ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ক্ষমা কিভাবে করবেন?

এস এম গল্প ইকবাল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:৩১, ১ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ক্ষমা কিভাবে করবেন?

প্রতীকী ছবি

এস এম গল্প ইকবাল : ড. রবার্ট এনরাইট হচ্ছেন ক্ষমা করার বৈজ্ঞানিক গবেষণার অগ্রদূত। তার চার ধাপের ক্ষমা মডেল আন্তরিকতার সঙ্গে ক্ষমা প্রদর্শনের মাধ্যমে অসংখ্য মানুষকে উদ্বেগ, বিষণ্নতা ও অপমানবোধ কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করেছে।

রিডার্স ডাইজেস্টে প্রকাশিত প্রতিবেদনে যে কাউকে কোনো কিছুর জন্য সত্যিকার অর্থে ক্ষমা করার পদক্ষেপ আলোচনা করা হয়েছে।

* জেনে রাখুন যে সবাই ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য
প্রত্যেকেরই এমন কেউ থাকেন যিনি তাদের সঙ্গে ঘৃণিত ব্যবহার করেন, যেমন- পিতামাতা- যারা তাদের অগ্রগতিকে উপেক্ষা করেন, স্বামী বা স্ত্রী- যিনি সমস্যাপূর্ণ সম্পর্কের মাধ্যমে তাদেরকে প্রতারিত করেন, অথবা এমন ব্যক্তি- যিনি তাদের কোনো পরিকল্পনার সামনে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ান। এ ধরনের অন্যায় আচরণ দীর্ঘস্থায়ী অভ্যন্তরীণ ক্ষতি করে না, কিন্তু অবসাদ, ঘুমের ব্যাঘাত, উদ্বেগ, বিষণ্নতা এবং অন্যান্য অসুস্থ ধরনের ক্রোধের উদ্রেক করতে পারে। তারা এমন অন্যায় আচরণ করলে এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, ক্ষমা একটি অপশন বা তাদেরকে ক্ষমা করা যেতে পারে। আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন দ্বারা প্রকাশিত ‘ফরগিভনেস ইজ অ্যা চয়েজ’ এর লেখক এবং সাইকোলজিস্ট রবার্ট এনরাইটের মতে, ‘যখন আমরা খুব অন্যায়ভাবে অন্যদের আচরণের সম্মুখীন হব, এসব ডিল করার জন্য বিকল্প হিসেবে ক্ষমা বেছে নেওয়া উচিত যাতে এসব অন্যায় আচরণের প্রতিক্রিয়া আমাদের ওপর অসুস্থ উপায়ে প্রভাব বিস্তার না করে।’ ক্ষমা করার পথ বেছে নেওয়ার জন্য আপনার মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এটি এমন কিছু যা আপনি নিজে নিজে অর্জন করতে পারেন, যদি জানা থাকে যে কোন পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে।

* সিদ্ধান্ত নিন যে আপনি ক্ষমা করতে চান
ক্ষমা করার গুণ অর্জন করার প্রথম ধাপ হচ্ছে, এটি এমন কিছু যা প্রকৃতপক্ষে আপনি বেছে নিতে চান তার সিদ্ধান্ত নেওয়া, কিন্তু এটি এমন বিষয় নয় যে কেউ ক্ষমা করার জন্য চাপ দিচ্ছে। এনরাইট বলেন, ‘মানুষকে ক্ষমা করতে বাধ্য করা উচিত নয়। আমি মনে করি, এটা গুরুত্বপূর্ণ যে মানুষ এটির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে।’ এনরাইট জোর দিয়ে বলেন যে, ক্ষমার মানে কোনো অন্যায় দোষ থেকে মুক্তি দেওয়া নয় বা কোনো অন্যায় ভুলে যাওয়া নয়, অথবা এমন কোনো সম্পর্কে ফিরে যাওয়া নয় যা অশুভ।’ তিনি বলেন, ‘কিছু লোক ক্ষমার অর্থকে ভুলভাবে বোঝে এবং বলে যে আমি যদি ক্ষমা করি, তাহলে আমি সুবিচার পাব না।’ এটি ক্ষমার বড় একটি সমালোচনা যা সত্য নয়।

* একটি তালিকা তৈরি করুন
প্রারম্ভিক এই ধাপ দিয়ে ক্ষমার প্রক্রিয়া শুরু করুন: যেসব লোকেরা আপনাকে আঘাত করেছে বা কষ্ট দিয়েছে অথবা আপনার ক্ষতি করেছে তাদের একটি তালিকা তৈরি করুন, আঘাত বা কষ্ট বা ক্ষতি ছোট হোক বা বড় হোক তা কোনো ব্যাপার নয়, শৈশবে ফিরে যান। এরপর সবচেয়ে কম অন্যায় আচরণকারী ও ক্রোধ উদ্রেককারী নাম থেকে সর্বোচ্চ অন্যায় আচরণকারী ও ক্রোধ উদ্রেককারী নাম পর্যন্ত ক্রমবিন্যাস করুন। তালিকার সবচেয়ে নিচের নামটি থেকে ক্ষমার প্রক্রিয়া শুরু করুন অর্থাৎ সর্বোচ্চ ক্রোধ উদ্রেককারী ব্যক্তিকে ক্ষমার মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শুরু করুন অথবা তাদেরকে ক্ষমার মাধ্যমে এ প্রক্রিয়া শুরু করুন যারা আপনাকে এখনো কষ্ট দিচ্ছে বা বিব্রত করছে যা প্রীতকরও নয় বিপর্যয়করও নয়। তালিকার সবচেয়ে নিচের নাম থেকে উপরের নাম পর্যন্ত এ প্রক্রিয়া রিপিট করলে আপনার ক্ষমা করার মানসিকতা বেড়ে যাবে এবং আপনি সেসব ব্যক্তিদের আরো ভালোভাবে মোকাবেলা করতে সক্ষম হবেন যারা আসলেই আপনাকে কষ্ট দিয়েছে বা দিচ্ছে।

* আপনার ক্রোধ আবিষ্কার করুন
এটি হচ্ছে এনরাইটের ক্ষমা মডেলের প্রথম ধাপের অফিসিয়াল স্টার্ট এবং এটি ক্ষমার গুরুত্ব বাড়ানোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এনরাইটের মতে, ‘এটি একপ্রকার চেকলিস্ট।’ আপনার ক্রোধের পরিপ্রেক্ষিতে আপনি কি করছেন? আপনি কিভাবে এটিকে প্রত্যাখ্যান করেছেন? আপনার ক্রোধের শারীরিক প্রতিক্রিয়া কি ছিল? এনরাইটের মতে, সবচেয়ে কমন শারীরিক পীড়া হচ্ছে ক্লান্তি এবং হতাশাপূর্ণ বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে কাউকে বিশ্বাস করতে না পারা অথবা প্রত্যেকে নিজের স্বার্থে কাজ করছে। এনরাইট বলেন, ‘আপনি একবার এসব প্রতিক্রিয়ার দিকে তাকালে প্রশ্ন দেখা দেবে- আপনি কি আরোগ্য হতে চান? কোন জিনিসটি ক্ষমার সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য আমাদেরকে দ্বিতীয় ধাপে নিয়ে যায়?’

* ক্ষমার অঙ্গীকার করুন
দ্বিতীয় ধাপ হচ্ছে, ক্ষমার সংজ্ঞা পুনরায় বোধগম্য করা এবং এটির প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হওয়া। এই সংজ্ঞা হচ্ছে তাদের প্রতি ভালো মনোভাব পোষণ করা যারা আপনার প্রতি ভালো আচরণ করেনি। এনরাইট বলেন, লোকেরা একবার প্রথম ধাপ সম্পূর্ণ করলে এবং তাদের ক্রোধের প্রতিক্রিয়া কিভাবে তাদের অসুখী করছে তা বুঝতে পারলে তাদের মধ্যে ক্ষমা করার প্রবণতা আসবে।’ দ্বিতীয় ধাপের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার হচ্ছে যাদেরকে আপনি ক্ষমা করতে যাচ্ছেন তাদের ক্ষতি না করা। এনরাইট বলেন, ‘এর মানে এই নয় যে আপনি তাদের ভালো করছেন। এটি কেবল নেতিবাচক কোনোকিছু না করা বোঝায়।’

* অন্যের কষ্ট বিবেচনা করুন
এই ধাপ ক্ষমা মডেলের ‘কাজ’ ধাপ শুরু করে। এর লক্ষ্য হচ্ছে, অন্য ব্যক্তির জন্য চুড়ান্তভাবে দয়া অনুভব করা, কিন্তু এভাবে শুরু করবেন না। এর পরিবর্তে তাদের সম্পর্কে নতুন উপায়ে চিন্তা করুন। লোকটি কিভাবে আপনাকে কষ্ট দিয়েছে? কিভাবে তারা অন্যায় আচরণ করেছিল? তারা কি কষ্ট পেয়েছিল, যে কারণে তারাও আপনাকে কষ্ট দিয়েছে? এনরাইট বলেন, ‘আমরা তাদের কাজকে দোষারোপ করার জন্য নিজেদেরকে এসব প্রশ্নগুলো করি না। কিন্তু সমালোচনার যোগ্য ব্যক্তিটিকে পর্যবেক্ষণ করে দেখলে হয়তো বুঝতে পারবেন যে তিনি বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। তিনিও তো আপনার মতো মানুষ যিনি অভ্রান্ত ও সর্বশক্তিমান নন।’

* অন্যের মনুষ্যধর্ম বিবেচনা করুন
এখন আপনি যে ব্যক্তির কষ্ট মূল্যায়ন করেছেন তার মনুষ্যধর্ম বিবেচনা করুন। এনরাইট বলেন, ‘আপনারা উভয়েই জন্মগ্রহণ করেছেন, আপনারা উভয়েই মৃত্যুবরণ করবেন, আপনারা উভয়েই কর্তিত হলে রক্তপাত হয়, আপনাদের উভয়েরই ইউনিক ডিএনএ আছে এবং আপনারা মারা গেলে আপনাদের মতো অন্য ব্যক্তি হবে না।’ এবার চিন্তা করুন যে আপনার মতো মানুষের বৈশিষ্ট্য সম্বলিত লোকটিকে ক্ষমা করবেন কিনা।

* অন্যের প্রতি কোমলতা অনুভব করুন
অন্যের প্রতি কোমলতা অনুভব করুন। এতে ক্রোধ নিবারণে কয়েক সপ্তাহ বা কয়েক মাস লেগে যেতে পারে। এভাবে আপনার অনুভূতির পরিবর্তন হলে আপনি অসুস্থ ক্রোধ থেকে রেহাই পেতে পারেন। এনরাইট বলেন, অন্যের প্রতি কোমলতা অনুভব হচ্ছে, দয়ার ক্ষীণালোক বা সামান্য একটি অংশ।

* পেইন সহ্য করুন
আপনি একবার কোমলতা অনুভব করা শুরু করলে, পরের ধাপ হবে পেইন বা কষ্ট সহ্য করা। এনরাইট বলেন, ‘আমরা লোকদেরকে পেইন থেকে পরিত্রাণ পেতে বলছি না, আমরা এটি বহন করতে বলছি।’ এর মানে এই নয় যে আপনার পেইন অন্যদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছেন। এনরাইটের মতে, ‘এটি আপনার মধ্যে আত্মমর্যাদাবোধ তৈরি করে।’ যারা আপনাকে পেইন দিয়েছে তারা আপনার মনুষ্যধর্ম দেখতে না পেলে এবং আপনার কোমল হৃদয় বুঝতে না পারলে আপনিও তাদের মতো আচরণ করবেন? তা করলে আপনার ব্যক্তিত্ব থাকল কোথায়?

* পেইন প্রদানকারী ব্যক্তিকে উপহার দিন
আমরা এটা বোঝাচ্ছি না যে, আপনার একসেট ক্যান্ডেল কিনে উপহার দেওয়া উচিত। কিন্তু এনরাইট সৃজনশীল উপায়ে বা অন্য কোনো উপায়ে পেইন প্রদানকারী ব্যক্তিদের জন্য ভালো কিছু করার জন্য উৎসাহিত করছেন। তিনি বলেন, ‘যদি পেইন প্রদানকারী ব্যক্তি আপনার জন্য বিপজ্জনক হয়, তাহলে আপনার তাদেরকে জানাতে হবে না যে আপনি এটা করছেন।’ তিনি যোগ করেন, ‘আপনি তাদের নামে চ্যারিটিতে অর্থ ডোনেট করতে পারেন, তাদের কাছে একটি ইমেইল পাঠাতে পারেন, এবং এমনকি আপনি তাদের সরাসরি দেখলে তাদেরকে হাসি বা ভালো শব্দ উপহার দিতে পারেন।’ এরকম করার মানে এই নয় যে, আপনি তাদের সঙ্গে ইন্ট্যারঅ্যাক্ট বা মিটমাট করার চেষ্টা করছেন, এটি শুধুমাত্র তাদের প্রতি আপনার ভালো মনোভাবের জানান দেওয়া।

* ডিসকভারি বা উদঘাটন ধাপ শুরু করুন
এটি হচ্ছে ক্ষমা মডেলের চতুর্থ এবং শেষ ধাপ। এ ধাপে আপনি উদঘাটনের চেষ্টা করবেন আপনি কি সাফার বা ভোগ করেছেন। এনরাইট বলেন, ‘সাধারণত মানুষেরা তাদের পেইন বা কষ্ট সম্পর্কে বেশি সচেতন থাকে। তারা খারাপ দিন অতিবাহিত করা ব্যক্তিদের সঙ্গে অবস্থান করলে আরো বেশি ধৈর্য্যশীল হয়ে ওঠেন, তারা দেখেন যে লোকেরা পেইন নিয়ে সবসময় আশপাশে চলাফেরা করছেন এবং তারা সাধারণত অন্যদের পেইন সম্পর্কে অধিক সচেতন হয় ও ভালোর জন্য ভূমিকা রাখতে চায়।’ আপনি একবার বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গি পেয়ে থাকলে জীবনে আবার উন্নতিলাভ করতে শুরু করবেন।

* রিপিট, রিপিট, রিপিট
সবচেয়ে বেশি পেইন প্রদানকারী ব্যক্তিকে ক্ষমা করার মাধ্যমে আপনি এ প্রক্রিয়া শুরু করতে না চাইলে, আপনি যাদের ক্ষমা করতে চান তাদের প্রত্যেকের ওপর এ প্রক্রিয়া রিপিট করা উচিত। এনরাইট এ প্রক্রিয়ায় সফল হওয়ার জন্য কোনো জার্নাল রাখতে অথবা কোনো বিশ্বস্ত বন্ধু বা পরিবারের সদস্যের সমর্থন বা সাহায্য নেওয়ার পরামর্শ দেন। ১৫ মিনিট করে সপ্তাহে কয়েকবার এ প্রক্রিয়া রিপিট করুন। এটি কোয়ান্টিটির চেয়ে কোয়ালিটি নির্ভর একটি প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়া আরম্ভ করার পূর্বে আপনি ক্ষমার মহত্ব সম্পর্কে অধ্যয়ন করতে পারেন।

তথ্যসূত্র : রিডাসর্ড ডাইজেস্ট



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ ডিসেম্বর ২০১৭/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়