ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

কোরবানির ফাযায়েল ও মাসায়েল

মাওলানা মো. জহিরুল ইসলাম || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:৩৭, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
কোরবানির ফাযায়েল ও মাসায়েল

মাওলানা মো. জহিরুল ইসলাম : নিজ হাতে কোরবানি করা উত্তম। তবে নিজে কোরবানি করতে না পারলে অপরকে দিয়েও করানো যেতে পারে। সেক্ষেত্রে যবেহ্ করার সময় সেখানে উপস্থিত থাকা ভাল। (ফাত্ওয়ায়ে শামীম হিদায়া)।

মনে মনে কুরবানীর নিয়ত করাই যথেষ্ট। মৌখিক উচ্চারণ জরুরী নয়। কিন্তু যবেহ্ করার সময় ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ মুখে বলা জরুরী। মাসনূন তরীকা এই, যখন যবেহ্ করার জন্য পশুটিকে ক্বিবলামুখী করে শোয়াবে, তখন এই আয়াত শরীফ পাঠ করবে, ‘ইন্না সালাতী ওয়ানুসুকী ওয়া মাহ্ইয়া-ইয়া ওয়া মামাতী লিল্লাহি রাব্বিল আলামীন।’ অতঃপর ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলে যবেহ্ করবে। যবেহ্ করার পর এই দোয়া পাঠ করবে, ‘আল্লাহুম্মা তাক্বাব্বালহু মিন্নী কামা তাক্বাব্বালতা মিন হাবীবিকা মুহাম্মাদিন ওয়া খালীলিকা ইব্রাহীমা আলাইহিমাস্ সালাম।’ (জাওয়াহিরুল ফিক্বাহ্, মিশকাত-১৮২)।

মুসলমান নর-নারী, প্রাপ্ত বয়স্ক, অপ্রাপ্ত বয়স্ক, পাকী-নাপাকী, জ্ঞানী-অজ্ঞানী যে কারো যবেহ্ করা পশুর গোশত ভক্ষণ করা হালাল। তবে শর্ত হচ্ছে, যবেহ্ করার সময় বিসমিল্লাহ্ অবশ্যই পড়তে হবে এবং যবেহ করার নিয়ম কানুন জানতে হবে। কিন্তু যারা কেবল পশু ধরবে তাদের বিসমিল্লাহ্ পড়া জরুরী নয়। (র্দুরুল মুখ্তার)।

যবেহ্ করার পূর্বে ছুরি খুব ধার করে নিতে হবে এবং এক পশুর সামনে অন্য পশু যবেহ্ করবে না। যতক্ষণ পর্যন্ত পুরোপুরি ভাবে ঠাণ্ডা না হয়ে যায় (জীবনী শক্তি নিঃশেষ না হয়ে যায়) তাড়াহুড়োর বশবর্তী হয়ে ততক্ষণ পর্যন্ত পশুর চামড়া খসানো বা গোস্ত কাটায় লিপ্ত হবে না (কারণ তাতে পশুর কষ্ট হয়)। (শামী)।

যবেহ্ করার শরীয়ত সম্মত নিয়ম হচ্ছে, পশুর শ্বাসনালী, খাদ্য নালী এবং রক্ত চলাচলের মোটা মোটা দুটি ধমনী- এ চারটির মধ্যে কমপক্ষে যে কোন তিনটি অবশ্যই কাটতে হবে; তাহলে ভক্ষণ হালাল হবে, নতুবা হারাম। (র্দুরুল মুখ্তার)।

উট নহর করার সুন্নাত। অর্থাৎ উটের পা বেঁধে দাঁড় করিয়ে বর্ষা বা ছুরি তার গলায় ঢুকিয়ে দিয়ে রক্ত প্রবাহিত করে দিতে হবে। উট ভিন্ন অন্য সকল পশু যবেহ্ট করাই সুন্নাত। কোরবানির পশু কোরবানির কিছু দিন পূর্বে ক্রয় করে লালন-পালন করা উত্তম। কোরবানির পশুর দুধ দোহন বা পশম কাটা নাজায়েয। কেউ এরূপ করলে উক্ত দুধ, পশম বা তার সমপরিমাণ মূল্য সাদকা করে দেওয়া ওয়াজিব (বাদায়ে)। কিন্তু মালিক তার ঘাস পানির ব্যবস্থা করলে ঐ ব্যক্তির জন্য সাদকা করা ওয়াজিব নয়। (আলমগিরী)। কুরবানীর পশু যবেহ্ করার পূর্বে বা যবেহ করার সময় জীবিত বাচ্চা প্রসব করলে তাকেও যবেহ্ করে দিতে হবে। কিন্তু যবেহ্ করে তার গোশত কিংবা পারতপক্ষে তার মূল্য সাদকা করে দিতে হবে। কারো কারো মতে জীবিত সাদকা করাই মুস্তাহাব। (ফাত্ওয়ায়ে শামী)। বছরের অন্যান্য সময় যেমন হাঁস, মুরগী, গরু, ছাগল ইত্যাদি যবেহ্ করার জায়েয তদ্রুপ জিলহজের চাঁদ উদয়ের পরে দশ তারিখ পর্যন্তও জায়েয। সাধারণ মানুষের ধারণা, জিলহজের চাঁদ উঠার পর কোন পশুপাখী যবেহ্ করা নাজায়েয। একথার আদৌ কোন ভিত্তি নেই, সম্পূর্ণ অবান্তর। কোরবানির দিনগুলোতে কোরবানির নিয়তে এরূপ পশুপাখী যবেহ্ করা, যা দ্বারা কোরবানি জায়েয নয়, মাকরূহ্ হবে। (আলমগিরী)।


অংশীদারী কোরবানিঃ গরু, মহিষ, উটে সাত ব্যক্তির অংশীদারী হওয়া বৈধ। কিন্তু কারো অংশ সাত ভাগের এক অংশের চেয়ে কম হতে পারবে না। সকল অংশীদারেরই কোরবানি বা আক্বীক্বার নিয়ত হতে হবে অথবা কারো আক্বীক্বা ও কারো কোরবানির নিয়ত হতে হবে। যে কোন একজনের অংশও যদি সাত ভাগের এক অংশের চেয়ে কম হয়, তাহলে কারো কোরবানি আদায় হবে না। (ফাত্ওয়ায়ে শামী)। গরু, মহিষ, উটে যদি সাত জনের চেয়ে কম লোক শামিল হয়, যেমন দুই, তিন, পাঁচ, ছয় ইত্যাদি এবং কারো অংশ সাত ভাগের এক অংশের এবং কারো অংশ সাত ভাগের এক অংশের চেয়ে কম না হয়, তাহলে সকলেরই কোরবানি দুরস্ত হবে। সাতের অধিক যদি একজন অর্থাৎ আটজনও হয়, তাহলে কারো কোরবানি দুরস্ত হবে না। (ফাত্ওয়ায়ে শামী)।

কোরবানির নিয়ত ব্যতিরেকে পশু ক্রয় করলে, সেক্ষেত্রে কোরবানির দিনগুলোতে হোক বা পূর্বেই হোক, ধনী ও নির্ধনী উভয়ের ক্ষেত্রেই শরীকদার নেওয়া এবং তা দিয়ে কোরবানি করা জায়েয। অনুরূপভাবে শরীক না করার নিয়তে ক্রয় করলেও তাতে অন্যকে শরীক করা জায়েয। (শামী)। যার উপর কোরবানি ওয়াজিব নয় সে যদি কোরবানির দিনগুলোতে কোরবানির নিয়তে পশু ক্রয় করে, তাহলে সেটিকে কোরবানি করা তার উপর ওয়াজিব হয়ে যাবে। তা বিক্রয় করা বা বদল করা তাতে কাউকে শরীক করা জায়েয হবে না। কেরাবানির দিনগুলোর পূর্বে ক্রয় করলে বিত্তশালী ও বিত্তহীন উভয়েরই পশুটিকে পরিবর্তন করা জায়েয। (শামী-৫/২৮০, রহীমিয়্যা-৩/৮৪, আযীযুল ফাত্ওয়া)। গরু, মহিষ, উটে যেহেতু একাধিক ব্যক্তি অর্থাৎ তিন, চার, পাঁচ, ছয় ব্যক্তি শরীক হয়ে কোরবানি করা জায়েয। সেহেতু প্রত্যেক পূর্ণ এক অংশের পরে যদি কোন ভগ্নাংশ থেকে যায়, তাতে কোন ক্ষতি নেই। ভগ্নাংশকে পূর্ণ অংশের আওতাভূক্ত ধরে নেওয়া হবে। সুতরাং এরূপ পশুতে ছয় জনের ছয় অংশের পর যে এক অংশ বাকী থাকল তা সকলে মিলে যদি কোন বুযুর্গের নামে বা নবী কারীমের (সাঃ) নামে কোরবানি করে দেয়, তাহলে তা জায়েয।

কোরবানির গোশত সম্পর্কিত মাসআলাঃ যে পশুতে একাধিক  অংশীদার হবে তার গোশত ওজন করে নেওয়া ওয়াজিব। অনুমান করে ভাগ করা নাজায়েয। যদি গোশতের সঙ্গে গোটা মাথা, গোটা পা ইত্যাদি এমনভাবে ভাগ করে নেয় যে, মাথাওয়ালার ভাগে গোশত কম হয়, তাহলে ওজন করে ভাগ করা জরুরী নয়। (র্দুরুল মুখ্তার, শামী, হিদায়া)। কোরবানির গোশত তিন ভাগ করে একভাগ পরিবার পরিজনের জন্য রাখা, একভাগ আত্মীয়-স্বজনকে দেওয়া, একভাগ গরীব-মিসকিনদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া মুস্তাহাব। এটা জরুরী নয় বিধায় বন্টন ব্যতীত সম্পূর্ণ গোশত পরিবার পরিজনের জন্য রাখতেও দোষ নেই। (ফাত্ওয়ায়ে শামী, হিদায়া, জাওয়াহিরুল ফিক্বহ)।

স্বেচ্ছায় কোন মৃতের নামে সাওয়াব পৌঁছানোর জন্য কোরবানি করলে তার গোশত নিজে খেতে পারবে, বিলাতে পারবে এবং অপরকেও খাওয়াতে পারবে। (ফাত্ওয়ায়ে শামী)। কোরবানির গোশত বিক্রয় করা সম্পূর্ণ হারাম। (জাওয়াহিরুল ফিক্বাহ)। যবেহ্কারী ও গোশত তৈয়ারকারীর মজুরি হিসেবে কোরবানির গোশত বা চামড়া দেওয়া জায়েয নেই। (জাওয়াহিরুল ফিক্বাহ্) সুতরাং তাদের মজুরি নিজের পক্ষ থেকে ভিন্নভাবে আদায় করতে হবে। যেসব কাজের লোক মালিকের ঘরে পানাহার করে, তাদের খাবার তরকারী ইত্যাদি মজুরীর মধ্যে সামিল। কেননা, পানাহার করা না করার কারণে বেতনের তারতম্য হয়ে থাকে। একারণে তাদেরকে কোরবানির গোশত খাওয়ালে প্রকৃতপক্ষে তা মজুরি হিসেবে দেওয়া এবং বিক্রি করায় গণ্য হয়। সুতরাং এ অসুবিধা থেকে বাঁচতে হলে, তাদেরকে কোরবানির গোশত খাওয়ানো যাবে না। তবে খাওয়ালেও ঐ পরিমাণ টাকা তাদেরকে অতিরিক্ত দিয়ে দিতে হবে, যাতে উক্ত খাদ্য মজুরিতে শামিল না হয়। (মুফ্তী আযম মাওলানা ফয়যুল্লাহ্ রাহ্) ।

কেউ যদি হাদিয়া হিসেবে গোশত দেয়, তা আলাদাভাবে রান্না করে বিক্রি করা বা কাজের লোককে খাওয়ানো নিঃসন্দেহে জায়েয। যদি সকল অংশীদার মিলে নিজ নিজ ভাগের গোশত একত্রে রান্না করে খায় বা অন্যকে খাওয়ায়, তাহলে কাঁচা গোশত বন্টনের ন্যায় ওজন করে খাওয়ার প্রয়োজন নেই। গোশতসহ যে সকল জিনিস বাজারে ওজন করে বিক্রি হয়, কেবল সে সকল জিনিসই পরষ্পরের মধ্যে ভাগ করলে ওজন করে নেওয়া ওয়াজিব। ওজন না করলে সুদের গুনাহ হবে।
 
কোরবানির পশুর চামড়াঃ কোরবানির পশুর চামড়া কোন কাজ বা খিদমতের বিনিময় হিসেবে দেওয়া বৈধ নয় বিধায় মসজিদের মুয়াজ্জিন, ইমাম বা অন্য কোন কর্মচারিকে তার কাজের বিনিময় বা পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া নাজায়েয। (জাওয়াহিরুল ফিক্বাহ্)। দ্বীনি মাদ্রাসার গরীব ছাত্ররা কোরবানির চামড়া দান করার সর্বোত্তম পাত্র। এতে দু’টি দিক রয়েছে, একদিকে গরীবকে দান করার সাওয়াব, অপরদিকে দ্বীনি ইসলাম প্রচার-প্রসার তথা দ্বীনি খিদমতের সাওয়াব। কিন্তু শিক্ষকগণের বেতন কিংবা অন্য কর্মচারীদের পারিশ্রমিক দেওয়া আদৌ জায়েয নেই। (জাওয়াহিরুল ফিক্বাহ্)। কোরবানির চামড়া বিক্রি করে তার মূল্য দিয়ে মসজিদ, মাদ্রাসা, মক্তব, রাস্তাঘাট ইত্যাদি নির্মাণ ও মেরামত জায়েয নয়। (ফাত্ওয়ায়ে শামী)। যশ-খ্যাতি, অহংকার, গর্ব, ক্ষমতা ইত্যাদি প্রকাশ কুরআন, হাদীস তথা ইসলামী ফিক্বাহ্ শাস্ত্রীয় বিধান মতে অকাট্য হারাম প্রমাণিত বিধায় কোরবানির পশু ক্রয় করতঃ লাল কাপড়, ফুলের মালা ইত্যাদি পরিয়ে রাস্তায় বাজারে বাজারে ঘুরিয়ে লোক দেখানোর যে প্রথা আমাদের দেশে প্রচলিত, তা শরীয়ত সম্মত নয়। মুসলমান মাত্রই এরূপ কাজ থেকে বিরত থাকা একান্ত বাঞ্ছনীয়। নেকি নষ্ট করে গুনাহ্ অর্জন করার নির্বুদ্ধিতা থেকে বাঁচা একান্ত কাম্য। আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন যে, কোরবানির পশুর রক্ত গোশত কিছুই আল্লাহর দরবারে কখনও যাবে না বরং একমাত্র তোমাদের তাক্বওয়া অর্থাৎ আন্তরিকতাই তাঁর দরবারে পৌঁছাবে।

 

লেখক : প্রভাষক, আরবি বিভাগ, মেহেরপুর আলীয়া মাদ্রাসা।

 

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪/তাপস/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়