ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

মহান বিজয় দিবস

মহাকালের ব্যাপ্তিতে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়

নৃপেন রায় || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৪৮, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
মহাকালের ব্যাপ্তিতে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়

নিজস্ব প্রতিবেদক : বাঙালির মহাকাব্যের অমরগাঁথা ও ইতিহাস হলো বিজয় দিবস। বাঙালির চির সূর্য, এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ও অঙ্গীকারের প্রতীক। বিজয় দিবসে বাঙালি খুঁজে নেয় এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়। তাই শনিবার ৪৬তম বিজয় দিবসে বাঙালি বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দেবে, ‘বিজয় নিশান উড়ছে ঐ/ খুশির হাওয়া ঐ উড়ছে/ বাংলার ঘরে ঘরে/ মুক্তির আলো ঐ ঝরছে ...।’

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর উদিত হয়েছে বিজয় সূর্য। শনিবার সেই রক্তস্নাত বিজয়ের ৪৬তম বার্ষিকী । স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের দিন। দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করে বহু প্রাণ আর এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এদিনে বীর বাঙালি ছিনিয়ে আনে বিজয়ের লাল সূর্য। বিজয় দিবস বাঙালির মহাকালের পরিব্যাপ্তিতে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীকে পরাস্ত করে বিজয় অর্জন করে বাংলাদেশ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এদেশের মুক্তিকামী মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতনের পর এদিন আত্মসমর্পণ করে। দীর্ঘ দুই যুগের পাকিস্তানি শোষণ আর বঞ্চনা থেকে মুক্তি পায় বাঙালি জাতি।

প্রতিদিনের মতো ১৬ ডিসেম্বর  ভোরে রাঙা আলো স্পর্শ করবে প্রিয় দেশের পবিত্র ভূমি। এই ভূমি ভিজে আছে বিজয়ের মহানায়ক জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর রক্তে, জাতীয় চার নেতার রক্তে।

আমাদের বিজয় কোনো দেন দরবারের নয়, কারও দয়ার দানে নয়, সাগর সমান রক্তের দামে কেনা এই স্বাধীনতা। রক্তসাগর পেরিয়েই বাঙালি জাতি বিজয়ের সোনালি তোরণ অর্জন করেছে। দিবসটি একদিকে গৌরবের ও বাঁধভাঙা আনন্দের। আরেকদিকে লাখো স্বজন হারানোর শোকে বিহ্বল হওয়ারও দিন।

৪৬ বছরের প্রাপ্তি ও প্রত্যাশায় বহুদূর এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। ঘৃণিত যুদ্ধাপরাধীদের অনেকের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। পরম শ্রদ্ধা আর ভালবাসায় জাতি স্মরণ করে মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী লাখো শহীদকে। সেইসঙ্গে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের শপথ নেয়। অঙ্গীকারাবদ্ধ হয় লাল-সবুজ পতাকাকে এগিয়ে নেওয়ার।

দিবসটি উপলক্ষে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে পালিত হবে নানা কর্মসূচি। সকালে সারা দেশে সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জাতীয় পতাকা ওড়ানো হবে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নানা কর্মসূচি পালন করবে। সকালে জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে দিবসটির সূচনা করবেন। দিবসটি উপলক্ষে রাজধানীর বিভিন্ন সড়ক ও সড়ক দ্বীপ আলোকসজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে। জাতীয় দৈনিকগুলো বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করবে, রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার করা হবে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।

জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে মসজিদ, মন্দির ও ধর্মীয় উপাসনালয়ে অনুষ্ঠিত হবে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা।

সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে সূচনা হবে বিজয় দিবসের কর্মসূচির। দিবসটি উপলক্ষে প্রত্যুষে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ঢল নামবে সাধারণ মানুষের। বিজয় আবেগে উদ্বেলিত সাধারণ মানুষের দেওয়া ফুলে ছেঁয়ে যাবে স্মৃতিসৌধ।

১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল সেটির উদয় ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এদিন সকালে জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনের কর্মকর্তা জন আর কেলি পৌঁছান সেনানিবাসের কমান্ড বাঙ্কারে। সেখানে পাকিস্তান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের প্রধান জেনারেল নিয়াজি নেই, জেনারেল রাও ফরমান আলীকে পাওয়া গেল বিবর্ণ ও বিধ্বস্ত অবস্থায়। নিচু কণ্ঠে ফরমান আলী জানান, আত্মসমর্পণ সংক্রান্ত ভারতীয় বাহিনীর প্রস্তাব তারা মেনে নিয়েছেন। কিন্তু তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় ভারতে সেই সংবাদ পাঠাতে পারছেন না। কেলি জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহার করে এই বার্তা পৌঁছে দিতে পারবেন বলে জানান। সেদিন আত্মসমর্পণের বার্তা পৌঁছানো হয় জাতিসংঘের বেতার সঙ্কেত ব্যবহার করে।

ভারতে তখন সকাল নয়টা ২০ মিনিট। কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডের (বর্তমান শেক্সপিয়র সরণি) একটি দোতলা বাড়ি। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সচিবালয় আর প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সকাল। বরাবরের মতো সেদিনও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ঘরের দরজা একটু খোলা। স্বাধীনতার চিন্তায় উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী। আনুমানিক সকাল ১০টায় তাজউদ্দীন আহমদের ফোনটি বেজে উঠল। ওই ফোনে গুরুত্বপূর্ণ কেউ ছাড়া ফোন করতে পারেন না। কী কথা হলো বোঝা গেল না। কিন্তু ফোন রেখে, চোখে-মুখে পরম আনন্দ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী জানালেন- ‘সবাইকে জানিয়ে দাও, আজ আমরা স্বাধীন। বিকেল ৪টায় আত্মসমর্পণ।’

এদিকে ঢাকায় পাকা খবর এসে পৌঁছেছে কিছুক্ষণ আগে। আত্মসমর্পণ হবে বিকেল সাড়ে ৪ টায়। ঢাকাবাসী আনন্দ উত্তেজনায় বিহ্বল। কী করবে আর কী করবে না বুঝে উঠতে পারছে না। সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে মিত্রবাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করে। এর আগেই মিরপুর ব্রিজ দিয়ে ঢাকায় ঢুকে পড়েছে কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী।

এদিন পড়ন্ত বিকেলে ঢাকা রেসকোর্স ময়দান (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) প্রস্তুত হলো ঐতিহাসিক এক বিজয়ের মুহূর্তের জন্য। ঠিক যেখান থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের সাতই মার্চ বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।

দুপুর ১টা নাগাদ কলকাতা থেকে ঢাকা এসে পৌঁছান ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের যৌথবাহিনীর প্রধান জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, চিফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব, মুক্তিবাহিনীর উপ-অধিনায়ক গ্রুপ ক্যাপ্টেন একে খন্দকার (বর্তমান পরিকল্পনামন্ত্রী)। দুপুর ১টার পর জেনারেল হেডকোয়ার্টারে বসে আত্মসমর্পণের দলিল তৈরির বৈঠক। একপক্ষে নিয়াজী, রাও ফরমান আলী ও জামশেদ। অপরপক্ষে জ্যাকব, নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী। সিদ্ধান্ত হয়, দলিলে স্বাক্ষর করবেন বিজয়ী বাহিনীর পক্ষে ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড ও বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর জয়েন্ট কমান্ডিং ইন চিফ লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা এবং বিজিত বাহিনীর পক্ষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল এএকে নিয়াজি। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই জেনারেল অরোরা আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বিমান ও নৌবাহিনীর চিফ অব স্টাফসহ কলকাতা থেকে ঢাকায় আসেন। নিয়াজি অভ্যর্থনা জানান যৌথবাহিনীর কমান্ডারকে।

এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পরাজিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লে. জেনারেল এএকে নিয়াজি রেসকোর্স ময়দানে এলেন। বিকেল ৪টায় নিয়াজি ও অরোরা এগিয়ে গেলেন ময়দানে রাখা একটি টেবিলের দিকে। জেনারেল অরোরা বসলেন টেবিলের ডান দিকের চেয়ারে। বাম পাশে বসলেন জেনারেল নিয়াজি। দলিল আগে থেকেই তৈরি ছিল। জেনারেল অরোরা স্বাক্ষর করার জন্য দলিল এগিয়ে দেন নিয়াজির দিকে। তখন বিকেল ৪টা ২২ মিনিট। অবনত মস্তকে জেনারেল নিয়াজি দলিলে স্বাক্ষর করে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে নিলেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে।

দীর্ঘ ৯ মাসের দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটিয়ে বাঙালি জাতির জীবনে এলো নতুন প্রভাত। এলো হাজার বছরের আরাধ্য স্বাধীনতা। বাঙালি জাতি অর্জন করে সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি, লাল-সবুজ খচিত পতাকার অহংকার। বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে নিজেদের গর্বিত পরিচয়।

৪৬ বছর ধরে পতপত করে উড়ছে বিজয় নিশান; এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। আর এর পেছনে রয়েছে এই জাতির ঘাম ঝরানো সংগ্রাম। সেই সংগ্রামের সেনাপতি ছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৫ ডিসেম্বর ২০১৭/নৃপেন/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়