ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত চান্দিনা

গাজী মুনছুর আজিজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৪৮, ২৫ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত চান্দিনা

গাজী মুনছুর আজিজ: একাত্তরের ২৭ জুন কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলার অলিপুর গ্রামে চার মুক্তিযোদ্ধা ও মধ্যগ্রামের মন্দির প্রাঙ্গণে পাঁচ মুক্তিযোদ্ধাকে পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করে। পুকুরপাড়ে চারজনকে এক সারিতে দাঁড় করানো হয়। তারপর পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করা হয় সবাইকে। এ হত্যাযজ্ঞ ঘটে অলিপুর গ্রামের দর্জি বাড়ির দক্ষিণে ডাক্তার বাড়ির পুকুরের উত্তর পাশে। চার শহীদের সেই স্মৃতিবিজড়িত জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম। সঙ্গে আছেন বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ চান্দিনা উপজেলা কমান্ডের সহকারী কমান্ডার আলী আকবর দর্জি এবং এই হত্যাযজ্ঞের প্রতক্ষ্যদর্শী সুহিলপুরের মোজাফফর হোসেন। মূলত আলী আকবর দর্জির আমন্ত্রণেই ডিসেম্বরের এক দুপুরে এখানে আসা। উদ্দেশ্য চান্দিনার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো ঘুরে দেখা।

অলিপুর গ্রামের চার মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার দৃশ্য দূর থেকে দেখেছেন মোজাফফর হোসেন। তিনি বলেন, তখন আমি কেবল বুঝতে শিখেছি। বর্ষাকাল হওয়াতে চারপাশ পানিতে থৈ থৈ করছে। একা মাছ ধরার জন্য বের হয়েছি। দুইটা কি আড়াইটা বাজে। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। দেখি একটি নৌকায় করে কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য চারজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে আসে। তারপর পুকুরের পাড়ে পূব দিকে ফিরে সবাইকে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে গুলি করে। গুলি খেয়ে সবাই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে লাশগুলো পাকিস্তানিরা পানিতে ভাসিয়ে দেয়। পরে জেনেছি তাদেরকে ইলিয়টগঞ্জ থেকে ধরে আনা হয়েছিল। আলী আকবর দর্জি বলেন, এখানে হত্যা করা চার মুক্তিযোদ্ধার নাম-ঠিকানা বা পরিচয় আমাদের জানা নেই। লাশগুলোও তখন পানিতে ভেসে গেছে। তবে স্মৃতিচিন্থ আছে। আর এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা এখানকার অনেক বয়স্ক লোকই জানেন। আমি এ রাস্তা দিয়েই বাড়িতে যাতায়াত করি। তাই যখন পুকুর পাড় দিয়ে হাঁটি, তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে অজানা সেই চার শহীদের মুখচ্ছবি। ইচ্ছে আছে এ চার শহীদের স্মরণে পুকুর পাড়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ব, যার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম এ চার শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধের কথা জানতে পারে।

পুকুর পাড় থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা আসি মধ্যগ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দির প্রাঙ্গণে। নির্জন এ মন্দির প্রাঙ্গণেও পাকিস্তানিরা গুলি করে হত্যা করে পাঁচ মুক্তিযোদ্ধাকে। আজও জানা যায়নি শহীদের পরিচয়। মুক্তিযোদ্ধাদের গুলি করে হত্যার দৃশ্য দূর থেকে দেখেছেন সুহিলপুর গ্রামের সলিম মিয়া। তিনিও আমাদের সঙ্গী হয়েছেন। তিনি বলেন, তখন আমার বয়স খুব বেশি হবে না। কেবল বুঝতে শিখেছি। জুন বা জুলাই মাস হবে। বর্ষার পানিতে গ্রামের অনেক স্থানই পানিতে তলিয়ে। তবে মন্দিরের জায়গাটি উচুঁতে ছিল। বেলা তিনটা বা চারটার সময়। আমি কোনো একটা কাজে ঘর থেকে বের হয়েছি। দেখি কয়েকজন পাকিস্তানি পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নৌকায় করে নিয়ে এসেছে। তারপর গুলি করে হত্যা করে তাদের। লাশগুলো এখানেই পঁচে-গলে ভেসে যায় বর্ষার পানিতে। তখন গ্রামে মানুষ কম ছিল। আর পাকিস্তানিদের ভয়ে খুব একটা ঘর থেকে বেরও হতো না। তাই লাশের ধারে তেমন কেউ আসেনি। শুনেছি তাদেরকে ইলিয়টগঞ্জ থেকে ধরে আনা হয়েছিল। আলী আকবর দর্জি বলেন, এ পাঁচ মুক্তিযোদ্ধার নাম-ঠিকানাও আমরা এখনও জানতে পারিনি। তবে এ গ্রামের বয়স্ক অনেক মানুষই জানেন। মন্দিরের পাশ দিয়ে যাতায়াতের সময় অজানা এ পাঁচ শহীদের কথাও মনে পড়ে। নতুন প্রজন্ম ও স্থানীয় মানুষের কাছে এ পাঁচ শহীদের কথা তুলে ধরতে আমরা এখানেও স্মৃতিস্তম্ভ করার উদ্যোগ নিয়েছি।

 



মধ্যগ্রাম থেকে হাঁটতে হাঁটতে আমরা সামনে এগোই। গাছগাছালি ছায়া মেঠোপথ। গাছে কয়েক প্রজাতির পাখির দেখা পাই। পথের একপাশে বিস্তৃর্ণ জমিন। এ জমিনের কিছু অংশে পনি আছে। আর কিছু অংশে লাগানো হয়েছে ধান। পানির অংশে মাছ চাষ করা হয়েছে। পথের অন্যপাশের কিছু কিছু জমিনেও সদ্য ধান লাগানো হয়েছে। আবার কিছু জমিন এখন খালি। আলী আকবর দর্জি জানান এ অঞ্চল মূলত প্লাবনভূমি। এ প্লাবন ভূমিতে বর্ষা মৌসুমসহ বছরের কিছু সময় মাছ চাষ করা হয়। বাকি সময় চাষ হয় অন্য ফলস।

শীতের মাঝামাঝি হওয়াতে এখন মাছ চাষের শেষ মৌসুম। তাই কিছু প্লাবন ভূমিতে মছ ধরা হচ্ছে। আলী আকবর দর্জি জানান তিনিও প্লাবন ভূমির মাছ চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়