ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মাছ কুড়িয়ে ভাত!

জুনাইদ আল হাবিব || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৫, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মাছ কুড়িয়ে ভাত!

জুনাইদ আল হাবিব : শিরোনাম পড়ে অবাক হলেন? হবারই কথা! বর্ষাকাল শেষে উপকূলীয় অঞ্চলের অনেক জায়গায় শিশু-কিশোর দলবেঁধে ছুটে যায় হালচাষের জন্য ব্যবহৃত ট্রাক্টরের পেছনে। পানি নেমে যাওয়ায় সেই জমিতে ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করে কৃষক। একই জমিতে শিশু-কিশোরের দল করে মাছের সন্ধান। দু’মুঠো ভাতের জন্যই এদের সমবয়সীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। কে কত মাছ ধরতে পারে- দিনভর চলে সেই প্রতিযোগিতা। মাছ কুড়িয়ে পেলে ভাগ্যে ভাত জোটে। অন্যথায় উপবাসে জীবন কাটাতে হয়।

শুধু নিজের পেটের চাহিদা মেটাতে ওদের সংগ্রাম নয়, অনেক কোমলমতি শিশুর কাঁধে গোটা সংসারের ভারও থাকে। তারা মাছ ধরতে না পারলে সংসারজুড়ে হতাশার কালো মেঘের ছায়া পড়ে। জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে এসব শিশুরা যেন ভিন্ন এক যুদ্ধে নামে প্রতিনিয়ত। এ সময় ট্রাক্টরের চাকার নিচে পড়ে পিষ্ট হবার ভয় তো আছেই। তবুও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলে মাছ শিকার। বলছি মেঘনা উপকূলের জেলা লক্ষ্মীপুরের গল্প।

লক্ষ্মীপুরে কৃষক ফসল ফলাতে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। যেমন ট্রাক্টরের ব্যবহার। বিলের পানি কমে যাওয়ার পর ট্রাক্টর দিয়ে জমি চাষ করেন কৃষক। এ সময় বিলে বড় হওয়া বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। পানি কমে যাওয়ায় শিশু-কিশোরের দল খুব সহজেই প্লাস্টিকের ছাকনি দিয়ে মাছগুলো ধরার চেষ্টা করে। একইসঙ্গে চলে কৃষকের ট্রাক্টরের মাধ্যমে জমি চাষ। ফলে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকে যায়। অথচ এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে শিশুদের উৎসাহিত করেন অভিভাবকেরা। এতে মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটেছে। কিন্তু এমন মারাত্মক কাজ থেকে শিশু-কিশোরদের সরিয়ে নিতে বড়দের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগেরও অভাব রয়েছে।



ওরা চার জন। একসঙ্গে দ্রুত বেগে হেঁটে চলেছে। কোথায় যেন যাবে? চোখ ফেরাই ওদের দিকে... হাতে প্লাস্টিকের ছাকনি। ‘এই যে থামো। কোথায় যাচ্ছো?’ জিজ্ঞেস করতেই সঙ্গে সঙ্গে সবার কণ্ঠ থেকে একসঙ্গে শোনা গেল- ‘ওই যে, ঐখানে যামু।’ ‘কেন যাচ্ছো?’ ‘মাছ ধরমু’। ‘কীভাবে মাছ ধরবে?’ জিজ্ঞেস করতেই ওরা জানাল- ‘ট্রাক্টরে ক্ষেত ছইলে (হালচাষ) মাছ ভাসি উডে। এই ঝাজুর দি ছাকি লইলে অনেক গুঁড়া মাছ পাওয়া যায়।’ ‘কী করবে মাছ দিয়ে?’ ‘ছালন রানুম, না বেইচ্ছা অন্য হদু আনুম।’ ‘পড়াশোনা করো তোমরা?’ এবার ওরা যেন কিছুটা অপ্রস্তুত হলো।একজন সেই অপ্রস্তুত ভাব কাটিয়ে বলে উঠল, ‘দেখেন না? কীভাবে হড়মু? ঠিকমতো খাইতেই তো হারি না, আবার হড়ালেয়া?’

কথা হচ্ছিল ৮ বছর বয়সী হৃদয়, ৬ বছরের রহিম, ৯ বছরের বাবুল এবং ৭ বছরের মাহফুজের সঙ্গে। ওরা কখনো স্কুলের আঙিনায় পা রাখেনি! জন্মের পর ওরা কিছুদিন মক্তবে পড়াশোনা করেছে। এরপর পারিবারিক দুর্দশার কারণে পড়াশোনা আর হয়নি। লক্ষ্মীপুর জেলা সদরের মিয়ারবেড়ী চর মনসা গ্রাম। এখানে একটি ক্ষেতে হালচাষের সময় শতাধিক শিশু-কিশোরকে মাছ কুড়াতে দেখা যায়। ট্রাক্টরের পেছনে ছুটছে কেউ কেউ। কেউ-বা পানির ঢেউয়ের নাচনে খেয়াল করে মাছ ধরছে, কেউ-বা ঘোলাটে পানিতে প্লাস্টিকের ছাকনি ছুড়ে দিচ্ছে। এভাবেই থলিতে জমা হচ্ছে বিভিন্ন রকমের মাছ। এ মাছ নিয়ে বাজারে গিয়ে কেউ কেউ বিক্রি করে বাজার সদাইয়ের চাহিদা মেটাবে।



একই দৃশ্য জেলার কমলনগরের চর মার্টিনে। ছোট ট্রাক্টরে হালচাষ করছে শাকিল। বয়স তার ১২ বছর। ওর বাড়ি চর মার্টিনের বলিরপোলের একটু দক্ষিণে। রাস্তার পাশেই ঘর ওদের। বলতে গেলে ভূমিহীন। বাবা আশরাফ বিদ্যুৎ শ্রমিক। শাকিল কখনো ওদের সঙ্গে মাছ ধরে, কখনো রিকশা-ট্রলি চালায়। সর্বশেষ তাকে দেখা গেছে হালচাষ করতে। তার ওপরই নির্ভর পরিবার। শাকিলের ট্রাক্টরের পেছনে ছুটছে শিশু-কিশোরের দল। সমবয়সীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ট্রাক্টর চালায় ও। খুব সর্তক অবস্থান তার।

একই উপজেলার মেঘনাতীরের জনপদ চর ফলকনের মাতব্বরহাট এলাকা। বাজারের দক্ষিণে চোখ গেলে দেখা মেলে একই দৃশ্য। দুই থেকে আড়াই’শ শিশু-কিশোরের দল ট্রাক্টরের  পেছনে ছুটছে। ধরছে কই, লাটি, ট্যাংরা, পুঁটি, ভাটা, বাইলা, চিংড়িসহ অনেক ধরনের মাছ। সমাজের বিত্তবানেরা এই মাছগুলো ওদের কাছ থেকে কম মূল্যে কিনে নেয়। তাই দিয়ে চাল, তরি-তরকারিসহ নানা রকমের বাজার সদাই কেনে তারা। স্বল্প পরিমাণ বাজার সদাই হলেও তাদের জন্য এটা বিশাল কিছু।



ওদের একজন নিরব। বয়স ৮ বছর। নদীর গর্ভে ভিটে-মাটি হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে তার পরিবার। এখন ভাঙা-চোরা ঘরে আশ্রয় নিয়েছে অন্যের বাড়িতে। বাবাও খোঁজ-খবর রাখেন না সংসারের। অসুস্থ মায়ের পক্ষে নিরবের পড়াশোনা টেকানো সম্ভব হয়ে ওঠেনি। তৃতীয় শ্রেণীতে স্কুল থেকে ঝরে পড়ে নিরব। ‘এখন কী আর করমু?  ক্ষেতে মাছ টোগাইছি। হেই মাছ বাজারে বেচি ৫ কেজি চাইল আইনছি।’ বলছিল নিরব।

জেলার মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন জনপদ দ্বীপ চর রমণীমোহন। যেখানের ছোট খালগুলোতে মাছ কুড়িয়ে জীবিকা নির্বাহ করছে সেখানের শিশু-কিশোররাও। ওখানের শিশু সোহাগ। বয়স তার ৯ বছর। দ্বীপে মাছ ধরে ট্রলার যোগে মাছ বিক্রি করতে এসেছে মতিরহাট ইলিশ ঘাটে। হাতে তার প্রায় এক কেজি চিংড়ি। অবশ্য ওগুলো আকারে ছোট। ‘দাম কত চাই?’ সোহাগকে প্রশ্ন করা হলে জবাব আসে, আড়াই’শ টাকা।



হালচাষের সময় এসব শিশু-কিশোরদের উপচে পড়া ভিড় দুশ্চিন্তায় ফেলে দেয় এলাকার ট্রাক্টর মালিকদের। কারণ কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটলে দায় এড়ানোর সুযোগ নেই। এ জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করে মা-বাবাকে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে সরিয়ে নিতে আহবান জানান ট্রাক্টরের মালিক আবুল কালাম।

ফেনী জর্জকোর্টের কর্মকর্তা জিয়া উদ্দিন ফারুক বলছিলেন, ‘গ্রাম-বাংলার অপূর্ব সৌন্দর্য আমাদের মনের বিকাশ ঘটায়। আমরা বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি ভালোবাসি। এ প্রকৃতির মাঝেই টানাটানির সংসারের দরিদ্রপীড়িত শিশু-কিশোররা জমিতে একটু হালচাষের শব্দ শুনলে খুব ঝুঁকির মধ্যেই মাছ ধরতে বেরিয়ে পড়ে। ওরাতো ঠিক জানে না, ঝুঁকি কাকে বলে? বা এতে তাদের কোনো ক্ষতি হবে কিনা? এমন সংকট সমাধানে দ্রুতই ব্যবস্থা না নিলে অনেক প্রাণহানির আশঙ্কা থেকে যায়।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮/ফিরোজ/তারা

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়