রিয়া এখন পৌর মেয়রের বাড়িতে
পাবনা প্রতিনিধি : রিয়া এখন সুজানগর পৌর মেয়র আলহাজ্ব আব্দুল ওহাবের বাড়িতে। এখান থেকেই শুরু হলো রিয়ার জীবনের নতুন অধ্যায়।
পুরো নাম রিয়া খাতুন (১২)। সুজানগর উপজেলার চিনাখড়া উচ্চ বিদ্যালয় এন্ড কলেজে ক্লাস এইটের মেধাবী ছাত্রী। ক্লাসে সবসময় তার রোল নাম্বার এক। ৫ম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেছিল সে।
হঠাৎ করেই এই মেধাবী মেয়েটির জীবনে নেমে আসে ঘোর অমানিশা। এই বয়সে বসতে হয় বিয়ের পিঁড়িতে। ৪২ বছর বয়সী বিবাহিত ব্যক্তির সাথে বিয়ে মেনে নিতে না পেরে সিদ্ধান্ত নেয় আত্মহত্যার। কিন্তু তাকে সে পথ থেকে ফেরায় তার সহপাঠি বান্ধবীরা। এরপর স্কুলশিক্ষকের মাধ্যমে আইনি সহায়তা চায় ইউএনও’র কাছে। সেখান থেকে তার স্থান হয় নতুন অভিভাবক ও নতুন ঠিকানা স্থানীয় পৌর মেয়রের কাছে।
গত বৃহস্পতিবার (৩ মে) জীবনের নতুন অধ্যায়ে যাত্রা শুরু হয় রিয়ার।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ৪ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় রিয়ার বাবা রেজাউল করিম। সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের দাদার বাড়ি ছেড়ে নানার বাড়ি পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার দুলাই ইউনিয়নের বেথুরিয়া গ্রামে আশ্রয় নেয় রিয়া ও তার মা মরিয়ম খাতুন। কিছুদিন পর তার মায়ের বিয়ে হয় একই উপজেলার ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়নের খালাইভেড়া গ্রামের মাবুদ আলী নামক এক ব্যক্তির সাথে।
দরিদ্র নানার বাড়িতে থেকেই অনেক কষ্টে লেখাপড়া করতে থাকে রিয়া। এর মধ্যে হঠাৎ রিয়ার সৎ বাবা ও মা নানার বাড়ি গিয়ে বেড়ানোর কথা বলে রিয়াকে নিয়ে যায় তারা। গত দুই মাস আগে রিয়াকে জোরপূর্বক সুজানগর উপজেলার রাণীনগর ইউনিয়নের শারীরভিটা গ্রামের ৪২ বছর বয়সী বিবাহিত নাছির হোসেনের সাথে দেড় লাখ টাকা দেনমোহরে বিয়ে দেয় ।
অল্প বয়সে মতের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বিয়ে দিলেও কোনমতেই রিয়াকে স্বামীর বাড়িতে নিতে পারেনি শ্বশুর বাড়ির লোকজন। বর পক্ষ চলে যাওয়ার পর রিয়া আবার তার নানার বাড়িতে চলে আসে। এরপর থেকে মেয়েটির সৎ বাবা ও মা প্রায় প্রতিদিনই রিয়ার নানার বাড়িতে উপস্থিত হতো, রিয়াকে তার স্বামীর বাড়ি যাওয়ার জন্য মারধর করতো ।
আলাপকালে রিয়া জানায়, ‘এমন পরিস্থিতিতে নির্যাতন সইতে না পেরে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নেই এবং মৃত্যুর পর এর জন্য সৎ বাবা ও মা দায়ী-এমন কথা উল্লেখ করে একটি চিঠি লিখে বইয়ের মধ্যে রেখে দেই। কয়েকদিন স্কুলে না যাওয়ায় আমার কয়েকজন সহপাঠি আমার খবর নিতে গত বৃহস্পতিবার (৩ মে) আমার কাছে আসে। তখন আমি বান্ধবীদের কাছে সব ঘটনা খুলে বলে বলি। তখন বান্ধবীরা আমার নানীকে ‘স্যাররা রিয়াকে দেখা করতে বলেছে’ জানিয়ে আমাকে স্কুলের সহকারী শিক্ষক শরিফুল ইসলামের কাছে নিয়ে যায়। আমি সব কথা স্যারকে জানাই।’
সহকারী শিক্ষক শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমি সব কথা শোনার পর প্রথমে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলাম শাহজাহানকে জানাই। তিনি তখন সুজানগর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সুজিৎ দেবনাথ কে বিষয়টি অবগত করেন। ইউএনও রিয়াকে নিয়ে তার অফিসে যেতে বললে ইউপি চেয়ারম্যান রিয়া সহ আমাদের ইউএনও অফিসে পাঠিয়ে দেন। সেখানে যাওয়ার পর রিয়ার কাছে বিস্তারিত ঘটনা শোনেন ইউএনও স্যার।’
এ সময় রিয়া কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। রিয়া জানায়, ‘নাছির নামক একজন মধ্যবয়সী বিবাহিত ব্যক্তির কাছ থেকে তার সৎ বাবা ও মা একটি নছিমন গাড়ি নিয়ে ওই ব্যক্তির সাথে আমার জোরপূর্বক বিয়ে দিয়েছে। কিন্ত আমি সেই বিয়ে মেনে না নেওয়ায় প্রতিদিন আমাকে মারধর করে। কিন্ত স্যার আমি পড়াশুনা করতে চাই, আমি আর আমার নানা বাড়িতে যাবোনা, আমাকে পড়াশুনার সুযোগ করে দেন স্যার।’
সুজানগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সুজিৎ দেবনাথ বলেন, ‘বিষয়টি উপজেলা চেয়ারম্যান আব্দুল কাদের রোকন, পৌর মেয়র আব্দুল ওহাব, পাবনা সহকারী পুলিশ সুপার (সুজানগর সার্কেল) ফরহাদ হোসেন, ওসি শরিফুল আলম, উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তাকে অবগত করে তাদের নিয়ে বসে আলোচনা করি। সেইসাথে মেয়েটির সৎ বাবা ও তার মাকে স্থানীয় ইউপি সদস্যের মাধ্যমে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় অফিসে ডেকে আনা হয়। তখন রিয়ার সৎ বাবা ও মার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বললে তারা তাদের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চান। তারা জানান, উপস্থিত যদি কেউ রিয়াকে নিয়ে পড়াশুনা করিয়ে মানুষের মত মানুষ করতে চায় এবং রিয়াও যদি সেখানে থাকতে চায় সে ক্ষেত্রে তাদের কোন আপত্তি থাকবেনা।’
এ সময় উপস্থিত পৌর মেয়র আলহাজ্ব আব্দুল ওহাব বলেন, ‘মেয়েটি যদি থাকতে চায় এবং তার সৎ বাবা ও মা সহ উপস্থিত সকলে যদি সম্মতি দেয় তাহলে এতিম ও মেধাবী স্কুলছাত্রী রিয়ার অভিভাবক হিসাবে দায়িত্ব নিতে চাই।’
তখন রিয়াও মেয়রের বাড়িতে থাকতে সম্মতি জানায়। এ সময় উপস্থিত সকলে মিলে স্কুলছাত্রী রিয়াকে তার নতুন অভিভাবক হিসাবে পৌর মেয়র আলহাজ্ব আব্দুল ওহাবের হাতে তুলে দেন।
সুজানগর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘রিয়া এখনও বিয়ের উপযুক্ত নয়। ১৮ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত সে আলাদা থাকবে। আর যার সাথে বিয়ে হয়েছিল সেই বিয়ের স্বপক্ষে কোনো প্রমাণযোগ্য কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। মেয়েটিও তার সৎ বাবা ও মায়ের কাছে যেতে রাজী নয়। তাই মেয়র আব্দুল ওহাব রিয়ার অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়েছেন।’
সুজানগর পৌর মেয়র আব্দুল ওহাব বলেন, ‘রিয়া মেধাবী ছাত্রী। তার সৎ বাবা-মা টাকার লোভে মেয়েটির জীবন নষ্ট করতে যাচ্ছিল। যা খুবই বেদনাদায়ক। রিয়াকে পড়াশোনা করাতে পারলে ভবিষ্যতে অনেক বড় হবে, মানুষের মতো মানুষ হবে। সে তার বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে চায়না। তাই মানুষ হিসেবে আরেকজন অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোর যে সামাজিক দায়িত্ব তার অংশ হিসেবে আমি রিয়ার অভিভাবকের দায়িত্ব নিয়েছি।’
এক প্রতিক্রিয়ায় রিয়া জানায়, ‘সৎ বাবা ও মায়ের অত্যাচার থেকে বাঁচতে পারছি, নতুন অভিভাবক পেয়েছি, খুব ভাল লাগছে। আমি লেখাপড়া করে মানুষ হতে চাই। ইউএনও স্যার, মেয়র সাহেব, স্কুলের শিক্ষক ও বান্ধবীদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ। তারা আমাকে নতুন জীবন দিয়েছেন।’
রাইজিংবিডি/পাবনা/৫ মে ২০১৮/শাহীন রহমান/টিপু
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন