ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’ কেন থামছে না?

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫৪, ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’ কেন থামছে না?

রুহুল আমিন : প্রশ্নপত্র ফাঁস নতুন কিছু নয়। তবে ইদানীং এই ফাঁসের ঘটনাটি বেড়েছে। পাবলিক পরীক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন নিয়োগ ও ভর্তি পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর আসছে সংবাদমাধ্যমে। দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম নিয়ে এক অনৈতিক খেলায় মেতে উঠেছে কতিপয় ব্যক্তি, গোষ্ঠী। যাদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে আগামী প্রজন্ম।   

সম্ভবত, ১৯৭৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় দেশে প্রথম প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে। তখন ওই ঘটনা ছিল সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা। আর গত চার-পাঁচ বছর ধরে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি একেবারে সাধারণ একটি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা যেন এমন, পরীক্ষা হচ্ছে তো প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়াটাই স্বাভাবিক। এই ধারণা সাধারণ মানুষদের জন্য যতটা না ক্ষতিকর তার চেয়ে হাজার হাজার গুণে বেশি ক্ষতিকর- যে পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে তার জন্য।

সর্বশেষ গত শুক্রবার অনুষ্ঠিত মেডিক্যাল কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের  ‘গুজব’ সংবাদ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও এরই মধ্যে এই পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এই পরীক্ষার বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে একটি রিটও করা হয়েছিল। তবে আদালত রিটটি খারিজ করে দিয়েছে। আর যারা  ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি তারা মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি দিচ্ছে। দাবি করছে এই ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের।

এবারের মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনাকে কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়া যাবে না। বরং ধারাবাহিক ঘটনা বলা যায়। গত ৫ আগস্ট প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনে জানায়, ২০১২-২০১৫ (আগস্ট) পর্যন্ত বিভিন্ন পাবলিক পরীক্ষায় মোট ৬৩টি প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

টিআইবির ওই প্রতিবেদনে প্রশ্নপত্র ফাঁসে কারা জড়িত সে ব্যাপারে জানায়- ‘গবেষণায় প্রশ্ন ফাঁস ও ফাঁসকৃত প্রশ্ন ছড়ানোর এবং বাজারজাতকরণে সম্ভাব্য অংশীজনের মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠান জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। প্রশ্ন ফাঁসের সাথে জড়িত এক ধরনের সিন্ডিকেটের উদ্ভব ঘটেছে- যারা অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন ফাঁস করছে। মূলত ক্ষমতাসীন দলীয় ছাত্র সংগঠনের একাংশের নেতাকর্মী, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কোচিং সেন্টার মিলে একটি সিন্ডিকেট প্রশ্ন ফাঁসের সাথে সক্রিয় এমন তথ্য পাওয়া যায়।’ যদিও টিআইবির প্রতিবেদন প্রকাশের পর শিক্ষামন্ত্রী ওই প্রতিবেদনকে অসত্য এবং ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন।

প্রশ্নপত্র ফাঁসের কারণে মেধার অবমূল্যায়নই হয় না, লেখাপড়ায় মনোনিবেশ হারিয়ে শিক্ষার্থীরা শিশুকাল থেকেই নীতিবর্জিত মানসিকতা লালন করতে শুরু করে। যা জাতির ভবিষ্যতের জন্য খুবই উদ্বেগজনক। সুনির্দিষ্ট চক্রান্তের মাধ্যমে ভবিষ্যত প্রজন্মকে অন্ধকারে রাখার এই পাঁয়তারায় কতিপয় ব্যক্তি সফলও হয়েছে বলা যায়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে তেমন কোনো কর্মসূচি চোখে পড়ে না। এতবড় একটি জাতীয় সমস্যা নিয়ে সম্মিলিতভাবে কেউ কথা বলছে না। বিচ্ছিন্নভাবে কথা বলে কোনো লাভ হবে না।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশন ফির উপর ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন দেখে মনে আশা জেগেছিল। ভেবেছিলাম সমাজের যে কোনো অনৈতিক, অশুভর বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে জাগ্রত শিক্ষার্থীরা। কিন্তু মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র পাশের পর তেমন কোনো উচ্চবাচ্য চোখে না পড়ায় হতাশই হয়েছি। শুধু তাই নয়, যাদেরকে ভ্যাটবিরোধী আন্দোলনে সোচ্চার দেখেছিলাম তাদের কয়েকজনকে দেখলাম ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ কয়েকজনকে নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে স্টেটাস দিয়েছে, অভিনন্দন জানিয়েছে। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারটা যেন  নিজের ছোট ভাই-বোন মেডিক্যালে চান্স পাওয়ায় ভুলেই গেছে। ব্যক্তি স্বার্থ বড় হয়ে গেল জাতীয় স্বার্থ থেকে? অথচ সবচেয়ে বড় আন্দোলনটা দরকার এই প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে।

যে শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে পরীক্ষার হলে গিয়ে দেখল সব সময় পেছনের সিটে বসা তার সহপাঠী তার চেয়ে ভাল উত্তর লিখছে। ভাল নম্বর পাচ্ছে, স্বাভাবিকভাবেই তার ভেতরে এর প্রতিক্রিয়া কাজ করবে। এবং  এই প্রতিক্রিয়া যে পজেটিভ হবে না, তা চোখ বুজেই বলে দেওয়া যায়। আর এর মাধ্যমে একটা ধারণা তাদের ভেতর পুতে দেওয়া হচ্ছে। যারা অনৈতিক তারাই ভাল থাকে। পড়াশোনা করে লাভ নেই। পরীক্ষার আগের রাতে ফাঁস হওয়া প্রশ্ন দিয়েই ভাল রেজাল্ট করা যায়। এই শিক্ষার্থীদের হাতেই অর্পিত হবে দেশের ভবিষ্যত। এই রকম অনৈতিকতার ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা প্রজন্ম যে দেশের জন্য কতটা ইতিবাচক তা এখন থেকেই ভাবা দরকার।

আর শিক্ষার্থীদের মানসপটে অনিয়মের যে মন্ত্র পুতে দেওয়া হচ্ছে তা লাঘব হবে কীভাবে? এটা কি গভীর কোনো ষড়যন্ত্র নাকি সাময়িক লাভের লোভে নিজেদের ধ্বংস করার প্রয়াস। যা-ই হোক না কেন প্রশ্নপত্র ফাঁস যে ভাল কিছু না তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি আর যা ই হোক জাতির ভাল চায় না এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

গত বছরের ২৬ নভেম্বর প্রশ্নপত্র ফাঁসের ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রী বলেছিলেন, ‘প্রয়োজনে পরীক্ষার দিন মোবাইল ফোন বন্ধ করে দেব, প্রয়োজনে ফেসবুকও বন্ধ করে দেব। প্রশ্ন ফাঁস করে কেউ পার পাবে না। কেউ এখানে হাত দেবেন না, দিলে হাত পুড়ে যাবে, হাত ভেঙ্গে দেব’। শিক্ষামন্ত্রীর ওই হুমকির পরও একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হচ্ছে। অথচ মন্ত্রীর ওই উক্তির মধ্যেই প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে মন্ত্রণালয়ের অসহায়ত্বই ফুটে উঠেছে। কারণ, মোবাইল ফেসবুক না বরং প্রশ্নপত্র ফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি দিতে হবে।

আরেকটি উদ্বেগজনক বিষয় হচ্ছে, যে অভিভাবক নিজের সন্তানের জন্য রাত জেগে থাকতেন। সন্তানের পড়াশোনায় নজরদারি করতেন। সে অভিভাবকই এখন ভবিষ্যৎ পরিণতির কথা না ভেবে রাতের পর রাত প্রশ্নের পেছনে দৌড়াচ্ছেন। কারণ তিনি বুঝে গেছেন তার সন্তান পড়াশোনা করলেও তার সহপাঠীরা না পড়ে ভাল রেজাল্ট করবে। সব বাবা-মা চায় তাদের সন্তান ভাল রেজাল্ট করুক। ভাল জায়গায় চান্স পাবে, সুন্দর ভবিষ্যত গড়বে। কিন্তু আসলেও কি তা হচ্ছে? তার প্রমাণ তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র ৪% থেকে ২০% শিক্ষার্থী নির্ধারিত পাশ নম্বর উঠাতে পারার মধ্যেই পাওয়া যায়। প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা অল্প হলেও দায়ী এর জন্য।
১৯৯২ সালে ‘পাবলিক পরীক্ষা অপরাধ আইন ১৯৮০’ সংশোধনের মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে অভিযুক্তদের ১০ বছরের শাস্তির বিধান কমিয়ে চার বছর করা হয়। সবচেয় মজার ব্যাপার হলো, কর্তন করা এই সাজাটুকুও অভিযুক্ত কেউ পেয়েছে শুনিনি আজ অবধি।
আলবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন ‘অসৎদের মাধ্যমে নয় বরং অসততা দেখেও যারা অসৎদের বিরুদ্ধে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে না তাদের মাধ্যমেই পৃথিবী ধ্বংস হবে।’ প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিরুদ্ধে আমাদের আজকের নিরবতা দেখে মনে হচ্ছে আমাদের ধ্বংসও সময়ের ব্যাপার মাত্র। এবং আমরাই সে পথ বাতলে দিচ্ছি।  
আমি বলব না পাবলিক পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় প্রশ্ন প্রণয়ন, ছাপানো এবং বিতরণের সঙ্গে জড়িত সকলেই অসৎ। কিংবা সব শিক্ষার্থীই প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। আর সব অভিভাবকও এইসব দেখে নিশ্চুপ থাকেন। আবার আমরা খুব নীতিবানও হতে পারিনি। তবে শিক্ষার্থীদেরকে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতার সুযোগ দিতে হবে। তাদেরকে নৈতিকতার পথে অটুট রাখতে হবে। নীতি নৈতিকতার শিক্ষা দিতে হবে।

 

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনের কথাটা মনে আছে? ওই যে, সন্তানের কল্যানার্থে শিক্ষকের কাছে চিঠিতে উল্লেখ করেছিলেন, ‘আমার সন্তানকে শিখাবেন নকল করে পাশ করার চেয়ে অকৃতকার্য হওয়া অনেক বেশি সম্মানের।’ অনৈতিক উপায়ে ভাল কিছু অর্জন করা যে কোনো কিছু না অর্জনের চেয়ে সম্মানের সে সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে।  

খুব বেশি মানুষ প্রশ্নপত্র ফাঁস করার ক্ষমতা রাখে না। গুটি কয়েজন হয়তো এর সঙ্গে জড়িত। তাদেরকে চিহ্নিত করে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে। তবেই সম্ভব প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধ।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২২ সেপ্টেম্বর ২০১৫/রুহুল/শাহ মতিন টিপু

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়