ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শুধু সরকার নয়, নিজেদেরও দায়িত্ব নিতে হবে

কবীর চৌধুরী তন্ময় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:০১, ১৪ মে ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শুধু সরকার নয়, নিজেদেরও দায়িত্ব নিতে হবে

কবীর চৌধুরী তন্ময়: পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে, তারা মূলত বাংলাদেশকে গড়তে কাজ করেনি। আমি বাংলাদেশি- এই মর্যাদা বিশ্বের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করার বিপরীতে তারা বাংলাদেশ ও বাংলাদেশিদের অকার্যকর করার সব ধরনের চেষ্টা করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে যারা হত্যা করেছে, তারা ওইসব খুনীদের সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত করেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমতার ভাগ দিতেও কার্পণ্য করেনি। যার ধারাবাহিকতায় অধিকাংশ অযোগ্য ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের দিয়ে সে-সময় রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হয়েছে।

শুধু তাই নয়, যারা এই বাংলাদেশ চায়নি, যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিরোধীতা করতে গিয়ে পরিকল্পিতভাবে আল-বদর, আল-শামস ও রাজাকার বাহিনী গঠন করে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করেছে, বাড়ি-ঘর, শিল্প-কলকারখানা ধ্বংস করেছে, যারা এদেশের ত্রিশ লাখ সূর্য সন্তানকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। দুই লাখেরও বেশি নারীর সম্ভ্রম নাশ করেছে- তাদের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়েছে। তখন তারা পাকিস্তানি ভাবধারায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে যেসকল অপসংস্কৃতির বিস্তার ঘটিয়েছে, সেখান থেকে আজও আমরা বেরিয়ে আসতে পারিনি। কয়েক প্রজন্ম ওই অপসংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে, অপসংস্কৃতি রুখে দিতে, দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নিতে তিনি নিরলস কাজ করছেন। আমার প্রশ্ন- এর দায় কি শুধুই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর? দেশের নাগরিক হিসেবে তাহলে আমার কর্তব্য কী? এই সমাজ, সভ্যতা নিয়ে আমাদের দায়বদ্ধতা কতটুকু? এমন হাজারো প্রশ্ন নিয়ে আমি-আপনি বা আমরা হয়তো বিব্রতবোধ করবো। কিন্তু কতজন প্রকৃত চিত্র একটু বোঝার চেষ্টা করি বা করেছি? তার সংখ্যা কতো?

সাম্প্রতিক নিরাপদ সড়ক আন্দোলন রাজধানীসহ দেশের প্রত্যেক জেলা-উপজেলার মানুষকে একত্রিত করেছে। আমরা সবাই নিরাপদ সড়ক চাই-এই দাবি নিয়ে মাঠে-ময়দানে এবং মিডিয়া ও স্যোশাল মিডিয়াতে কথা হচ্ছে। অনেকে আবার এই আন্দোলনকে পুঁজি করে নানান ধরনের ষড়যন্ত্রও করেছে। টাকার বিনিময়ে চলচ্চিত্র জগতের কতিপয় বিতর্কিত মডেল ফেসবুক লাইভে এসে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারের বংশধর মুখ ঢেকে স্যোশাল মিডিয়ায় তাদের চিরাচরিত মিথ্যাচারের নোংরা চরিত্র তুলে ধরেছে। আবার অনেকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও পাকিস্তানি এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অসত্য, বানোয়াট বক্তব্য দিয়েছে। তখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থী যারা রাস্তা পারাপারের জন্য ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণের দাবি জানিয়েছে, যারা জেব্রা ক্রসিং নিয়ে অভিযোগ তুলেছে, যারা ফুটপাত দখলমুক্ত করার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে তাদের মধ্যে কতজন সত্যিকার অর্থেই ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করে? আমরা কি সবাই জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পারাপার হই? দখলমুক্ত ফুটপাত দিয়ে আমরা অনেকেই কি মোটর সাইকেল চালাই না? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ঢাকাসহ জেলা শহরগুলোর মানুষের চোখের সামনেই রয়েছে।

অথচ পান থেকে চুন খসলেই আমরা সরকারের সমালোচনায় মুখর হই। একবারও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের দায়িত্ব, কর্তব্য নিয়ে ভাবি না। ফুটওভার ব্রিজ, জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার আমার-আপনার শুধু দায়িত্ববোধের জায়গা থেকেই নয়, এটি নাগরিক সভ্যতার অংশ। এটি আমাদের নিরাপত্তাও দেয়। যে ফুটপাতে মানুষ চলাচল করবে, সেই ফুটপাতে আমি বা আমরা অনেকেই মোটর সাইকেল চালিয়ে নিজের কর্তব্যবোধের জায়গাকে প্রশ্নবিদ্ধ করি। মনের মধ্যে লালন করা অসভ্যতা আর বর্বরতা তুলে ধরি। সেদিন রাজধানীর বাংলা মোটর মোড়ে ফুটওভার ব্রিজে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে দেখেছি, ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করতে যেসকল সেচ্ছাসেবক ছেলেমেয়ে কাজ করছে, পথচারীরা তাদের রীতিমত অপমান করছে! অনেকে সেচ্ছাসেবকদের ধাক্কা দিয়ে নিজেরাই ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। কিন্তু ফুটওভার ব্রিজ ব্যবহার করছে না। ফুটপাতে মোটর সাইকেল চালানো সেইসকল ভাইদের সাথে অনেক সময় আমারও কথা কাটাকাটি হয়েছে। যতই বোঝানোর চেষ্টা করেছি, সে ততই ক্ষিপ্ত হয়ে নিজের প্রকৃত অসভ্যতা প্রকাশ করেছে।

একটি ব্যাপার মাঝে মাঝে আমাকে অবাক করে। একটা ঘটনা ঘটলে বা কেউ একজন অপরাধ করলে কতিপয় মানুষ আছে যারা ‘পুরো বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে গেছে’, ‘এই দেশে আর থাকা যাবে না’, ‘এই দেশ আমার জন্যে নয়’, ‘নোংরাদের দেশে সভ্য মানুষের মূল্য নেই’, ‘সরকার করেটা কী?’ ইত্যাদি শুনিয়ে খুব হতাশ হয়ে পড়ে। খুব অল্পতেই মন ভেঙে যায়। তখন তাদের একটি প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করে, একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনার পরিবারের কী ভূমিকা ছিল? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আপনি দেশ গড়ার কাজে কী ভূমিকা গ্রহণ করেছেন? দেশের ক্রান্তিলগ্নে আপনার উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ কী? এড়িয়ে চলার চেয়ে একটু দায়িত্ব গ্রহণ করুন। কিছুটা চ্যালেঞ্জ আপনিও নেন। শুধু সরকারের ওপর সকল দায়িত্বভার তুলে দিয়ে সমালোচনায় মুখর হবেন না। নিজেকে প্রশ্ন করুন- আপনি নাগরিক হিসেবে, বাংলাদেশী হিসেবে কতটা যোগ্য? দেশ ও দশের জন্য আপনি কী অবদান রেখেছেন? কারণ, দেশটা তো আপনারও। আপনিও এদেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছেন। এদেশের আলো বাতাসে বড় হয়েছেন। সংবিধান অনুযায়ী আপনিও এদেশের মালিক। এই মালিক হয়ে এই দেশটাকে সাজাতে কী কী কাজ করেছেন- একবার হলেও নিজেকে প্রশ্ন করে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করুন। দায়িত্ব নিয়ে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে এদেশকে একদিন স্বাধীন করেছে ঠিক এমনিভাবে আরেকবার দায়িত্ব নিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারা থেকে আমাদের দেশকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসুন। দেখবেন রাষ্ট্র আপনার পাশেই আছে।

এই যে, মে মাসের ৭ তারিখ থেকে রমজান মাস শুরু হয়েছে। রোজা আসার আগেই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলায় নিত্যপ্রয়োজীয় পণ্যের মূল্য বেড়েছে। অতিরিক্ত মূল্য বাড়িয়ে নেয়া হচ্ছে। এই ধরনের অপকর্ম যারা করছে, তারা নিশ্চয়ই ইউরোপ-আমেরিকা থেকে এসে করছে না। যারা করছে, তারা এই দেশের সন্তান। তারাও বাংলাদেশী। খোঁজ নিলে জানতে পারবেন, এদের অনেকেই আমার আপনার আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব। অনেকেই বলে থাকেন, পৃথিবীর একমাত্র দেশ বাংলাদেশ, যেখানে রমজানসহ বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসবগুলোতে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অবৈধভাবে বাড়তি মূল্য নিয়ে থাকে কতিপয় ব্যবসায়ী। কিন্তু কেন? যারা ব্যবসায়ী তারা অধিকাংশ মুসলমান। তাদের ধর্ম-কর্ম, দায়-দায়িত্ব আর আল্লাহ’র প্রতি কি কোনো আনুগত্য নেই? তারা কি জানে না এটা সংযমের মাস? এই অপকর্মের সাথে যারা জড়িত, সে আপনজন হলেও পরিত্যাজ্য। এরা মানুষ, মানবতা ও বাংলাদেশের শত্রু। তাই এদের থেকে সাবধান হওয়া, অন্যদের সচেতন করার দায়িত্বও আমাদের। শুধু রাষ্ট্রের ওপর সব দায় চাপিয়ে ঘরে বসে থাকলে হবে না।

মনে রাখবেন, এদের সংখ্যা খুব কম। সম্প্রীতির সোনার বাংলাদেশে রোজার দিন সবাই একসঙ্গে ইফতার করে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বীরাও তাতে অংশ নেয়। আমি দেখেছি, বৌদ্ধ মন্দির থেকে ইফতারের আয়োজন করা হচ্ছে। হিন্দু প্রতিবেশী ইফতার নিয়ে পাশের বাড়ি যাচ্ছে। এই সম্প্রীতি বজায় রাখতে আমাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অন্য ধর্মাবলম্বী ভাই-বোনদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রত্যেক মুসলমান ভাই-বোনদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। শুধু প্রয়োজন সচেতনতা, আর তার সঙ্গে দায়িত্ববান হওয়া। পাকিস্তানি ভাবধারা নয়, স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদের বর্জন করে আমাদের সবাইকে প্রকৃতপক্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশী হতে হবে। যেভাবে আমাদের পূর্বপুরুষ দায়িত্ব নিয়েছিল, ঠিক আমাদেরও দায়িত্ব নিতে হবে। যার যার অবস্থান থেকে সম্প্রীতি বজায় রেখে অন্ধকার আর অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হবে। তাই বলছি, শুধু সরকারের উপর দায় চাপিয়ে বসে না থেকে আপনিও এগিয়ে আসুন, দায়িত্ব নিন। আমরা আমাদের জায়গা থেকে সচেতন হলে, আমাদের পরিবারকে সচেতন ও শিক্ষিত করার দায়িত্ব নিলে- খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি দূর হয়ে যাবে। দেশপ্রেমে আমাদের উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। যেখানেই অন্যায়, সেখানেই প্রতিবাদ, প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমি নিজে যদি ঘুষ না খাই, আমি নিজে যদি দুর্নীতিপরায়ণ না হই, আমি নিজেই যদি আইনকানুন মেনে জীবন-যাপন করি, তাহলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এখান থেকে শিক্ষা নেবে। সমাজের অন্ধকার দূর করে আলোর মশাল জ্বালানোর দায়িত্বটুকু আমাদেরই নিতে হবে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট ফোরাম (বোয়াফ)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মে ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়