ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

‘সুযোগ আছে, পৃষ্ঠপোষক নেই’

আরিফ সাওন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০২, ২৯ জুন ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘সুযোগ আছে, পৃষ্ঠপোষক নেই’

আরিফ সাওন : ‘ভাওয়াইয়া গান আমাদের মাটির গান, মায়ের গান। এটা নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে, কিন্তু আমাদের দেশে পৃষ্ঠপোষক নেই।’

রাইজিংবিডির সঙ্গে একান্ত আলাপে এসব কথা বলেন জনপ্রিয় ভাওয়াইয়া শিল্পী সফিউল আলম রাজা। যাকে কেউ চেনেন ‘ভাওয়াইয়া রাজা’কেউবা ‘ভাওয়াইয়ার রাজকুমার’ আবার কেউ চেনেন ‘ভাওয়াইয়ার ফেরিওয়ালা’হিসেবে। গত ২৪ জুন রাজধানীর মীরপুর সাড়ে এগারোয় নিজের প্রতিষ্ঠিত কলতান সাংস্কৃতিক একাডেমিতে বসে রাইজিংবিডির সঙ্গে কথা বলেন সফিউল আলম রাজা। আজ তৃতীয় পর্ব।

ভারতের প্রয়াত লোকসংগীত শিল্পী ও গবেষক কালিকা প্রসাদ লোকসংগীত নিয়ে গবেষণা করেছেন। আমরা জানতামও না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লোকসংগীত রচনা করেছিলেন। কিন্তু তার গবেষণায় এটি উঠে এসেছে। আমরা লোকসংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ হয়েও গবেষণায় কেন পিছিয়ে আছি? এমন প্রশ্নের জবাবে সফিউল আলম বলেন, ‘কালিকা প্রসাদ গবেষণা করেছেন, ঠিক আছে। সম্মান রেখেই বলছি, তার সঙ্গে অনেক বিষয়ে আমার দ্বিমত। আমি ভাওয়াইয়া নিয়ে স্পেশালি কাজ করছি। কালিকা প্রসাদ একটু ভাওয়াইয়া, একটু লালন, একটু হাসন- সব নিয়ে কাজ করেছেন। তাদের দেশে অনেকে সেটা সমর্থন করেছে। কিন্তু আমার দেশে কেউ করে না। আমি রাজা ভাওয়াইয়া নিয়ে কাজ করছি, আমার দেশের কোনো মন্ত্রী বা কে আছে আমাকে হেল্প করার মতো? কেউ নাই। তার মানে হচ্ছে, আমাদের দেশে গবেষণার সুযোগ নেই। সুযোগ একেবারে নেই বলব না। সুযোগ আছে। কিন্তু কোনো পৃষ্ঠপোষক নেই।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে তো যেদিকে তাকাই, সেদিকেই মাটির সুর। আমাদের সম্পদ নিয়ে কাজ করার, লোকসংগীত নিয়ে কাজ করার, গবেষণা করার প্রচুর সুযোগ আছে। কিন্তু পৃষ্ঠপোষকতা একেবারেই নেই, কি সরকারি, কি বেসরকারি। সরকার থেকে, যখন দেখবে যে মিডিয়া একটু নাড়াচাড়া দিয়ে ফেলছে, তখন হয়তো একটু এগিয়ে আসল। তখন হয়তো একটা প্রতিষ্ঠান হলো। উন্নয়ন বলতে শুধু একটা ঘর বা বিল্ডিং হলে হয় না। তোমার ভেতরের নৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে না। মানবিক উন্নয়ন হচ্ছে না। হৃদয়ঘটিত উন্নয়ন হচ্ছে না। তুমি বিল্ডিং দিয়ে কী করবা?’



উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ‘আমাদের হানিফ সংকতে একবার বলছিলেন, খাদ্য ভবন আছে খাদ্য নেই। হয়তোবা কেউ ভাওয়াইয়া ভবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছেন। আছে না কেউ, ভাওয়াইয়া গান গাইতে পারে না, ভাওয়াইয়া চিনল না, সুর বুঝল না, ভবন নিয়ে চিন্তা। মানে ওনার থাকার জায়গা নেই। আগে থাকতে হবে, এই আরকি। আমার দুঃখের জায়গাটা এটা।’

ভাওয়াইয়ার রাজকুমার বলেন, ‘আমাদের লোকসংগীত শিল্পীদের গান মানুষ শুনছেন না? শুনছে। কিন্তু আমাদের যে পরিমাণ প্রোমোট করা উচিত কেউ সেভাবে সহযোগিতা করছে না। লোকসংগীত শিল্পীরা বড় বেশি অবহেলিত। সব জায়গায় অবহেলিত, যেমন: রেডিও। রেডিওতে আমি সর্বোচ্চ গ্রেডের শিল্পী। ছয়-সাত বছর আগে আমি সর্বোচ্চ গ্রেড পেয়েছি। কোনোদিন লোকসংগীত শিল্পীদের নিয়ে রেডিওতে স্পেশাল প্রোগাম করছে না। আধুনিক বা কিছু বস্তাপচা গানের প্রতিদিন স্পেশাল রেকর্ড হচ্ছে। স্পেশাল প্রোগাম হচ্ছে। লোকসংগীত শিল্পীদের নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই। এই মানুষগুলোই আবার বলে, লোকসংগীত আমাদের সম্পদ, ইতিহাস ঐতিহ্য, এটা রক্ষা করতে হবে। স্টেজে–টেলিভিশনে বক্তৃতায় আমরা ফাটিয়ে ফেলি। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবতা ভিন্ন হওয়ার কারণ হচ্ছে, দেশপ্রেম না থাকা।’

দেশপ্রেম না থাকার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘শৈশবকাল হচ্ছে দেশপ্রেম গড়ার সময়। কিন্তু সেই জায়গাটায় গলদ থেকে যাচ্ছে। শৈশবে যদি দেশপ্রেম তৈরি করা হয়, এটা তোমার মাটির গান, এটা তোমার মায়ের গান, এটা তোমার মায়ের ভাষা, তাহলে তাকে সারা জীবন ওই শিক্ষাটাই প্রভাবিত করবে।’

‘আমার একটি বিষয় খুব মনে পড়ে, আমি যখন প্রাইমারিতে, তখন স্কুলে যাওয়ার সময় বইগুলো হাতে দিয়ে মা আমাকে একুট আদর করে বলতেন, বাবা, বড়দের দেখলে সম্মান করবে, পাগলদের দেখলে ঢিল ছুড়বে না। এরকম কয়েকটা কথা বলে দিতেন। সেই কথাগুলো আমার ভেতরে প্রভাব ফেলেছে। আজো পাগল দেখলে মায়ের কথা মনে পড়ে। আজ আমার মা নেই। কিন্তু কথাগুলো তো মনে পড়ছে। এসব বোধ ছোটবেলায় ঘর থেকে, স্কুল থেকে তৈরি হয়। শৈশব থেকে ছেলেমেয়েদের দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করতে না পারলে আমরা কোনোকিছুই ঠিক করতে পারব না,’ বলেন সফিউল আলম রাজা।

তিনি আরো বলেন, ‘অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলি- ছেলেমেয়েরা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে বলে চীনে ফেসবুক বন্ধ করা হয়েছে। তাদের ছেলেমেয়েরা যেন ভালো থাকে, সুস্থ থাকে, তাদের কালচার যেন থাকে। আমারা কী করেছি? আমাদের দেশে দশ দিন ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছে, তাতে পারলে মানুষ সুইসাইড করে ফেলে। এটার কারণ কী? কারণ হচ্ছে, আমাদের অধিকাংশ মানুষেরই দেশপ্রেম নাই। দেশপ্রেম যদি থাকত, তাহলে একটা সিস্টেমের মধ্যে আমরা রাখতে পারতাম। প্রথমে দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে।’

**‘ইউ আর গ্রেট সিংগার ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’​

**‘দেশীয় সংস্কৃতির বিকৃতি বন্ধ করা দরকার’​



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৯ জুন ২০১৭/সাওন/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়