ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

শ্রমিক দিবসের মূল দাবিই মানছে না অনেকে

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৪:১১, ১ মে ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শ্রমিক দিবসের মূল দাবিই মানছে না অনেকে

হাসান মাহামুদ : আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রম ও নিয়োগপত্র নিশ্চিত করা। কিন্তু যে অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রায় ১৫০ বছর আগে শ্রমিকরা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন, তা অধরা রয়েছে আজও।

শ্রমিকের শ্রমঘণ্টা নিয়ে আজও কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা হয়নি। শ্রমের সময়সূচি নিয়ে এখনও যথাযথ নিয়ম মানা হয় না। আজও শ্রমিক নির্যাতিত হয়। শ্রম আইনের বাইরে রয়ে গেছে এখনো প্রায় পাঁচ কোটি শ্রমিক।

পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা বিলুপ্ত করে সাম্যভিত্তিক সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মার্কস তার ‘দাস ক্যাপিটাল’ পুস্তকে লিখেছেন, ‘পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থাটি শ্রমিকের কাজের সময়টি বাড়িয়ে দিয়ে মানবিক শ্রমশক্তির স্বাভাবিক, নৈতিক, শারীরিক ক্রিয়াকর্মের ও উন্নতির সম্ভাবনাকে কেড়ে নিয়ে কেবল তার অবনতিই ঘটায় না, এই উৎপাদন ব্যবস্থা মানুষের শ্রমশক্তির অকাল শ্রান্তি-ক্লান্তি-মৃত্যুও ঘটায়। শ্রমিকের প্রকৃত আয়ু কমিয়ে দিয়ে নির্দিষ্টকালের মধ্যে তার উৎপাদনের সময়টি বাড়িয়ে দেয়।’

সুতরাং শারীরিকভাবে জীবিত থাকার প্রয়োজনে একজন শ্রমিককে যে সময় দিতে হয়, তা থেকে প্রকৃত ‘বেঁচে থাকার’ সময়ের ক্ষেত্রটিকে প্রসারিত করার জন্য ‘সম্ভাব্য সবচেয়ে কম সময় কাজ করে জীবিত থাকার ব্যবস্থা করা;- এই মর্মবাণী সম্পন্ন দাবি এক বিরাট ঐতিহাসিক-সামাজিক-রাজনৈতিক তাৎপর্য বহন করে। ‘মে দিবসের’ আট ঘণ্টা কাজকেন্দ্রীক দাবিটির কালোত্তীর্ণ গুরুত্ব ও তাৎপর্যের একটি প্রধান উৎস এখানেই।

পরিবহন খাত, নিরাপত্তা কর্মী, হোটেল ও রেস্তোরাঁসহ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের যেকোনো কাজেও শ্রমিকদের আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয়। এমনকি মিডিয়াতেও সরাসরি কাজের ক্ষেত্রে বেশি কর্মঘণ্টার বিষয়টি সর্ম্পকে সবাই জানে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের শ্রম আইনে দৈনিক আট ঘণ্টা কর্মদিবস নির্ধারিত থাকলেও তার বেশি সময় ধরে কাজ করতে হয় প্রায় ৯৮ শতাংশ নিরাপত্তা কর্মী, হোটেল বা রেঁস্তোরা ও পরিবহন শ্রমিকদের।

তথ্য অনুযায়ী, পরিবহন খাতে ১০০ শতাংশ শ্রমিককে দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করতে হয় এবং নিরাপত্তা কর্মীদের ৮০ শতাংশ শ্রমিককে দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি সময় কাজ করতে হয়। এসব শ্রমিকরা সাপ্তাহিক ছুটি থেকেও বঞ্চিত হন।

 



নিরাপত্তা কর্মীদের ৬৬ ভাগ সাপ্তাহিক ছুটি পান না, ৮৮ ভাগ মে দিবসে ও ৮৬ ভাগ সরকারি ছুটির দিনও কাজ করতে হয়। হোটেল শ্রমিকদের ৮৬ শতাংশ সাপ্তাহিক ছুটি, ৮২ শতাংশ সরকারি ছুটি ও ৮২ শতাংশ মে দিবসের ছুটিতেও কাজ করেন। রি-রোলিং শ্রমিকদের সাপ্তাহিক কোনো ছুটি নেই বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তাদের কাজ করতে হয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবসেও। হাসপাতালের শ্রমিকদের ৭২ শতাংশ সরকারি ছুটিতেও কাজ করেন, সাপ্তাহিক ছুটি নেই ২২ শতাংশের।

শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়ে বিলসের নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ বলেন, ‘শ্রম নিরাপত্তার যে কিছুটা উন্নতি হয়েছে, তা জীবনের নিরাপত্তার নয়। এই উন্নতি করা হয়েছে বৈদেশিক বাণিজ্যকে নিরাপদ করার জন্য।’

এদিকে দেশে মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ কোনো না কোনোভাবে কায়িক শ্রমের সঙ্গে জড়িত। অথচ এখনো অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিকের ব্যাপারে সরকারের কোনো তদারকি নেই। ন্যায্য মজুরি ও কর্মপরিবেশ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শ্রমিকেরা। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কোনো শ্রমিককেই নিয়োগপত্র দেওয়া হয় না। মূল বেতন ছাড়া অন্যান্য সুবিধা অল্প ও অনির্ধারিত। মজুরিতে নারী-পুরুষ বৈষম্য প্রকট। অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে শ্রম আইনের রক্ষাকবচ পুরোপুরি অনুপস্থিত। এ রকম বাস্তবতায় আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে সংগতি রেখে দেশে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস, যা সারা বিশ্বে মে দিবস হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিকসহ ৫ কোটি ৪০ লাখ ৮৪ হাজার লোক বিভিন্ন শ্রমের সঙ্গে জড়িত। সংস্থাটির হিসাব অনুযায়ী, দেশে প্রাতিষ্ঠানিক শ্রমিকের সংখ্যা রয়েছে ৬৭ লাখ ৮৭ হাজার, যারা মূলত সরকারি-বেসরকারি সংস্থায় নিয়মিত শ্রম দিয়ে থাকেন। আর অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিকের সংখ্যা ৪ কোটি ৭৩ লাখ ৫০ হাজার। এটি দেশের মোট শ্রমিকের ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ। কিন্তু এ বিশাল শ্রমিকের কোনো স্বীকৃতি নেই। কোনো আলাদা পরিচয়পত্রও নেই।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১ মে ২০১৭/হাসান/সাইফুল

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়