ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

‘শিলং তীর’র ভয়ঙ্কর ছোবলে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সিলেটবাসী

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৬, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
‘শিলং তীর’র ভয়ঙ্কর ছোবলে সর্বস্বান্ত হচ্ছে সিলেটবাসী

কেএমএ হাসনাত : ১০ টাকার বিনিয়োগে ৭০০ টাকা লাভ। অর্থাৎ ৭০ গুণ লাভের লোভ দেখিয়ে অনলাইনভিত্তিক জুয়াড়ি ‘শিলং তীর’-এর মরণ ছোবলে সর্বস্বান্ত হচ্ছে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের বিশাল জনগোষ্ঠী।

বয়স্ক থেকে শুরু করে কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও এ মরণ নেশায় জড়িয়ে পড়ছে। আর এটা বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সিলেট বিভাগীয় প্রশাসন থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) সচিব সারোয়ার হোসেন রাইজিংবিডিকে বলেন, মন্ত্রণালয় থেকে চিঠি পাওয়ার পরেই বিষয়টি নিয়ে আমরা কাজ করছি। এরই মধ্যে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। www.teercounter.com নামের একটি সাইট বাংলাদেশে বন্ধ করা হয়েছে। চক্রটি হয়তো অন্য কোনো নামে এ অবৈধ কাজ করছে। আমরা আরো খোঁজ নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সিলেট বিভাগীয় কমিশনার ড. মোছাম্মৎ নাজমানারা খানুম সম্প্রতি বিটিআরসির চেয়ারম্যানকে বিষয়টি অবহিত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য একটি চিঠি দেন। চিঠির অনুলিপি মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের সচিবকে দেওয়া হয়।

সিলেট বিভাগীয় কমিশনার তার চিঠিতে www.teercounter.com বন্ধ করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানান। চিঠিতে বলা হয়েছে, সিলেট বিভাগের জেলাসমূহে বিশেষ করে ভারত সীমান্তবর্তী বিভিন্ন উপজেলায় নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ওয়েবসাইট www.teercounter.com ব্যবহার করে ‘শিলং তীর’ লেখা নামক অবৈধ লটারি/জুয়া বিস্তার ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিন বিকেল ৪টা থেকে বিকেল সোয়া ৫টায় একবার নেটে উপরোক্ত ওয়েবসাইটে লটারির ফলাফল ঘোষণা করা হয়।

চিঠিতে বলা হয়েছে, সিলেট মহানগর এলাকার বিভিন্ন স্থানে আয়োজকরা এজেন্ট নিয়োগ করে এবং এজেন্টের মাধ্যমে লটারিতে অংশগ্রহণে আগ্রহী ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ হরে। এরপর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ফলাফল তারা মোবাইলে দেখিয়ে এবং বিজয়ীদের অর্থ পুরস্কার দেওয়া হয়।

উল্লেখ্য, নেটে সংখ্যাটি উঠলে আয়োজক বিজয়ীদের ৭০ গুণ বেশি অর্থ পুরস্কার প্রদান করে। অবৈধ এ লটারির নেশায় পড়ে নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষেরা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন। বিশেষ করে গৃহিণী, দিনমজুর, রিকশাচালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীসহ নিম্ন আয়ের লোকজন পরিবারকে বঞ্চিত করে কষ্টার্জিত অর্থ এই অবৈধ পথে বাজি ধরছেন এবং সামাজিক নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের অবক্ষয় হচ্ছে।

বিভাগীয় কমিশনার ব্যক্তিগতভাবে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান করে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন চিঠিতে। তিনি লিখেছেন, মাঠ পর্যায়ে পরিদর্শনকালে স্থানীয় জনগণের কাছ থেকে  এ ধরনের আসক্তির ভয়াবহ চিত্র সম্পর্কে অবগম হয়েছি এবং স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি, জনপ্রতিনিধিরা এ ওয়েবসাইট বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেন। তাছাড়া গত ১৭ জুলাই সিলেট বিভাগীয় আইনশৃঙ্খলা কমিটির সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয় এবং অপরাধমূলক জুয়া থেলা থেকে সাধারণ জনগণকে রক্ষার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়।

বিটিআরসি সূত্রে জানা গেছে, বিভাগীয় কমিশনারের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে এরই মধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তারা কাজ করছে বলে জানিয়েছেন বিটিআরসির সচিব।

সিলেটের জালালাবাদ থানা এলাকার পুরান কালারুকা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাইফুল ইসলাম রাইজিংবিডিকে বলেন, আমার অনেক শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ের পাশের বাজারে গিয়ে জুয়া খেলে। শুনেছি সেখানে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা বিনিয়োগ করা যায়। এরপর একটি নাম্বার দেওয়া হয়। ওই নম্বর যদি  ইন্টারনেটে আসা নম্বরের সঙ্গে মিলে যায় তাহলে ৯ থেকে ১০ গুণ বেশি টাকা দেওয়া হয়।

কালারুকা গ্রামের স্থানীয়দের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, স্থানীয় ইসলামগঞ্জ বাজারে সুজন উদ্দীন নামের এক যুবক জুয়ার এই ব্যবসা পরিচালনা করেন।

জানা গেছে, উত্তর সিলেটের জুয়ার মূলকেন্দ্র শহরতলির টুকেরবাজার। সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ এসে জুয়ায় টাকা বিনোয়োগ করেন। সুজন ওই বাজার থেকে মাসিক এক লাখ টাকায় জুয়ার অনুমোদন নিয়ে এসেছেন। তাকে সহায়তা করছেন এলাকার প্রভাবশালী এক ব্যক্তি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সীমান্তবর্তী সিলেটের একেবারে কাছেই অবস্থান ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ের। সিলেটের তামাবিল সীমান্ত পেরোলেই ওপারে শিলংয়ের পথ। শিলংয়ে জুয়াড়িদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় জুয়ার আসর হচ্ছে ‘তীর’। ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত সংখ্যাভিত্তিক এই জুয়া এখন মহামারিরূপে ছড়িয়ে পড়েছে সিলেটজুড়ে। শুরুতে নির্দিষ্ট দু-একটি জায়গায় এ সর্বনাশা জুয়ার আসর বসলেও এখন তা লাগামীহন। গত প্রায় দুই বছরে সিলেট মহানগরীর অর্ধশতাধিক স্পট এবং বিভিন্ন উপজেলায়ও ছড়িয়ে পড়েছে ভয়ঙ্কর এই ‘শিলং তীর’ নামক জুয়ার আসর।

চেষ্টা করেও ‘শিলং তীর’র ভয়ঙ্কর ছোবল রুখতে পারছে না পুলিশ। এ জুয়া অনলাইনভিত্তিক হওয়ায় এবং জুয়াড়িরা মোবাইলের মাধ্যমে পরস্পর যোগাযোগ রাখায় পুলিশ এদের রুখতে পারছে না। মাঝে মধ্যে চিহ্নিত জুয়ার স্পটে অভিযান চালিয়ে কয়েকজন জুয়াড়িকে আটক করাতেই সীমাবদ্ধ পুলিশের তৎপরতা।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের শিলং থেকে ‘শিলং তীর’ নামক জুয়া বছর কয়েক আগে সিলেটের সীমান্তবর্তী উপজেলা গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর ও কানাইঘাটে বিস্তার লাভ করে। এসব উপজেলা থেকে গত প্রায় দুই বছরে এ জুয়া মহামারিরূপে ছড়িয়ে পড়তে থাকে সিলেট মহানগরী ও অন্য উপজেলাগুলোয়। বর্তমানে শুধুমাত্র সিলেট মহানগরীর অন্তত অর্ধশত স্পটে বসে ভয়ঙ্কর এ জুয়ার আসর। এসব আসরে লাভের আশায় টাকা খরচ করা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষরা সর্বস্বান্ত হয়ে ফেরেন।

শুরুর দিকে সিলেট নগরীর বিমানবন্দর থানাধীন বড়শালা এলাকায় ‘শিলং তীর’র আসর বসত। কৌশলী জুয়াড়িরা সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়াতে দেদারসে জুয়ায় টাকা ঢালতে থাকে। এতে রিকশাচালক, দিনমজুর শ্রেণির মানুষদের ভিড় বাড়ে জুয়ার আসরে। ১০ টাকায় ৭০০ টাকা, ২০ টাকায় ১৪০০ টাকা তথা প্রতি টাকার বদলে ৭০ গুণ লাভ পেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে মানুষ। ক্রমেই সর্বনাশা এ জুয়ার বিস্তার ঘটতে থাকে সিলেটজুড়ে।

জানা গেছে, বর্তমানে সিলেট নগরীর কাজিরবাজার, সুরমা মার্কেট, করিম উল্লাহ মার্কেট, বালুচর, বড়বাজার, বন্দরবাজার, রিকাবিবাজার, তালতলা, মদিনা মার্কেট, লালদিঘীরপাড় হকার্স মার্কেট, সিটি মার্কেট, শাহী ঈদগাহ, আম্বরখানা, শেখঘাট, মালনীছড়া চা বাগান, কুয়ারপাড়, চাঁদনিঘাট, দক্ষিণ সুরমার কদমতলির বালুর মাঠ, পুরাতন রেলস্টেশন এলাকা, লাউয়াই, কামালবাজারসহ অর্ধশত স্পটে প্রতিদিন বসে ‘শিলং তীর’র জুয়ার আসর।

জুয়ার আসরে রিকশাচালক, দিনমজুর, শিক্ষার্থী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে জুয়ার নেশায় মত্ত বড় ব্যবসায়ীরাও টাকা ঢালছেন। হাতেগোনা কয়েকজন জুয়ার আসর থেকে হাসিমুখে ফিরলেও সিংহভাগই ফেরেন টাকা খুইয়ে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শিলংয়ের জুয়াড়িদের সঙ্গে সিলেটের জুয়াড়িদের যোগাযোগ রয়েছে। শিলংয়ের জুয়াড়িরা সিলেটের শীর্ষ জুয়াড়িদের মাধ্যমে বেশ কিছু এজেন্ট নিয়োগ করেছে। এসব এজেন্টদের মাধ্যমেই সিলেটজুড়ে ‘শিলং তীর’ পরিচালিত হচ্ছে।

এ জুয়ায় ১ থেকে ৯৯ পর্যন্ত সংখ্যা দিয়ে বাজি ধরতে হয়। একটি সংখ্যার বিপরীতে সর্বনিম্ন ১০ টাকা থেকে বাজি ধরা শুরু হয়। বাজির সর্বোচ্চ অংক অনির্ধারিত। ১ থেকে ৯৯ সংখ্যাগুলোর মধ্যে যে নির্দিষ্ট সংখ্যায় বাজি ধরা হয়, সে সংখ্যা যদি বিজয়ী হয়, তবে বাজি ধরা ব্যক্তি নির্দিষ্ট টাকার ৭০ গুণ বেশি পান। অর্থাৎ, কেউ যদি এক হাজার টাকা বাজি ধরে বিজয়ী হন, তবে তিনি পান ৭০ হাজার টাকা। বাজিতে প্রাপ্ত টাকার অংক কম হলে সঙ্গে সঙ্গেই পরিশোধ করা হয়। টাকার অংক বেশি হলে পরদিন তা পরিশোধ করা হয়। একই ব্যক্তি একাধিক সংখ্যা নিয়ে জুয়া খেলতে পারেন।

সূত্র জানায়, প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত চলে ‘শিলং তীর’র জুয়া। শিলংয়ের সঙ্গে মিলিয়ে সিলেটে সপ্তাহে রোববার ছাড়া বাকি ছয় দিনই এ জুয়ার আসর বসে। ভারতের সরকারি ছুটির দিনে এ জুয়ার আসর বন্ধ থাকে। প্রতিদিন বিকেল ৫টায় জুয়ার ফলাফল ঘোষণা করা হয়।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, www.teercounter.com, www.teerresults.com, www.gravatar.com, www.meghalayateer.com, www.nightteer.com, www.teerresulttoday.com প্রভৃতি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ‘শিলং তীর’র জুয়ার আসর পরিচালিত হচ্ছে। এসব সাইট বাংলাদেশে বন্ধ করে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) পুলিশ চিঠি দিয়েছে।

সিলেট পুলিলের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘শিলং তীর’ নামক জুয়া মূলত ওয়েবসাইটের মাধ্যমে চলে। পুলিশ কিছু ওয়েবসাইট চিহ্নিত করে সেগুলো বন্ধের জন্য বিটিআরসিকে চিঠি দিয়েছে। যেসব ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ‘শিলং তীর’ নামক জুয়া চলে, সেগুলো বন্ধ করা হলেই এ জুয়ার মহামারি রোধ করা সম্ভব হবে।

ওই কর্মকর্তা বলেন ‘শিলং তীর’র বিভিন্ন আসরে প্রায় নিয়মিতই অভিযান চালানো হয়। এতে জুয়াড়িরা ধরাও পড়ে। কিন্ত পরবর্তীতে এরা জামিনে বেরিয়ে এসে ফের এ জুয়ায় লিপ্ত হয়।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭/হাসনাত/মুশফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়