ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

‘কাউকে অন্য এলাকায় পেলে মার দিত’

মামুন খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:২০, ২২ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘কাউকে অন্য এলাকায় পেলে মার দিত’

মামুন খান : ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ যেমন ডিসকো বয়েজ উত্তরা, নাইন স্টার গ্রুপ, সেভেন স্টার গ্রুপ, নাইন এমএম বয়েজ উত্তরা, বিগবস ইত্যাদি পেইজ খুলে নিজেদের বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করত। গ্রুপের মধ্যে কেউ এক গ্রুপ থেকে অন্য গ্রুপে চলে যাওয়াকে কেন্দ্র করে কিংবা কোন বকা-ঝকাকে কেন্দ্র করে ছোট-খাট ঝগড়া/মারামারি হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে এলাকায় বিভেদ সৃষ্টি হলে কাউকে অন্য এলাকায় একা পেলে তাকে মারপিট করে। আর এরই জের ধরে রাজধানীর উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরে স্কুলছাত্র আদনান খুন হয়।

সম্প্রতি ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে আদনান হত্যা মামলায় দেওয়া চার্জশিটে এমনই উল্লেখ করেছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উত্তরা-পশ্চিম থানার পুলিশ পরিদর্শক মুহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক।

আদনান হত্যায় ২৩ জনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দাখিল করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। এতে ১২ জনকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়েছে।

চার্জশিটভূক্ত আসামিরা হলেন সাদাফ জাকির (১৬), মো. রায়হান ইসলাম জিহান (১৪), নাফিজ মো. আলম ওরফে ডন (১৭), খন্দকার মেহরাব হোসেন (১৫), সাফিন হোসাইন (১৬), মারসাতুল রহমান রাব্বি (১৬), জাহিদুল ইসলাম জুইস (১৭), হাসিবুল হক শিশির (১৬), আল আমিন তুষার (১৫), রাজিন আহমেদ হৃদয় (১৭), ফকরুল ইসলাম ওরফে শ্রাবণ (১৫), শাকিল সরকার (১৭), করিম মিয়া (১৬), সাদ বিন সাত্তার ওরফে ডিস্কো সাদ (১৭), নাইমুর রহমান অনিক (১৯), শাহরিয়ার বিন সাত্তার ওরফে সেতু (২২), রবিউল ইসলাম ওরফে সিয়াম খান (১৮), আক্তারুজ্জামান ছোটন (১৯), রনি মৃধা (২০), মো. সোহাগ (১৯), বাহাউদ্দিন হাসান শাওন (১৯), স্বপন মন্ডল ওরফে পটলা বাবু (২৪) ও নুরে আলম (১৯)।

আসামিদের মধ্যে প্রথম ১৪ জন অপ্রাপ্ত বয়স্ক। তাদের বিচার কিশোর আদালতে হবে। আর শেষের ৯ জন প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ায় তাদের বিচার প্রকাশ্য আদালতে হবে।

যাদের অব্যাহতির আবেদন করা হয়েছে তারা হলেন শাহীনুর রহমান (১৮), সেলিম খান (২৩), ইব্রাহিম হোসেন সানি (২৮), মিজানুর রহমান সুমন (২২), নাজমুস সাকিব, ফয়সাল, আসিফ, সুমন, আরিফ, শাহীনুর রহমান ( ১৮), সেলিম খান (২৩) ও খন্দকার শুভ।

এদের মধ্যে প্রথম চার জনের বিরুদ্ধে মামলার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে কোন সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আর নাজমুস সাকিব ঘটনার তারিখে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিল। ফয়সাল, আসিফ, সুমন, আরিফের বিরুদ্ধে ঘটনার অভিযোগ প্রমাণিত হলেও নাম-ঠিকানা পাওয়া যায়নি। নাম-ঠিকানা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দাখিল করা হবে।

চার্জশিটে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘আদনান কবির উত্তরার ট্রাস্ট স্কুল এন্ড কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র ছিল। বৃহত্তর উত্তরায় অবস্থিত স্কুল সমূহে উত্তরা এলাকা, টঙ্গি ও আশপাশ এলাকার ছাত্র-ছাত্রী পড়াশোনা করাকালে, স্কুলে ছাড়াও তারা বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে গ্রুপ ব্যাচে কোচিং করতো। এরই মাঝে নিজেদের মধ্যে ছোটখাট ভুল বোঝাবুঝি, হাতাহাতি ও ছোটখাটো বিষয়কে কেন্দ্র করে বিভিন্ন গ্রুপের সৃষ্টি হয়। মুলত তারা প্রথম দিকে একসঙ্গে খেলাধুলা করত ও গ্রুপ ব্যাচে কোচিং/ক্লাশ শেষে আড্ডা দিত। পড়ে তারা ফেসবুকের মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ-এর পেইজ খুলে নিজেদের বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করত। এভাবেই ফেসবুকের পেইজে ডিসকো বয়েজ উত্তরা, নাইন স্টার গ্রুপ, সেভেন স্টার গ্রুপ, নাইন এমএম বয়েজ উত্তরা, বিগবস ইত্যাদি গ্রুপের নামে প্রকাশ করে। নাইন স্টার ও সেভেন স্টার গ্রুপের নেতৃত্ব দেয় রাজু ওরফে তালাচাবি রাজু ও মাসুদ। অপর দিকে ডিসকো বয়েজ উত্তরা, নাইন এমএম বয়েজ উত্তরা, বিগবস-এর নেতৃত্ব দেয় সেতু, অনিক ও ছোটন। ’

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রুপে যেমন উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান যেমন রয়েছে, তেমনি স্কুলে ঝড়ে পড়া/ভাসমান ঘরের বখাটে সন্তানরাও রয়েছে। প্রত্যেক গ্রুপের ছেলেদের বয়স আনুমানিক ১৩-২২ বছর হবে। তাদের মধ্যে কেউ এক গ্রুপ থেকে অন্য গ্রুপে চলে যাওয়াকে কেন্দ্র করে কিংবা কোন বকাঝকাকে কেন্দ্র করে ছোটখাট ঝগড়া/মারামারি হয়। পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে এলাকায় বিভেদ সৃষ্টি হলে কাউকে অন্য এলাকায় একা পেলে তাকে মারপিট করে। ওই সকল ঘটনাকে কেন্দ্র করে থানায় কয়েকটি মামলা দায়ের হয় এবং আসামিদের গ্রেপ্তার করে চালানও দেওয়া হয় এবং প্রত্যেকের অভিভাবককে সতর্কও করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘গ্রুপিং-এর জের ধরে ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি নাইন স্টার গ্রুপের লিডার তালাচাবি রাজু ও অন্যদের মারার করার উদ্দেশ্যে ডিস্কো গ্রুপ ও বিগবস গ্রুপের প্রায় ৩০/৩৫ জন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে উত্তরা, টঙ্গী, উত্তরখান, দক্ষিণখান এলাকা থেকে উত্তরা ৯ নং সেক্টরে একত্রিত হয়। সেখানে আসামি পটলা বাবুর সঙ্গে ডিস্কো গ্রুপের অনিক ও সেতু নাইন স্টার গ্রুপের ওপর হামলার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী উত্তরা ৯নং সেক্টর হতে জমজম টাওয়ারের পেছন দিয়ে উত্তরা ১৩ নং সেক্টরের ১২ নং রোড হয়ে পার্কের পশ্চিম পাশ দিয়ে অগ্রসর হয়। ৬ জানুয়ারি বিকেলের দিকে ১৩ নং সেক্টরে ৫ নং রোডে ৪৫ নং বাসার ছাদে ভিকটিম আদনান ও তার বন্ধু আনাছ, আবরার, সাগর, রাজিন, নাইমুর, আনাছের বোন মুনা গল্প করছিল এবং মোবাইল ফোন সেটে গেমস খেলছিল। মোবাইল ফোনসেটে গেমস খেলা শেষে ব্যাটমিন্টন খেলার জন্য বাসার নিচে নামে তারা। তখন মুনার কাছে সবাই পুরি খেতে চায়। তারা বাসার কাছেই পুরির দোকান থেকে পুরি কিনে এবং খেতে খেতে ১৬ নং রোডের দিকে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। মুনা পুরির দোকানে দাম দেয়ার জন্য থেকে যায়। সন্ধ্যা ৬টার দিকে আনাছ, আদনান, আবরার, সাগর, রাজিন, নাইমুরকে ১৬ নং রোডের দিকে যেতে দেখে ডিস্কো গ্রুপের অনিক ও সেতু ধর ধর বলে তাদের ধাওয়া করে। তখন আনাছ, আবরার, সাগর, রাজিন, নাইমুর ভয়ে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করে পালিয়ে যায়। মুনার ডাক-চিৎকার শুনে দ্রুত তার ভাইকে রক্ষা করার জন্য অজ্ঞাত ব্যক্তির রিক্সাযোগে ঘটনাস্থলের দিকে রওনা হয়। আদনান ১৭ নং রোডের দিকে পালিয়ে যাওয়ার সময় উত্তরা-পশ্চিম থানাধীন ১৩ নং সেক্টরে ১৭ নং রোডের ১৫ নং বাড়ির সামনে ডিস্কো গ্রুপের লিডার অনিক, সেতু, সাদাফ, জিহান, নাফিজ, মেহেরাব, রনি, ছোটন, জুইস, রবিউল, সাদ, সাফিন, শ্রাবণ, শাওন, তুষার, করিম, নূরে আলম, শাকিল, সোহাগ, শিশির, রাজিন, স্বপন, মারসাদ, আসিফ, সুমন, আরিফ , ফয়সাল ও অন্যান্য আসামি হকিস্টিক, চাকু, চাপাতি, বেইসবল ব্যাট, লাঠি ইত্যাদি অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কারও কাঁধে ব্যাগসহ আদনানের পথরোধ করে। জিহানের হাতে থাকা হকিস্টিক দিয়ে আদনানের মাথায় আঘাত করা হলে সে রাস্তায় পড়ে যায়। পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জিহান আদনানের পিঠে পুনরায় আঘাত মারলে হকিস্টিক ভেঙে যায়। তখন সেতুর হাতে থাকা হকিস্টিক দিয়ে পেটাতে থাকে। সাদাফের হাতে থাকা ছুরি দিয়ে আদনানকে আঘাত করা। সাদ সুইচ চাপ দিয়ে আদনানের বাম হাতের বাহুতে ছুরি চালায়। সোহাগের হাতে থাকা স্ত্রু ড্রাইভার জাতীয় হাতুড়ী দিয়ে আদনানকে মারতে থাকে। এক পর্যায়ে ডিস্কো গ্রুপের সবাই আদনানকে ঘেরাও করে শাকিল, নূরে আলম, করিম আদনানকে লাথি মারতে থাকে। নাফিজ বেইসবলের ব্যাট দিয়ে আদনানকে পেটায় এবং অনিক, জুইস, রনি, রবিউল মিলিত হয়ে চাকু ও চাপাতি দিয়ে কোপায়। আদনানের পিঠের ডান পাশে একাধিক আঘাত, মাথার ওপর কোপের আঘাত, ডান হাতের কব্জির ওপরে কোপের আঘাত, কোমরের ওপরে কোপের আঘাতসহ সারা শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাত করে গুরুতর রক্তাক্ত জখম করে ফেলে। তারা ১৭ নং রোডের পূর্ব পাশে এসে পার্কের পশ্চিম পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে যায়। পরে মুনা ১৩ নং সেক্টর ১৭ নং রোডের ১৫ নং বাড়ির সামনে এসে জনৈক পিঠা বিক্রেতা ফাতেমা বেগমের সহায়তায় রিক্সা যোগে গুরুতর জখম আদনানকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার সময় ট্রাস্ট কলেজের সামনে আসামিরা তাদের দেখে স্লোগান দেয়। মুনা আদনানকে লুবানা হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’

আদনানের বাবা এই মামলার বাদী কবির হোসেন বলেন, ‘ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদের বিরুদ্ধে পুলিশ চার্জশিট দাখিল করেছে। এতে আমি সন্তুষ্ট। আমি সুষ্ঠু বিচার চাই।’ মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যেন দ্রুত নিষ্পত্তি হয় এ দাবি জানান তিনি।

আদনান নিহতের ঘটনায় তার বাবা কবির হোসেন ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি রাজধানীর উত্তরা-পশ্চিম থানায় মামলাটি দায়ের করেন।

মামলায় তিনি অভিযোগ করেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে নাইন স্টার গ্রুপ ও ডিসকো বয়েজ গ্রুপের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৩ জানুয়ারি উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ব্রিজের ওপর ডিসকো বয়েজ ও বিগবস গ্রুপের সদস্যরা নাইন স্টার গ্রুপের দলনেতা রাজুকে মারধর করে। প্রতিউত্তরে গত ৫ জানুয়ারি আজমপুর ফুটওভার ব্রিজের গোড়ায় নাইন স্টার গ্রুপের সদস্যরা বিগবস গ্রুপের ছোটনের ওপর হামলা চালায়। এরপর থেকেই রাজুকে হত্যার পরিকল্পনা করে ডিসকো গ্যাং ও বিগবস গ্রুপের সদস্যরা। এরই ধারাবাহিকতায় ৬ জানুয়ারি উত্তরা পশ্চিম থানা এলাকার ১৩ নম্বর সেক্টরের ১৭ নম্বর রোডের ১৫ নম্বর বাড়ির সামনে আদনান কবিরকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ এপ্রিল ২০১৯/মামুন খান/শহানেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়