়েছে যা অবিশ্বাস্য। পরে ওর নামে আমি মামলা করেছি। কোর্ট আমাকে বলে দিয়েছে-এ গান আমার নয়। আমি বলেছি, এ গান আমার, সবাই জানে। অ্যালবামে, সিনেমায় আমার নাম গিয়েছে। আদালত তখন বলেছে- আপনার গান কীভাবে হয়? আপনার কাছে তো কপিরাইট নেই!

রাহাত সাইফুল : আপনার মতো একজন গুণী মানুষ যাকে সারা বাংলাদেশের মানুষ চেনে। আপনি যদি এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন তাহলে অন্যদের অবস্থা কেমন হবে?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : তাদের অবস্থা ওরকম হবে- বয়সকালে মানুষের কাছ থেকে টাকা ধার চেয়ে চিকিৎসা চালাবে। শুধু সমন্বয়হীনতার কারণে এটা হচ্ছে। কপিরাইট করে ফেললে আর কোনো সমস্যা থাকে না। যেকোন গান বিক্রি করলে তার মাত্র পাঁচ বছর বিক্রয় স্বত্ব থাকবে। এরপর যার গান তার হয়ে যাবে। আমার গান ফিল্ম থেকে ক্যাসেট, ক্যাসেট থেকে সিডি, সিডি থেকে ইউটিউব, ইউটিউব থেকে মোবাইল, রিংটোনসহ সব জায়গায় যাচ্ছে কিন্তু আমি লাভবান হচ্ছি না।

রাহাত সাইফুল : আপনার লেখা ও সুর করা জনপ্রিয় গানগুলো আবার নতুন করে গাওয়া হচ্ছে। বিষয়টি জানেন?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : ‘নিয়তি’ সিনেমায় ‘অনেক সাধনার পরে’ গানটি রিমেক করেছে। ওর ভিউয়ার আটচল্লিশ লাখের বেশি হয়েছে। আমি যখন গানটি করেছিলাম তখনও এ রকম বিশ লাখ ইউটিউবে ভিউয়ার পেয়েছিলাম। তখন কোটি মানুষ শুনেছেন। এটা চলবে। আমার মৃত্যুর পরও এ গানগুলো মানুষ শুনবে। কিন্তু কথা হচ্ছে- এই গানটি থেকে তো আমার লাভবান হওয়ার কথা। আমি একটি পয়সা পাই না, আমার পরিবার তো পরের কথা। এই গান কনকচাঁপা, খালিদ হাসান মিলু গেয়েছেন। মিলু তো নেই। কিন্তু কনকচাঁপা তো সাইনটা দিয়ে দিতে পারেন। কনকচাঁপাও তো এগিয়ে আসেননি। আমি তাকেও তো অনুরোধ করেছি। আমি যখন সরকারকে বলব এটা আমার গান তখন এ জন্য শিল্পীর সাইন লাগবে। আর আমার গানের সুরকার ও গীতিকার আমি নিজেই। এ কাজটি আমি করতে পারিনি। আমি সারা বছর গান সুর করেছি এবং লিখেছি। আর শিল্পী গেয়েছেন। আমার গানের সুরকার আলাদা নেই। আমি যেহেতু কপিরাইট করতে পারিনি আর অন্য কেউ করবে তা ভাবা খু্ব কঠিন।

রাহাত সাইফুল : বর্তমান সময়ের গানগুলো বাজারে আসার কিছুদিন পরই হারিয়ে যাচ্ছে কেন?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : বর্তমানে একজন তরুণ-তরুণী একটা গান করে লাভবান হবে, সেটা একেবারেই হচ্ছে না। পয়সা খরচ করে কিছুই পায় না তারা। ইউটিউব অথবা টেলিভিশনে প্রচার চালিয়ে তারা পরিচিতি পায়। এরপর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেয়ে টাকা পায়। অনুষ্ঠান করে অল্প যে টাকা পায় তা দিয়ে জীবনযাপন করে। আর এটাই এখন তাদের জীবনের লক্ষ্য। আগে কোনো গান একটু জনপ্রিয় হলেই ঘরে ঘরে শোনা হতো। একটা গান থেকে অনেক টাকা পেতো। এখন শিল্পীদের স্বপ্ন হচ্ছে, একটা গান নিজের টাকা দিয়ে করে, ভিডিও নির্মাণ করে ‘গানবাংলা’ অথবা ইউটিউবে চালাবে। মানুষ দেখে তাদেরকে চিনবে এবং অনুষ্ঠানে ডাকবে। এছাড়া আর কিছু হচ্ছে না।

রাহাত সাইফুল : প্রযুক্তির উন্নয়নের কারণে মেধা ও কণ্ঠ হারিয়ে যাচ্ছে। এখন আর গান নিয়ে তেমন কাউকে সাধনা করতে দেখা যায় না- বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : হ্যাঁ, এটা সত্যি কথা। প্রযুক্তির এতটাই উন্নতি হয়েছে যে, আমাদের আগের যে সাধনার জায়গা ছিল তা হারিয়ে গেছে। আগে আনেক কিছু জানতে হতো। শিখতে হতো। আর এখন বসে বসে কম্পিউটারের কী বোর্ড টিপে মিউজিক করে ফেলে। এতে করে গান লেখার মেধা, মিউজিক করার মেধা, সুর করার মেধা হারিয়ে যাচ্ছে। গানগুলো কৃত্রিম হয়ে যাচ্ছে। আগে কত সাধনা করতে হতো। তারপর একটি সুন্দর গান হতো। যন্ত্রের অধিক ব্যবহারের কারণে গানের ক্ষতি হচ্ছে।

রাহাত সাইফুল : বর্তমান সময়ে আপনার ব্যস্ততা সর্ম্পকে জানতে চাই।
আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল : যে কাজগুলো করছি তা এখনই বলতে চাচ্ছি না। এক থেকে দেড় বছর পর বিষয়টি সবাই জানতে পারবেন। তবে কাজ করে যাচ্ছি এতটুকুই। সিনেমার গানের কাজ ফিরিয়ে দিচ্ছি। আসলে কাজ করার খুব একটা সময়ও পাচ্ছি না।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ জানুয়ারি ২০১৮/রাহাত/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়