ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

পাহাড়ে এক সন্ধ্যায় বন মোরগের পেছনে

ফেরদৌস জামান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:০১, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
পাহাড়ে এক সন্ধ্যায় বন মোরগের পেছনে

ফেরদৌস জামান : পরিচিত বসতি বমপাড়া। গাছে গাছে ঝুলে নেই কাঁঠাল, আম, লিচু আর তেঁতুল। এখন শীতকাল, সব গাছ প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে পাতা ঝরে যাবে। আবার  ক’মাস পরেই আসবে মুকুল; নানা রকম ফলে ফলে ভরে উঠবে। নীরব নিস্তব্ধ চারদিক অথচ বহু পরিবারের বসবাস। নৃগোষ্ঠী বম স্বভাবে ভিষণ নম্র এবং স্বল্পভাষী। বিনা প্রয়োজনে কথা না বলা তাদের স্বভাব। আনাই আমাদের সরাসরি তার ঘরে নিয়ে গেল। ছেলেমেয়েরা খেলাধুলায় ব্যস্ত। স্ত্রী এবং মা পিঠে ঝুরি নিয়ে এইমাত্র জুম থেকে ফিরল। পরবর্তী ফসল ফলানোর জন্য ক্ষেত প্রস্তুতের কাজ চলমান। পারিবারের নারী সদস্যরা রান্না করে রাখবে যাতে পুরুষ ঘরে ফিরেই খাবার পায়। রাতের খাবার সন্ধ্যায় গ্রহণ করা তাদের রীতি। সুতরাং ঘরে ফিরেই খাবার চাই। পরিবারের সকল সদস্য জুমে গেলেও আনাই যায়নি। কারণ রোয়াংছড়ি আসাটা তার জন্য জরুরি ছিল। বাড়ির পাশে উঠানের কাঁঠালতলায় পাকা করা চৌবাচ্চা। কল ছাড়লেই ঝরঝর করে পানি ঝরে। ঝরনা থেকে টেনে আনা ঠান্ডা পানি। উন্মুক্ত জায়গায় গোসল করা আমাদের মতো শহুরেদের জন্য অস্বস্তিকর ব্যাপার হলেও দিনে দিনে তা অভ্যাস হয়ে গেছে।

টলটলে ঠান্ডা পানিতে গোসল করে শরীর ও মনে ফিরে এল চনমনে অনুভূতি। শীতের দিন, গোসলের পর শরীরের এমন চড়চড়ে অবস্থায় খাঁটি সরিষার তেল ঘষতে পারলে মন্দ হতো না- সুজিতের এমন মন্তব্য যথার্থ ছিল। তখনও জানি না একটু বাদে যে অভিজ্ঞতা হতে যাচ্ছে তা আমাদের কখনও ছিল না। আনাই শিকারে যাবে। বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে বুনো মোরগ শিকারের উৎকৃষ্ট সময়। আমাদের পেয়ে সে বেশ উচ্ছ্বসিত। পাহাড়ি মুরগির মাংস খেতে খুব মজা- এই বলে তার মুখমণ্ডলে এমন তৃপ্তির ভঙ্গি ফুটে উঠল যেন এখনই এক টুররো খেলো। তারপর একটা হাসি- হা হা হা। ওমনি পান খাওয়া লাল ঠোঁটজোড়ার মাঝ থেকে বের হলো লাল রঙের কয়েকটা মজবুত দাঁত। উচ্ছলতায় আমরাও কম গেলাম না, শিকারে যাব একজন মোটামুটি দক্ষ শিকারীর সাথে। পেটে ভিষণ ক্ষুধা। এক থাল ভাত আর লবণ পেলেই মেরে দেয়া যেত। ব্যাগ থেকে কিছু শুকনো খাবার বের করে মুখে দিয়ে ছুটলাম শিকারীর পেছন পেছন। বসতির মূল পথ থেকে যখন জঙ্গলে প্রবেশ করব ঠিক তার মুখে ফাঁদ পাতা। জঙ্গলের শেষ আর বসতির শুরু, এই অংশটুকু দিয়ে উড়ে যায় পাখি, বটকল পাখি। টিয়ার মাঝে হালকা ধূসর ও খয়েরি রঙের পালকে আবৃত বটকল পাখি। দেখলেই শান্তির অনুভূতিতে দুচোখ জুরিয়ে যায়। পনের ফুট লম্বা দুই বাঁশের খুঁটির সাথে বাঁধা বড় জাল। জাল বাঁধা খুঁটি খাড়া করে দেয়া হয়েছে পাখির উড়ে যাওয়ার পথে। প্রতি ঝাক থেকে দুই চারটা করে ধরা পরছেই। ফাঁদ পাতা শিকারী সম্পর্কে আনাইয়ের মামা। তার সঙ্গে দুচার কথা হতে হতেই উপর থেকে এক সাথে কয়েকটা পাখির ছটফটানির শব্দ কানে এলো। পায়ের নখের সাথে জড়িয়ে পেঁচিয়ে যায়, ফলে পাখি আর মুক্ত হতে পারে না। উৎফুল্ল মামা জাল নামিয়ে এক এক করে পাখি ছাড়ায় এবং পাখার পালকগুলো উপড়ে ফেলে, এতে করে পাখি ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। মামা-ভাগ্নের কাণ্ড দেখে হতভম্ভ হয়ে গেলাম! পালক উপড়ানো পঙ্গু পাখি এক পা নড়তে পারে না। একটু আগেই মুক্ত আকাশে ফরফর করে উড়ে বেড়ানো বটকল পাখি পঙ্গু দশায় ঝিম ধরে থাকে, যেন বুঝে উঠতে পারে না মুহূর্তেই কি পরিণতি ঘটল!

দেশের মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন এই মানুষেরা খাদ্যের চাহিদা পূরণে আর কিইবা করতে পারে? বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে নিশ্চই এমন হীন কাজ করতে পারত না। আমরা প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলি কিন্তু বিকল্প ব্যবস্থা ভাববার সময় নেই। পথ ধরলাম একই কর্মের ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশ্যে। বোধহয় পাঁচ মিনিটও অতিবাহিত হয়নি, মামার আনন্দে আত্মহারা চিৎকার- আনাই, আনাই! তারপর আরও কি কি বললো তা বুঝলাম না। এক দৌড়ে ফিরে দেখি ফাঁদে আবারও পাঁচ-ছয়টা পাখি ছটফট করছে। মামা তখনও নিজ ভাষায় আনন্দ প্রকাশ করে যাচ্ছে। একে একে সব পাখি জাল থেকে অপসারণ করে আনাই তার কাঁধে ঝুলানো থলিতে একটা ঢুকিয়ে ফেলল। মামার কথায় আন্দাজ করা গেল, চাইলে আরও একটা নিতে পারে।



চোখের সামনে কি নৃশংস ঘটনা ঘটে গেল, মধ্যবিত্ত স্বভাবসুলভ আফসোস করতে করতে ক্যামেরায় কয়েকটা ছবি তোলা ছাড়া কিছুই করতে পারলাম না। হাঁটতে থাকলাম মোরগ শিকারে। এগিয়ে যাচ্ছি এক পাহাড়ের পর আরেক পাহাড়ে। বিকেলের রোদ এখন পাহাড়ের মাথায়। সামনের জুম ঘরটায় একটা বিরতি না দিলেই নয়। পাহাড়ের মাথায় জুম ঘরের সোলালী চালে রোদ পরেছে। পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে জুম থেকে ফেরা ঘরমুখো মানুষেরা। এখনই যা ঘটতে যাচ্ছে তা অল্পক্ষণ আগেও আন্দাজ করতে পারিনি। আনাই ব্যাগ থেকে পঙ্গু বটকল পাখিটা বের করে গুলতি দিয়ে ঠকঠক দুই আঘাতেই তার মৃত্যু নিশ্চিত করল। দক্ষ হাতে সমস্ত পালক, চামড়া ও অবাঞ্ছিত অংশ ফেলে দেয়ার পর অল্পক্ষণ আগে জীবিত পাখিটা এখন একটা মাংসের টুকরো! ঘরের পাশে স্তূপ করে রাখা শুকনো ঝনঝনে তিল গাছের আঁটি। বাঁশের কাঠিতে ফুড়ে নিয়ে তিল গাছের গনগনে আগুনে পাখি ঝলসানো শুরু হলো। আনাইয়ের চোখে মুখে তৃপ্তির আগাম বহিঃপ্রকাশ। লাল দাঁতগুলো আগুনের এপাশ থেকেও জ্বলজ্বল করছে। ঝলসানো পাখি ভেঙ্গে তিন-চার টুকরো করে সামনে ধরে বলল, এই নেন খেলেই বুঝবেন কি স্বাদ! অবাক হলাম, ব্যথা পেলাম, ধিক্কার দিলাম আবার ছবি তুললাম এবং স্বাদও নিলাম। বাকি রইল নিজের প্রতি অভিসম্পাত করা- যা আমরা কখনই পেরে উঠি না।

সন্ধ্যা নেমে যাবে ঠিক তার আগের সময়টুকু মোরগ শিকারের উপযুক্ত। একমাত্র এই সময়টাতে যে যার অবস্থান থেকে কুক কুরু কু... ডাক দেয়। কিসের সংকেত তা ওদেরই জানা। গভীর মনোযোগ দিয়ে শিকারীরা শোনে এবং অনুমান করে ঠিক কোন জায়গা থেকে মোরগ ডাকের শব্দ আসছে। তারপর সেই লক্ষে সন্তর্পণে এগিয়ে যাওয়া। গুলতি তাক করে এগিয়ে যাচ্ছে শিকারী আনাই বম, পিছে পিছে আমরাও। শক্ত ডাল কেটে বানানো গুলতির রাবার ফিতাজোড়ার সন্ধিতে চামড়ার টুকরো এবং তার মাঝে মারবেল সমান শক্ত মাটির কার্তুজ। টেনে ছেড়ে দেবার পর লক্ষে গিয়ে আঘত করলে শিকারের বেঁচে ফেরার সম্ভাবনা কম। গুলতির আঘাতে মোরগ নয় মানুষের মাথার খুলিও ফেটে যেতে পারে। কোন কথা বলা নিষেধ, এমনকি গাছ লতাপাতা সরানোর শব্দও নয়। খানিক এগিয়ে যাবার পর মুখে আঙুল চেপে আমাদের চুপচাপ অপেক্ষা করতে বলা হলো। সে ঠিক বুঝতে পেরেছে পশ্চিম পাশের পাহাড়টায় কলা গাছের ঝোঁপে মোরগ বসে আছে। অপেক্ষা শেষ হলো, খালি হাতে ফিরে এলো আনাই। আবারও চোখ কান সজাগ করে চারপাশ নীরিক্ষণ করতে লাগল। এবার ছুটলাম অন্য পথে। গুড়ি গুড়ি পাথর বিছানো স্যাঁতসেতে খাল ধরে এগিয়ে যাচ্ছি। ঘন অরণ্যে পথ প্রায় অন্ধকার হয়ে এলো। হতাশায় আনাইয়ের মুখে কচমচ শব্দ হয়- একটা শিকারও পেলাম না!



অন্ধকার খাল ধরেই ফিরে এলাম বসতিতে। ঘরে ঘরে আলো জ্বলছে, সোলার সিস্টেমের আলো। প্রায় প্রতি ঘরেই এই আলোর ব্যবস্থা। দুই-তিন পদের তরকারীর সাথে ভাত সাজিয়ে রাখা হয়েছে। অতিথির সম্মানে ডাল, আলু ভাজি, শুঁটকি-কুমড়ার ঝোলের পাশাপাশি সালাদ এবং শূকরের মাংস। পরের দিন হাটবার, আনাইয়ের পক্ষে আমাদের সাথে সিপ্পি যাওয়া সম্ভব না। অথচ, ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত জানতাম সে আমাদের সাথে যাচ্ছে। বাচ্চা-কাচ্চসহ বোন আসায় বাড়তি দুইজন মানুষের থাকা নিয়ে বোধহয় জটিলতার সৃষ্টি হলো। শিকার খোঁজার মতো কনকনে শীতে আনাইয়ের পিছে পিছে আবারও হাঁটছি। সামনের বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা হবার কথা। কী কারণে যেন হলো না। এবার ঐ বাড়িতে, সেখানেও হলো না। সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। পরিস্থিতি এমন হবে জানলে সোজা পরবর্তী পাড়ায় চলে যেতে পারতাম। হাতে সময়ও যথেষ্ট ছিল। বলা নেই কওয়া নেই একটা ঘরে ঢুকিয়ে বলা হলো এখানে শুয়ে থাকুন। খানিক পর নিজ ঘর থেকে অতিরিক্ত দুইটা কম্বল দিয়ে গেল। নিজের কাছে নিজেকে কেমন অপমানিত মনে হলো। কার ঘর, কার বাড়ি কিছুই জানি না। শুধু এতটুকু জানি কয়েক ঘণ্টা ঘুম দরকার।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়