ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

অস্ত্র আবিষ্কার করেও মানবকল্যাণের দৃষ্টান্ত হলেন

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৩:৫৭, ২১ অক্টোবর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
অস্ত্র আবিষ্কার করেও মানবকল্যাণের দৃষ্টান্ত হলেন

রুহুল আমিন : নোবেল পুরস্কারের কথা কম বেশি সবাই জানে। সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিতও নোবেল পুরস্কার। ১৯০১ সাল থেকেই বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে গবেষণা, উদ্ভাবন এবং মানবকল্যাণমূলক কাজের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়।

১৯০১ সাল থেকে পুরস্কার প্রদান শুরু হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য ১৯৪০ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত পুরস্কার প্রদান বন্ধ ছিল। শুরুতে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাশাস্ত্র, সাহিত্য ও শান্তি এই পাঁচটি বিষয়ে প্রতি বছর নোবেল প্রদান করা হতো। পরে ১৯৬৯ সাল থেকে অর্থনীতিতে নোবেল প্রদান শুরু হয়। যদিও নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক আলফ্রেড বের্নহার্ড নোবেল তার উইলে অর্থনীতির কথা উল্লেখ করেননি। শান্তিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় নরওয়ের অসলো থেকে।বাকি ক্ষেত্রে সুইডেনের স্টকহোম থেকে এ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্রত্যেকে একটি স্বর্ণপদক, একটি সনদ ও নোবেল ফাউন্ডেশন কর্তৃক অর্থ পেয়ে থাকেন।

আলফ্রেড বের্নহার্ড নোবেল। যার নামে পুরস্কৃত হয়ে অনেকে খ্যাতিমান হয়েছেন। তিনি একজন সুইডিশ রসায়নবিদ, প্রকৌশলী, উদ্ভাবক ও অস্ত্র নির্মাতা।তিনি ডিনামাইটের আবিষ্কারক।১৮৩৩ সালের ২১ অক্টোবর সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে তার জন্ম। তার বাবার নাম ছিল ইমানুয়েল নোবেল। ইমানুয়েল একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। আলফ্রেডের ছেলেবেলা মোটেও ভালো কাটেনি। কারণ তার জন্মের বছরই তার বাবা ব্যবসায় দেউলিয়া হয়ে যান। তিনি পরিবার রেখে ভাগ্যের সন্ধানে দেশ-বিদেশে ঘুরতে থাকেন।

অবশেষে ইমানুয়েল সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি মেকানিক্যাল ওয়ার্কশপ প্রতিষ্ঠা করেন।অবস্থা মোটামুটি ভালো হলে তিনি ১৮৪২ সালে পরিবারকে তার কাছে নিয়ে যান। তখন থেকে সেন্ট পিটার্সবার্গই হয়ে ওঠে আলফ্রেডের শহর। তবে সেন্ট পিটার্সবার্গে বসে থাকেননি আলফ্রেড। ১৮৫০ সালের দিকে তিনি পাড়ি জমান ফ্রান্সে। সেখানে প্যারিসে অবস্থিত টি জুলস পিলৌজ নামক একটি গবেষণাগারে কাজ শুরু করেন। পরে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন নোবেল কোম্পানি নামক একটি অস্ত্রের কারখানা।

১৯৫৩ সালের দিকে ক্রিমিয়া যুদ্ধ শুরু হলে বেশ লাভ করে তার কোম্পানি। কিন্তু যুদ্ধের শেষদিকে অর্ডার ওঠে যাওয়ায় তিনি অনেকটা দেউলিয়া হয়ে যান। উত্থানের পর হঠাৎ পতনে বেশ বিমর্ষ হয়ে পড়েন তিনি। তবে এতেই দমে যাওয়ার মতো ছেলে ছিলেন না আলফ্রেড। তাই তিনি পতনের পর মনোযোগ দেন নতুন পণ্য উৎপাদনের দিকে। তার এই ঝোঁকই তাকে ডিনামাইট আবিষ্কারের পথে নিয়ে যায়।

১৮৬২ সালের দিকে নাইট্রোগ্লিসারিন জাতীয় পণ্য উৎপাদনের কথা চিন্তা করেন এবং গবেষণা শুরু করেন। প্রথম উৎপাদন করেন ব্লাস্টিং অয়েল নামক এক প্রকারের বিস্ফোরক। এরপর ব্লাস্টিং ক্যাপ নামক নাইট্রোগ্লিসারিন বিস্ফোরণের ট্রিগার উৎপাদন করেন।

১৮৬৪ সালে স্টকহোমে এ কাজে গবেষণার সময় বিস্ফোরণে তার ছোট ভাই এমিল নিহত হন। তবুও দমে যাননি আলফ্রেড। তিনি ব্লাস্টিং ক্যাপ নকশার উন্নয়ন করতে থাকেন এবং ১৯৬৫ সালে স্টকহোমে প্রতিষ্ঠা করেন ‘নাইট্রোগ্লিসারিন এবি’। তারপর তিনি চলে যান জার্মানিতে।পরে জার্মানির হামবুর্গে চালু করেন ‘আলফ্রেড নোবেল অ্যান্ড কোম্পানি’। হামবুর্গের কারখানাতেও গবেষণার সময় বিস্ফোরণ ঘটে। তখন নোবেল চিন্তা করলেন আরো নিরাপদ স্থানে গবেষণা করা দরকার। যাতে মানুষের কোনো ক্ষতি না হয়। এই জন্য তিনি একটি নৌকা নিয়ে চলে যান এলবে নদীতে। ১৮৭২ সালে  নোবেলের বাবা ইমানুয়েল মারা যান।

তার আবিষ্কৃত ডিনামাইটকে মূলত তার দিয়ে দূর থেকে বৈদ্যুতিক সিগনালের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়, যা প্রচুর শক্তি নির্গত করে। কম খরচে এবং সহজে পাহাড় ভাঙা, যুদ্ধে সেতু, শত্রুপক্ষের ভবন, রেললাইন ইত্যাদি উড়িয়ে দিতে ডিনামাইট ব্যবহার হয়। ধীরে ধীরে ডিনামাইট জনপ্রিয়তা পেতে থাকে। আর এতে বদলে যেতে থাকে নোবেলের ভাগ্য। ডিনামাইট বিক্রি করে তিনি প্রচুর অর্থের মালিক হন। এতে তিনি ব্যবসায়ী ও বিজ্ঞানী হিসেবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

আলফ্রেড নোবেলের অধিকাংশ আবিষ্কারই ছিল আগ্নেয়াস্ত্র। ডিনামাইট বা অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র যেমন ব্যবহৃত হয় ধ্বংসাত্মক কাজে, তেমনি মানুষের কল্যাণের কাজেও ব্যবহৃত হয়। তবে কারণ যাই হোক এইসব আবিষ্কার করে অনেক নিন্দাও জোটে আলফ্রেড নোবেলের কপালে। তার নমুনা হলো ১৮৮৮ সালে আলফ্রেডের ভাই লুডভিগ ফ্রান্সে ঘুরতে গিয়ে মারা যায়। ওই সময় এক ফ্রেঞ্চ পত্রিকা ভুলে ধরে নেয় আলফ্রেড নোবেলই মারা গেছেন। সেই পত্রিকা তখন আলফ্রেডের মৃত্যুর সংবাদ ছাপে। সেখানে তারা আলফ্রেডেকে বর্ণনা করে ‘মৃত্যুর সওদাগর’ বলে। সেই পত্রিকায় লেখা হয়, আলফ্রেড মানুষ হত্যার বিভিন্ন অস্ত্র তৈরি করে প্রচুর টাকা উপার্জন করেছেন, কিন্তু সেই টাকা পুরো মানবজাতির কল্যাণের কোনো কাজে ব্যয় করেননি। তার প্রচণ্ড নিন্দাও করা হয়। লেখাটি আলফ্রেড নোবেল পড়েন। পড়া শেষে তিনি বেশ কষ্ট পান। অনেক চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন তার উপার্জিত অর্থ মানবকল্যাণের কাজে ব্যয় করবেন।

এ ছাড়া এক সময় তিনি অনুধাবন করেন ডিনামাইট শান্তির উদ্দেশে ব্যবহার করা যায়।আর বিজ্ঞানের আবিষ্কার যেন মানবিক কল্যাণের জন্য হয়। তাই বিজ্ঞানীদের উদ্বুদ্ধ করতে তাদের পুরস্কৃত করার চিন্তা করেন।তিনি তার উপার্জিত অর্থ দিয়ে নোবেল ইনস্টিটিউট গঠন করেন। যেখান থেকে মানবকল্যাণে শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার এবং শান্তির জন্য পুরস্কার দেওয়া হয়।
 
১৮৯৬ সালের ১০ ডিসেম্বর আলফ্রেড নোবেল ইতালিতে মারা যান। নোবেল তার জীবদ্দশায় অনেক উইল লিখে গেছেন।  মৃত্যুর এক বছর আগে ১৮৯৫ সালের ২৭ নভেম্বর প্যারিসে অবস্থিত সুইডিশ-নরওয়ে ক্লাবে সর্বশেষ উইলটি লিখেন তিনি। সর্বশেষ উইলে উল্লেখ করেন যে,  তার সব সম্পদ পুরস্কার আকারে দেওয়া হবে। যারা পদার্থ, রসায়ন, চিকিৎসা, শান্তি ও সাহিত্যে বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে কাজ করবেন। নোবেল তার মোট সম্পদের (৩১ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনা) ৯৪ শতাংশ এ পাঁচটি পুরস্কারের জন্য উইল করেন। উইলে আরও উল্লেখ করেন, নোবেল ইনস্টিটিউটের কাজ হবে প্রতিবছর কয়েকটি মাধ্যমে নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে অর্থ প্রদান করা।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ অক্টোবর ২০১৭/রুহুল

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়