ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

ঈদুল ফিতর- সিয়াম ভাঙার আনন্দ উৎসব

আসিফ খান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৯, ২৫ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঈদুল ফিতর- সিয়াম ভাঙার আনন্দ উৎসব

আসিফ খান : মাহে রমজানের ২৯তম দিন আজ। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনা শেষে কাল অথবা পরশু ঈদের আমেজ ছড়িয়ে পড়বে সবখানে। ঘরে ঘরে বইবে আনন্দের বন্যা। অর্থাৎ আজ যদি শওয়ালের চাঁদ দেখা যায় তাহলে আগামীকাল ঈদ। আর চাঁদ দেখা না গেলে ৩০ রমজান পূর্ণ হয়ে পরশু উদযাপিত হবে ঈদুল ফিতর।  ঈদুল ফিতরের জন্য ২৯ রমজান ঈদের চাঁদ দেখা সুন্নত। এদিন চাঁদ উদিত না হলে ৩০ রমজানও চাঁদ দেখা সুন্নত। যদিও এদিন চাঁদ দেখা না গেলে পরদিন ১ শাওয়াল তথা ঈদুল ফিতর হবে।

হিজরি বর্ষপঞ্জী অনুসারে রমজান মাসের শেষে শাওয়াল মাসের ১ তারিখে ঈদুল ফিতর উৎসব পালন করা হয়। তবে এই পঞ্জিকা অনুসারে কোনো অবস্থাতে রমজান মাস ৩০ দিনের বেশি দীর্ঘ হবে না। চাঁদ দেখা সাপেক্ষে রমজানের সমাপ্তিতে শাওয়াল মাস শুরু হয়। ঈদের চাঁদ তথা নতুন চাঁদ দেখে দোয়া পড়া সুন্নত। ঈদের রাত হলো ইবাদতের বিশেষ রাতগুলোর অন্যতম; তাই ঈদের রাতে বেশি বেশি নফল ইবাদত-বন্দেগিতে মশগুল থাকা উত্তম।

মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব এই ঈদ। প্রিয়নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন- তোমরা চাঁদ দেখে সিয়াম রাখবে এবং চাঁদ দেখে সিয়াম থেকে বিরত হবে। ঈদুল ফিতর মানে সিয়াম ভাঙার আনন্দ উৎসব। রাসূল (সা.) বলেছেন : প্রত্যেক জাতিরই আনন্দ উৎসব আছে আমাদের আনন্দ উৎসব এই ঈদ। যা প্রতি বছর নির্দিষ্ট তারিখে নির্দিষ্ট নিয়মে ফিরে ফিরে আসে এবং যা নির্দিষ্ট নিয়মে, নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট আচার- অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি বছর পালিত হয়।

ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয় দ্বিতীয় হিজরির ১লা শাওয়াল (৬২৪ সালের ৩১ মার্চ)। এদিন ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় মসজিদে নববি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় ৩৬০ মিটার দূরে একটা খোলা ময়দানে। এই ময়দানের পাশেই ছিল হযরত আবু বকর (রা.)-এর বাসস্থান। এই ঈদের সালাতে কয়েক হাজার সাহাবি অংশগ্রহণ করেন। প্রথম ঈদুল ফিতর পালিত হয় যেদিন সেদিনটি ছিল শুক্রবার।

রাসূল (সা.) রবিউল আউয়াল মাসে মক্কা মুয়াজ্জমা হতে মদিনা মনওয়ারায় হিজরত করে এসে এখানে স্থাপন করলেন একটি মসজিদ এবং এই মসজিদকে কেন্দ্র করে গড়ে তুললেন একটি সুখী-সুন্দর সমাজ কাঠামো। বিশিষ্ট সাহাবি হযরত আনাস (রা.) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সা.) মদিনাতে এসে দেখলেন যে, তাদের দুটি উৎসবের দিন রয়েছে। সেই দুই দিন তারা আমোদ-ফুর্তি, খেলাধুলা প্রভৃতি করতো। তিনি জিজ্ঞেসা করলেন, এই দুদিন কিসের জন্য? তারা বললো এই দুই দিন অন্ধকার যুগে আমরা খেলাধুলা করতাম। এই কথা শুনে প্রিয়নবী (সা.) বললেন, আল্লাহ এই দুই দিনের পরিবর্তে অধিকতর উত্তম দুইটি দিন তোমাদের দিয়েছেন আর তা হচ্ছে শাওয়াল মাসের প্রথম তারিখে ঈদুল ফিতর এবং অপরটি জিলহজ্ব মাসের ১০ম তারিখে ঈদুল আজহা। (আবু দাউদ)

ঈদ আরবি শব্দ। যার অর্থ ফিরে আসা। এমন দিনকে ঈদ বলা হয় যে দিন মানুষ একত্র হয় ও দিনটি বারবার ফিরে আসে। এ শব্দ দ্বারা এ দিবসের নাম রাখার তাৎপর্য হলো আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এ দিবসে তাঁর বান্দাদের নিয়ামত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করেন ও বারবার তাঁর ইহসানের দৃষ্টি দান করেন। যেমন রমজানে পানাহার নিষিদ্ধ করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। সদকায়ে ফিতর, হজ-যিয়ারত, কুরবানির গোশত ইত্যাদি নিয়ামত তিনি বারবার ফিরিয়ে দেন। আর এ সকল নিয়ামত ফিরে পেয়ে ভোগ করার জন্য অভ্যাসগতভাবেই মানুষ আনন্দ-ফুর্তি করে থাকে।

ঈদ একটি ইবাদত। আনন্দ ও ফুর্তি করার মাধ্যমেও যে ইবাদত পালন করা যায়, ঈদ তার অন্যতম উদাহরণ। শরিয়াহ সম্মতভাবে আনন্দ প্রকাশ করার বিষয়ে কোরআনে এসেছে, ‘বল, এটা আল্লাহর অনুগ্রহ ও রহমত, সুতরাং এ নিয়েই যেন তারা খুশি হয়। এটি যা তারা জমা করে তা থেকে উত্তম।’ (সূরা ইউনুস : ৫৮)

ঈদের দিন সিয়াম পালন করলে ঈদের দিনের কাজসমূহ যথাযথ পালন করা যাবে না। সেজন্য হাদিসে ঈদের দিন সিয়াম পালন করা থেকে বিরত থাকার নির্দেশ এসেছে। বোখারি ও মুসলিম শরিফে বর্ণিত আছে, রাসূল (সা.) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার দিনে রোজা রাখতে নিষেধ করেছেন।

ঈদে করণীয় : ঈদ আমাদের জন্য এক বিরাট নিয়ামত। এ দিনে অনেক কাজ আছে যার মাধ্যমে আমরা আল্লাহ তায়ালার নিকটবর্তী হতে পারি এবং ঈদ উদযাপনও একটি ইবাদতে পরিণত হতে পারে। যেমন- ফজরের নামাজ জামায়াতে আদায় করা। আমরা অনেকেই ফজরের নামাজ আদায় করিনা। ঈদের জন্য ফজরের নামাজ জামায়াতে পড়ার গুরুত্বও দেয় না। অথচ ফজরের নামাজের গুরুত্ব অপরিসীম। রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যদি তারা এশা ও ফজর নামাজের মধ্যে কী আছে তা জানতে পারতো তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দুটি নামাজের জামায়াতে শামিল হত।’ (বোখারি)

ঈদের সালাত আদায় করা : ঈদের দিনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ঈদের সালাত আদায় করা। প্রকৃতপক্ষে একজন ঈমানদার বান্দাহ সালাত আদায়ের মাধ্যমে বেশি আনন্দিত হয়ে থাকে। হাদিসে এসেছে, ‘নবী করিম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে বের হয়ে দু রাকাত ঈদের সালাত আদায় করেছেন। এর পূর্বে ও পরে অন্য কোন নামাজ আদায় করেননি।’ (বোখারি)

ঈদের দিন গোসল করার মাধ্যমে পরিষ্কার-পরিচ্ছছন্নতা অর্জন করা একান্ত প্রয়োজন। কেননা এ দিনে সকল মানুষ সালাত আদায়ের জন্য মিলিত হয়। ইবনে ওমর (রা.) থেকে বিশুদ্ধ সূত্রে বর্ণিত যে, ‘তিনি ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে গোসল করতেন। ( বায়হাকি)

ঈদুল ফিতরের দিনে ঈদের সালাত আদায়ের পূর্বে খাবার গ্রহণ করা এবং  ঈদুল আজহার দিন ঈদের সালাতের পূর্বে কিছু না খেয়ে সালাত আদায়ের পর কোরবানির গোশত খাওয়া সুন্নত। হযরত বুরাইদা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘নবী করিম (সা.) ঈদুল ফিতরের দিনে না খেয়ে বের হতেন না, আর ঈদুল আজহার দিনে ঈদের সালাতের পূর্বে খেতেন না।’ (তিরমিযি)

ফিতরাহ দেয়া : রমজান মাসে সিয়ামের ত্রুটি-বিচ্যুতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্তদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমাণের যে খাদ্য সামগ্রী দান করা হয়ে থাকে, শরীয়াতের পরিভাষায় তাকেই যাকাতুল ফিত্র বা ফিতরাহ বলা হয়ে থাকে।  হাদিসে বর্ণিত, ‘রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের সালাতে যাওয়ার পূর্বে ফিতরাহ আদায় করার আদেশ দিলেন।’ (সহীহ বুখারি : ১৫০৩)

এতিম অভাবীকে খাবার খাওয়ানো : এতিমের খোঁজ-খবর নেয়া, তাদের খাবার খাওয়ানো এবং সম্ভব হলে তাদের নতুন কাপড়ের ব্যবস্থা করে দেয়া। এটা ঈমানদারদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘তারা খাদ্যের প্রতি আসক্তি থাকা সত্ত্বেও মিসকিন, এতিম ও বন্দিকে খাদ্য দান করে।’ (সূরা আদদাহর : ৮)

আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া : ঈদের সময় বিভিন্ন আত্মীয়-স্বজনের খোঁজ-খবর নেয়া ও তাদের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার বিশেষ সুযোগ তৈরি হয়। এ সম্পর্কে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে আখেরাতে বিশ্বাস করে, সে যেন আত্মীয়-স্বজনের সাথে সম্পর্ক বজায় রাখে। (বোখারি)

প্রতিবেশীর খোঁজ-খবর নেয়া : ঈদের সময় প্রতিবেশীর হক আদায়ের সুযোগ তৈরি হয়। আল কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তোমরা ইবাদত কর আল্লাহর, তাঁর সাথে কোন কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার কর মাতা-পিতার সাথে, নিকট আত্মীয়ের সাথে, এতিম, মিসকিন,  প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথী, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সাথে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না তাদেরকে, যারা দাম্ভিক, অহঙ্কারী।’ (সূরা নিসা : ৩৬)

মন-মালিন্য দূর করা : জীবন চলার পথে বিভিন্ন পর্যায়ে কারো কারো সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঈদের সময় পারস্পরিক মন-মলিন্য দূর করা ও সম্পর্ক সুদৃঢ় করার উত্তম সময়। হাদিসে এসেছে, রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘কোন মুসলিমের জন্য বৈধ নয় যে তার ভাইকে তিন দিনের বেশি সময় সম্পর্ক ছিন্ন রাখবে। তাদের অবস্থা এমন যে দেখা সাক্ষাৎ হলে একজন অন্য জনকে এড়িয়ে চলে। এ দুজনের মাঝে ওই ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে প্রথম সালাম দেয়।’ (মুসলিম)

আনন্দ প্রকাশ  করা : ইসলাম এমন একটি জীবনব্যবস্থা যেখানে সুস্থ বিনোদনের সুযোগ রয়েছে। উম্মুল মোমেনিন হযরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন : ‘রাসূল (সা.) ঈদের দিন আমার ঘরে আগমন করলেন, তখন আমার নিকট দুটি ছোট মেয়ে গান গাইতেছিল, বুয়াস যুদ্ধের বীরদের স্মরণে। তারা পেশাদার গায়িকা ছিল না। ইতোমধ্যে আবু বকর (রা.) ঘরে প্রবেশ করে এই বলে আমাকে ধমকাতে লাগলেন যে, নবীজির ঘরে শয়তানের বাঁশি? রাসূল (সা.) তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘মেয়ে দুটিকে গাইতে দাও হে আবু বকর! প্রত্যেক জাতির ঈদ আছে, আর এটি আমাদের ঈদের দিন।’ (বোখারি)

ঈদ সব মানুষকে একই উঠোনে এনে দাঁড় করায় এবং সকলকে বুকে বুক মিলিয়ে, গলায় গলা মিলিয়ে এক আনন্দ সৌকর্য বিমণ্ডিত হৃদয় দেওয়া-নেওয়ার অনন্য অনুভব জাগিয়ে তোলে। ঈদ কেবল পার্থিব আনন্দ-উৎসব নয়, ঈদ ইবাদতেরও অন্তর্গত। ঈদ মানুষকে আত্মিক উত্কর্ষ ও পরিতৃপ্তির পথ নির্দেশনা দেয় এবং আল্লাহ জাল্লাশানুহুর সন্তুষ্টি ও নৈকট্য লাভের সুপ্রশস্ত সড়ক নির্মাণ করে।

ঈদ বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব গড়ে তোলার তাকিদে সমুজ্জ্বল। সমগ্র পৃথিবীর মানুষ একটি জাতি- কোরআন মজিদে উল্লেখিত এই অনন্য চেতনার অনুরণন ও স্পন্দন ঈদুল ফিতরে ভাস্বর হয়ে ওঠে। মানুষে মানুষে ঐক্য ও বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের এক সংযমী জীবনের চেতনাই ঈদুল ফিতরের চেতনা এবং এখানেই নিহিত রয়েছে সিয়াম ভাঙার এই উৎসবের প্রকৃত আনন্দ বৈভব। আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ এবং শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে আমরা ঈদ উদ্যাপন করবো ইনশাআল্লাহ। সবাইকে ‘ঈদ মোবারক’।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জুন ২০১৭/আসিফ/এনএ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়