ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

ভাইকে উত্তরসূরী করা ছাড়া এরশাদের সব স্বপ্নই অধরা

নঈমুদ্দীন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৫, ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাইকে উত্তরসূরী করা ছাড়া এরশাদের সব স্বপ্নই অধরা

মোহাম্মদ নঈমুদ্দীন : জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের দীর্ঘ দিনের স্বপ্ন ছোট ভাই জিএম কাদেরকে রাজনীতিতে নিজের উত্তরসূরী করবেন। কিন্তু কোনোভাবেই সেই স্বপ্নপূরণ করতে পারছিলেন না তিনি। ইতিমধ্যে বয়স বেড়েছে তার। স্বাভাবিকভাবেই মনে নানা শঙ্কা রয়েছে। এই স্বপ্নপূরণে বড় বাধা স্ত্রী রওশন এরশাদসহ দলের একটি অংশ। নেতাকর্মীদের থেকেও দূরে ছিলেন জিএম কাদের। সব মিলিয়ে কোনোভাবেই ছোট ভাইকে দলের পরবর্তী আসনে বসাতে পারছিলেন না এরশাদ।

 

২০১৬ সালের ১৭ জানুয়ারি, হঠাৎ সিদ্ধান্ত নেন সাবেক এ রাষ্ট্রপতি। রংপুরে গিয়ে ছোট ভাইকে নিজের উত্তরসূরী ঘোষণা দিয়ে দলের কো-চেয়ারম্যান করেন তিনি। এ ইস্যুতে বিরোধিতা করায় জিএম কাদের বিরোধী দলের মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুকেও কৌশলে ছেটে ফেলেন এরশাদ। রওশন এরশাদ প্রচণ্ড বিরোধিতা করলেও দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যানের পদ দিয়ে কৌশলে তাকেও ম্যানেজ করে নেন সাবেক এ সেনাপ্রধান।

 

দল ভাঙ্গার হুমকি মোকাবেলা করে মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে ছোট ভাইকে উত্তরসূরী করার স্বপ্নপূরণের মধ্য দিয়ে ২০১৬ সালে আলোচিত হন এরশাদ। জিএম কাদেরকে কো-চেয়ারম্যান, বাবলুকে সরিয়ে পুনরায় বিশ্বস্ত ও অনুগত রুহুল আমীন হাওলাদারকে দলের মহাসচিব করা ছাড়া আর কোনো স্বপ্ন তিনি পূরণ করতে পারেননি। বাকী স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে। বিষয়টি নিয়ে দলের নেতাকর্মীরাও সমালোচনামুখর।

 

জাতীয় পার্টির মহাসচিব এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদার বলেন, ‘পার্টির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি যে কোনো সময়ের চেয়ে সুসংগঠিত ও শক্তিশালী। আগামীতে পার্টিকে ক্ষমতাসীন করে গণমানুষের প্রত্যাশা পূরণের মধ্য দিয়ে পল্লীবন্ধুর সব স্বপ্নই পূরণ হবে ইনশাআল্লাহ।’ দেশের গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে, সুন্দর-সুখি ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়তে তিনি দলের নেতাকর্মী ও দেশের মানুষকে সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।

 

২০১৬ সালে বছরজুড়ে এরশাদ বলে গেছেন, জাতীয় পার্টিকে শক্তিশালী ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত করবেন। খুব শিগগির বিএনপির স্থান দখল করে নেবে জাপা। বিএনপির চেয়েও শক্তিশালী দল হবে জাতীয় পার্টি। কিন্তু দলটির নেতারাই বলছেন, জাতীয় পার্টি এখনও কোন্দলে বিভক্ত। দেশের প্রত্যেক জেলায় নেতায় নেতায় কোন্দল। এক বছরেও সেই বিভক্তির নিরসন করা যায়নি। এই কোন্দলের কারণে ঘোষণা দিয়ে প্রস্তুতি নেওয়া সত্বেও এরশাদ তার ঘরের দূর্গ রংপুর ও  মহাসচিবের নিজ জেলা বরিশালে মহাসমাবেশ করতে পারেননি। এমনকি ১ জানুয়ারির মহাসমাবেশ বানচালে দলের একটি গ্রুপ ষড়যন্ত্র করছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

 

এ ব্যাপারে দলের মহাসচিব এবিএম রুহুল আমীন হাওলাদার বলেন, জাতীয় পার্টি নিয়ে ষড়যন্ত্র নতুন নয়। দলের মধ্যে ও বাইরে থেকে ষড়যন্ত্র হতে পারে। এ বিষয়ে আমরা সজাগ। ষড়যন্ত্রকারীরা তো চাইবে না এত বড় মহাসমাবেশ সফল হোক। তবে যারাই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাদের চিহ্নিত করা হবে। দলের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের বরদাশত করা হবে না।

 

বিএনপির স্থান জাতীয় পার্টি দখল করবে-এ প্রসঙ্গে হাওলাদার বলেন, জাতীয় পার্টি সংসদের বিরোধী দল। মাঠের রাজনীতিতে বিএনপির চেয়ে আমরা অবশ্যই এগিয়ে আছি।

 

তবে দলটির নেতারা অভিযোগ করেন, জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু মহাসচিব হওয়ার পর থেকে পার্টির চেয়ারম্যানকে মিসগাইড করেন। বিএনপির স্থান দখল করা, ১৫১ আসনে জিতে ক্ষমতায় যাওয়ার মত কল্পকাহিনী প্রচারের জন্য সাবেক মহাসচিবই দায়ী। তার কারণে জাতীয় পার্টি আরো দুর্বল হয়েছে এবং দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয়েছে।

 

তারা আরো বলেন, রাজনীতিতে জাতীয় পার্টির নিজস্ব অবস্থান ও স্বকীয়তা রয়েছে। পার্টির চেয়ারম্যান বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন বলে এখন তিনি আর বলেন না। এ কারণে ১৫১ আসনের পরিবর্তে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।

 

জানা গেছে, ২০১৬ সালের মধ্যেই দলের কাউন্সিল করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। ২০১৬ সালের ১৪ মে বর্ণাঢ্য কাউন্সিল করে তিনি প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন। তবে কাউন্সিলের আগে দলের কো- চেয়ারম্যান বলেছিলেন, কাউন্সিল থেকে দেশের মানুষের জন্য ইতিবাচক রাজনৈতিক কর্মসূচি দেওয়া হবে। কিন্তু গত একবছরে গণমানুষের জন্য উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি ছিল না দলটির। একইভাবে গতবছর এরশাদ একাধিকবার বলেছিলেন, জাতীয় পার্টির স্বপ্ন থি জ্রি। থি জ্রি হলো জাতীয় পার্টি, জাস্টিস ও জব। জাতীয় পার্টিকে ক্ষমতাসীন করে বাকী দুটি পূরণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তাও অধরা থেকে গেলো। বরং জাতীয় পার্টি বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন, পৌরসভা, ইউনিয়ন ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে যে ফলাফল অর্জন করেছে তাতে এরশাদ হতাশ হয়েছেন। এনিয়ে তিনি প্রকাশ্য সমালোচনাও করেছেন একাধিকবার। প্রার্থীর অভাবে তো সর্বশেষ নারায়ণগঞ্জ সিটি ও জেলা পরিষদে জাতীয় পার্টি অংশ নেয়নি।

 

জাপা নেতারা জানান, মামলা নিয়ে এরশাদ উদ্বিগ্ন থাকলেও গত এক বছরে এ নিয়ে সন্তোষজনক কোনো সমাধানে আসতে পারেননি তিনি। যে কারণে বছর শেষে মামলা প্রত্যাহারে সরকারকে চাপ দিতে নেতাকর্মীদের দাবির মুখে রওশন এরশাদকে মামলার দায়িত্ব নিতে হয়েছে।

 

জাতীয় পার্টি সত্যিকার বিরোধী দল হতে পারেনি- এই অভিযোগ খোদ পার্টি চেয়ারম্যান এরশাদের। সরকার থেকে তিন মন্ত্রীর বেরিয়ে আসার কথাও বলেছিলেন একাধিকবার। কিন্তু মন্ত্রিত্ব ছাড়তে নেতাদের তিনি রাজি করাতে পারেননি।  এখন তিনি নিজেই নাকি দূতের পদ ছাড়তে চান না বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলটির নেতারা জানান। তা ছাড়া

 

প্রধানমন্ত্রীর দূত হিসেবে মন্ত্রী মর্যাদা থাকলেও তার কোনো কাজ নেই। এ নিয়ে হতাশার মধ্যেই তাকে ২০১৬ সাল পার করতে হয়েছে।

 

জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ভিন্নমত পোষন করে বলেন, মানুষ স্বপ্ন দেখে, সব স্বপ্নই কি পূরণ হয়? কিন্তু আমাদের পার্টির চেয়ারম্যান এক এক করে স্বপ্ন পূরণে এগিয়ে চলছেন। তিনি বলেন, ‘সাবেক সফল রাষ্ট্রপতি এখনো একজন তরুণের মতই দলের জন্য, দেশ ও মানুষের জন্য যেভাবে কাজ করছেন সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। জাতীয় পার্টি দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতার বাইরে, এর মধ্যে পার্টির চেয়ারম্যান ও আমাদের দল নিয়ে ষড়যন্ত্র আগেও ছিল, এখনও আছে। কিন্তু এত কিছুর পরও পার্টির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি আবারো ক্ষমতার দ্বারপ্রান্তে। এই যে অর্জন সেটা স্যারের (এরশাদ) নিরলস প্রচেষ্টার কারণেই সম্ভব হয়েছে। ’

 

সবকিছু ছাপিয়ে ২০১৬ সালে এরশাদের বড় অর্জন পরিবারের মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠা। দীর্ঘদিন ধরে দলের নেতৃত্ব ও কতৃত্ব নিয়ে এরশাদ, স্ত্রী রওশন ও ছোট ভাই জিএম কাদেরের মধ্যে ত্রিমুখী বিভেদ লেগেই ছিল। কিন্তু ২০১৬ সালের জাতীয় কাউন্সিলের আগেই বিভেদ ভুলে তারা এক হয়েছেন। এরশাদ, রওশন ও জিএম কাদের ত্রিমুখী সেই দ্বন্দ্ব এখন আর দৃশ্যমান নেই।

 

এ প্রসঙ্গে এরশাদের পালিতকন্যা ও জাতীয় মহিলা পার্টির সেক্রেটারি অনন্যা হোসেন মৌসুমী বলেন, ‘দলের একটি স্বার্থান্বেষী মহল চায় না এরশাদ পরিবার এক থাকুক। তারা এতদিন তাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে ফায়দা লুটেছেন। কিন্তু দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী চায় পার্টির চেয়ারম্যান, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ও কো-চেয়ারম্যান তিনজনই সবসময় যে কোনো বিষয়ে এক থাকুক।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৩১ ডিসেম্বর ২০১৬/নঈমুদ্দীন/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়