ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

মা দিবসের বিস্ময়কর ইতিহাস

স্বপ্নীল মাহফুজ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ১২ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মা দিবসের বিস্ময়কর ইতিহাস

আন্না জারভিস

স্বপ্নীল মাহফুজ : সন্তানের অস্তিত্বের সঙ্গে যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি জড়িত তা হলো মা। কবি-সাহিত্যিকেরা ছন্দে ছন্দে কিংবা গল্প-উপন্যাসের লাইনে লাইনে প্রকাশ করেছেন যে মায়ের মতো আপন কেউ হতে পারে না। হ্যাঁ এটাই বাস্তবতা, মায়ের স্থান কেউ দখলে নিতে পারে না, মায়ের বিকল্প কেবল মা-ই। সন্তানের প্রতি মায়ের ভালোবাসা নিঃশর্ত এবং এ ভালোবাসা পৃথিবীর সবচেয়ে খাঁটি বস্তুটির চেয়েও খাঁটি। মা যখন সন্তান লালন-পালন করেন তখন তার মনে এটা থাকে না যে এ সন্তান বড় হয়ে আমার ভরণপোষণ করবে। তিনি সন্তানকে প্রকৃতির দেয়া স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বয়ংক্রিয় ভালোবাসা ছড়াতে ছড়াতে বড় করে তোলেন।

মায়ের ভালোবাসা হলো প্রকৃতির দেয়া নিয়ামত। এ নিয়ামত না পেলে একটা সন্তান সুষ্ঠুভাবে বেড়ে ওঠতে পারে না- এর প্রমাণ পাওয়া যায় সেসব ছেলেমেয়েদের দিকে তাকালে যারা মায়ের সঙ্গ তেমন একটা পায়নি অথবা বাক ফোটার আগেই মাকে হারিয়েছে। মায়ের আদর-স্নেহ-ভালোবাসা কিংবা সঙ্গ না পেলে শিশুর অস্থিরতা বাড়তে থাকে এবং শিশুর মানসিক ভারসাম্য বিশৃঙ্খলের দিকে এগুতে থাকে। আমাদের মানসিক বিকাশ থেকে জীবনের সফলতা সবকিছুতেই মায়ের অবদানকে অস্বীকার করা যাবে না, কারণ আপনি নিজে নিজে যত উচ্চতর ডিগ্রিই অর্জন করেন না কেন মূল ভিত্তিটা কিন্তু মায়ের কাছ থেকে অর্জিত। তাই সন্তানকে সবসময় খেয়াল রাখতে হবে যে তার আচার-আচরণে যেন গর্ভধারিণী মায়ের চোখ থেকে এক ফোঁটা জলও গড়িয়ে না পড়ে।

প্রতি বছরের মে মাসের দ্বিতীয় রোববার মা দিবস পালন করা হয়, এ দিবসটিকে অনেকে বিতর্কিত করতে চাইলেও আপনি ইতিবাচক ভাবতে পারেন যে, এ দিবসে মাকে বিশেষভাবে সম্মানিত করতে পারাটা সৌভাগ্যেরই ব্যাপার। এ দিবসে মাকে বিশেষভাবে ভালোবাসতে কিংবা শ্রদ্ধা জানাতে ক্ষতি নেই, বরং এতে মা-সন্তানের আত্মার বন্ধন আরো মজবুত হয়।

মা দিবসের উত্থান আকস্মিকভাবে হয়নি, ইতিহাসের অনেক পথ পেরিয়ে মা দিবসের এ আধুনিক সংস্করণ। আসুন আজকের মা দিবসে এ দিবসের বিস্ময়কর ইতিহাস সম্পর্কে জেনে নিই।

* মা দিবসের প্রাথমিক ইতিহাস
অন্যান্য অনেক আধুনিক ছুটির দিনের মতো মা দিবস হঠাৎ করে আবির্ভূত হয়নি। প্রাচীন গ্রীক ও রোমানরা মা দেবী রিয়া ও সাইবেলিকে উৎসব উৎসর্গ করতো। ষোড়শ শতকে ইংল্যান্ডে মাদারিং সানডে’র উদ্ভব হয়। এ দিবসটি উদযাপন করা হতো লেন্টের (খ্রিস্টানদের ৪০ দিনের পর্ব) চতুর্থ রোববারে। মাদারিং সানডেতে ছেলেমেয়েরা পারিবারিক চার্চ বা মাদার চার্চের উদ্দেশ্যে পবিত্র যাত্রা শুরু করতো। এ দিবসটি পারিবারিক পুনর্মিলনের সুযোগ করে দিত এবং ঘরের ভৃত্যদের (বিশেষ করে মেয়েদেরকে) ছুটি দেওয়া হতো, যেন তারা মায়েদেরকে দেখতে পায়। যুক্তরাজ্যে এখনো লেন্টের চতুর্থ রোববারে মাদারিং সানডে উদযাপন করা হয়, যদিও এটি আধুনিক সময়ে ধর্মনিরপেক্ষ ছুটির দিনে রূপান্তরিত হয়েছে।

 


* মা দিবসের মা
ঐতিহাসিক ঘটনা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে মা দিবসের আধুনিক সংস্করণের জন্য আন্না জারভিসের অক্লান্ত প্রচেষ্টা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য, যিনি প্রকৃতপক্ষে নিজে মা ছিলেন না। তিনি ১৯০৮ সালে তার নিজের মাকে সম্মান জানাতে অথবা স্মরণ করতে প্রথম উদযাপন করেন, যিনি তিন বছর পূর্বে মৃত্যুবরণ করেছেন। ‘মেমোরিয়ালাইজিং মাদারহুড: আন্না জারভিস অ্যান্ড দ্য স্ট্রাগল ফর কন্ট্রোল অব মাদারিং ডে’ নামক বইয়ের লেখক ক্যাথেরিন অ্যান্টলিনি বলেন, ‘সকল মায়েদের উদ্দেশ্যে এ দিবসটি উদযাপন করা হতো না। এটি উদযাপন করা হতো শ্রেষ্ঠ মায়েদের উদ্দেশ্যে- প্রত্যেকের কাছে শ্রেষ্ঠ মা হলো নিজের মা।’ ১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ২৮তম প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন মা দিবসকে ছুটির দিন ঘোষণা করেন।

* মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা পরিবারেই বহমান ছিল
টাইম ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে একটি আকর্ষণীয় বিষয় জানা যায়, আন্না জারভিসের মা অ্যান জারভিস উনিশ শতকের মধ্যভাগে মায়েদের জন্য একটি ছুটির দিন প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু তার আইডিয়াটি ভিন্ন ছিল: তিনি অন্য মায়েদের প্রয়োজনে সেবা করতে মায়েদের জন্য একটি কমিউনিটি সার্ভিস ডে বা স্বেচ্ছাসেবা দিবসের স্বপ্ন দেখতেন। এমন দিবস প্রতিষ্ঠার জন্য তার নিজের জীবনের বিয়োগান্তক ঘটনা থেকে কিছুটা অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন: তিনি ১৩টা সন্তান জন্ম দেন, কিন্তু মাত্র চারজনই সাবালকত্বে পৌঁছেছিল, অন্যান্য সন্তানেরা তার আগেই মারা যায়। সেসময়টাতে তার অ্যাপালেশিয়ান সম্প্রদায়ে টাইফয়েড জ্বরের প্রাদুর্ভাব ছিল। তিনি ও তার ডাক্তার ভাই মাদারস’ ডে ওয়ার্ক ক্লাবস নামক একটি ইনফরমেশনাল সেশনের মাধ্যমে নারীদেরকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে অবহিত করেছেন, যেন তারা সন্তানদেরকে সুস্থ রাখতে পারেন।

* শান্তির জন্য মায়েদের একটি মিশন
মা দিবসের একটি যুদ্ধবিরোধী ইতিহাসও রয়েছে। ১৮৭০ সালের দিকে দাসপ্রথাবিরোধী, নারীবাদী ও নারীর ভোটাধিকার প্রত্যাশী জুলিয়া ওয়ার্ড হাউই ‘ব্যাটল হাইম অব দ্য রিপাবলিক’ এ যে লিরিকগুলো লিখেছেন তাতে মা দিবস প্রতিষ্ঠার ইঙ্গিত রয়েছে। এটি মায়েদেরকে শান্তির জন্য ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানিয়েছে। পরবর্তীতে তিনি মাদার’স পিস ডে (মায়ের শান্তি দিবস) নামক একটি ছুটির দিন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সফল হতে পারেননি। প্রায় একই সময়ে অ্যান জারভিস মাদারস’ ফ্রেন্ডশিপ ডে বা মায়েদের বন্ধুত্ব দিবস প্রতিষ্ঠা করেন। এ দিবসে মায়েরা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক পুনঃস্থাপন ও দেশকে এগিয়ে নিতে নতুন পথের সন্ধান পেতে ইউনিয়ন ও কনফেডারেসির সাবেক সৈন্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন।

* যে কারণে আন্না জারভিস মা দিবসের প্রতিবাদ করেছেন
ভাগ্যের কি নির্মম বাঁক! একটা সময় আন্না জারভিস মা দিবসের প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়েন। তিনি লক্ষ্য করলেন যে, তার মৌলিক লক্ষ্যের সঙ্গে মা দিবসের উদযাপন মিলছে না। তিনি অনুভব করলেন যে, এ ছুটির দিনটি শুভেচ্ছা কার্ড, চকলেট ও ফুল সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের দ্বারা জিম্মি হয়ে আছে। তিনি এ ধরনের উদযাপনের প্রতিবাদ করেন এবং এ দিনটিকে যেন চ্যারিটির জন্য অর্থসংগ্রহে ব্যবহার করা হয় তার প্রচেষ্টা চালান। তিনি মা দিবসের বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে ১৯৪৪ সালের মধ্যে ৩৩টি মামলায় জড়িয়ে পড়েন। তার এ প্রতিবাদ থেমে থাকেনি এবং তিনি তার পুরো জীবন ও সঞ্চয় এ ছুটির দিনের বাণিজ্যিকীকরণের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ব্যয় করেছেন। তিনি তার শেষ জীবনের কিছু বছর কাটান স্যানিটারিয়াম বা স্বাস্থ্যনিবাসে এবং ১৯৪৮ সালে কপর্দকহীন অবস্থায় মারা যান।

* মায়েদের আরেক সংগ্রাম
মা হলো সন্তানের প্রধান অবলম্বন। ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যাবে যে, সন্তানের অনেক বড় সফলতার পেছনে মায়ের শক্তিশালী ভূমিকা ছিল। অ্যান জারভিসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে কিছু নারী বিশ শতকের দ্বিতীয় অর্ধাংশে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মা দিবসকে ব্যবহার করেন। উদাহরণস্বরূপ, হিস্ট্রি ডটকমের প্রতিবেদন থেকে জানা যায় যে আমেরিকান লেখক, রাজনৈতিক পরিবর্তনকামী কর্মী ও নাগরিক অধিকার আদায়ের নেত্রী কোরেট্টা স্কট কিং ১৯৬৮ সালে সুবিধাবঞ্চিত নারী ও শিশুদের জন্য একটি মার্চ করেন এবং ১৯৭০ সালের দিকে নারীরা সমানাধিকার আদায় ও শিশুসেবা পাওয়ার জন্য এ দিবসটি ব্যবহার করেন।

* বিশ্বজুড়ে উদযাপন
প্রত্যেক দেশে মা দিবসের নিজস্ব ইতিহাস ও উদযাপনমূলক বাঁক রয়েছে। এ দিবসে মেক্সিকান মায়েরা খাবার, ফুল ও সংগীত দ্বারা সম্মানিত হন। মেক্সিকান ছেলেমেয়েরা মায়েদের উদ্দেশ্যে লাস মানানিতাসের মতো জনপ্রিয় গান গাওয়ার জন্য মেক্সিকোর মারিয়াচি ব্যান্ডে যোগ দিয়ে থাকে। ইথিওপিয়াতে বর্ষাকালের শেষে মায়েদের সম্মানার্থে তিন দিনব্যাপী অ্যাট্রোস্থ উৎসব উদযাপন করা হয়- ইথিওপিয়ান পরিবার মায়েদের জন্য মিট হ্যাশ তৈরি করে, এটির জন্য কন্যারা শাকসবজি ও পনির আনে এবং পুত্রেরা আনে মাংস। ফ্রান্সে ঐতিহ্যবাহী গিফট হলো ফুলাকৃতির কেক- সেদেশে ১৯২০ সালে সেসব মায়েদেরকে পদকে ভূষিত করা হয় যারা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর পরিবার বড় করে দেশের জনসংখ্যা বাড়াতে অবদান রেখেছেন। এছাড়া অন্যান্য দেশেও মা দিবসের উদযাপনে নিজস্ব ঐতিহ্যের ছাপ পাওয়া যায়।

পড়ুন :




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ মে ২০১৯/ফিরোজ

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়