ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

গঙ্গা ঘাটের দেব নগরী

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:১৯, ২৬ অক্টোবর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
গঙ্গা ঘাটের দেব নগরী

ইকরামুল হাসান শাকিল : হরিদ্বারের গলিগুলো আমাদের পুরান ঢাকার শাঁখারিবাজারের মতো। চাপা গলি, গলির দু’পাশে দোকান। সারাক্ষণ মানুষের ভিড় লেগেই আছে। কলকাতার নিউমার্কেট এলাকায় যেমন বাংলাদেশীদের ভিড় তেমনি আমরা যে স্ট্রীটে আছি এখানেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ভিড়। তারা গঙ্গায় পুণ্যস্নানে এখানে আসেন। সবার সাথে বাংলাতেই কথা বলা যাচ্ছে। আর এখানেই চোখে পরে বাঙালি খাবারের হোটেল। এখানে ‘দাদা বৌদির হোটেল’ নামে বেশ কয়েকটি হোটেল আছে। এই হোটেলগুলোতে সবসময় ভিড় লেগেই থাকে। খাবার খেতে হলে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। আমরা চারজন দুপুরের খাবারের জন্য পুরনো দাদা বৌদির হোটেলে এসে বসলাম। এখানে আগেও আমি খেয়েছিলাম কলকাতার বন্ধু প্রসেনজিৎয়ের সঙ্গে। উত্তরাখণ্ড অঞ্চলে শুধু ভেজ খাবার। কোথাও মাছ মাংস রান্না হয় না। তাই আমাদেরও সবজি দিয়েই ভাত খেতে হলো।



উত্তরপ্রদেশের উত্তর-পশ্চিম অংশ এবং হিমালয় পর্বতমালার একটি অংশের বেশ কয়েকটি জেলা নিয়ে উত্তরাখণ্ড অঞ্চলটি গঠিত। ২০০৭ সালে এই রাজ্যটির নাম উত্তরাঞ্চল থেকে উত্তরাখণ্ড করা হয়েছে। দেরাদুন রাজ্যের রাজধানী এবং এটি এই রাজ্যের বৃহত্তম শহর। রাজ্যটি হিমালয়ের রূপ বৈচিত্র, প্রাকৃতিক সৌন্দ্যর্য ও সম্পদের জন্য বিখ্যাত। উত্তরাখণ্ডকে দেব ভূমি অথবা ঈশ্বরের ভূমি বলা হয় কারণ এখানে বিভিন্ন ধর্মীয় স্থান এবং মন্দির দেখা যায় যেগুলিকে এই অঞ্চলের অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান বলে মনে করা হয়। উত্তরাখণ্ডের ইতিহাস এই রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অতীতের কথা বলে। বেশ কিছু রাজ্য এবং মহান রাজাদের উল্লেখসহ এই রাজ্যের একটি লাম্বা ইতিহাস আছে যেখানে কূষান, কুদিনা, কনিষ্ক, সমুদ্রগুপ্ত, কাটুরিয়া, পাল, চন্দ্রদের নাম উল্লেখ আছে। উত্তরাখণ্ডের ইতিহাসের কথা বহু পবিত্র হিন্দু ধর্মগ্রন্থে লেখা আছে। কিন্তু এর সেরা ইতিহাস গাড়োয়াল এবং কুমায়ুনের ইতিহাসের মাধ্যমে ভালো বোঝা যাবে। এখানকার দুই প্রধান আঞ্চলিক ভাষা হলো গারোয়ালি এবং কুমাউনি। ভারতের দুই প্রধান নদী গঙ্গা ও যমুনার উৎসস্থল এই রাজ্য থেকেই।



উত্তরাখণ্ডের সব থেকে ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ নগরী হলো হরিদ্বার। হিন্দুধর্মের গুরুত্বপূর্ণ তীর্থ কুম্ভ মেলা হয় এই হরিদ্বারের গঙ্গা ঘাটে। এটিকে হিন্দুদের বিশ্বের বৃহত্তম ধর্ম সম্মেলন বলে মনে করা হয়। এখানকার অন্যান্য উৎসবগুলি হলো ঘি-সংক্রান্তি, বাতসাবিত্রী, খাতারুয়া, ফুল দেই, হারেলা মেলা, নন্দাদেবী মেলা ইত্যাদি । হরিদ্বার প্রকৃতি, বন্যপ্রাণী, রোমাঞ্চকর খেলাধুলা বা তীর্থস্থান যে কারণই হোক, পর্যটনের মূলকেন্দ্র বিন্দু। এই অঞ্চলের প্রধান পর্যটন কেন্দ্রগুলি হলো হরিদ্বার, হৃষিকেশ, দেরাদুন, মুসৌরি, আলমোড়ো, কেদারনাথ, বদ্রীনাথ, যমুনোত্রী, গঙ্গোত্রী, জিম করবেট জাতীয় উদ্যান, নৈনিতাল, রানিখেত এবং পিথোরাগড়। যদি আপনি দুঃসাহসী হন এবং কঠিন প্রতিবন্ধকতা উপভোগ করতে আগ্রহী হন, তাহলে আপনি হরিদ্বারে ট্রেকিং, প্যারাগ্লাইডিং, পর্বতারোহণ, স্কীইং, রিভার রাফটিং এবং অন্যান্য অনেক কার্যক্রম করতে পারেন। এখানকার জাতীয় উদ্যান, গাছ, ফুল, গাছপালা, গুল্ম, লতানো উদ্ভিদের সুন্দর ছবি আপনার চোখ ধাঁধিয়ে দিবে।



এমনিতেই যারা আসে তারা কেউ কিছু পাওয়ার আশায় নয়, মনের সমস্ত কিছু বিলিয়ে দিয়ে ফিরে আসতে চায়, কিন্তু এমনই কপাল, কিছুতেই খালি হাতে ফেরা হয় না তাদের, অনাবিল আনন্দে দেহমন ভরিয়ে দেয় যে উদার-উদাসীন তীর্থ, তার নাম হরিদ্বার, মহামতি ভীষ্মের তর্পণক্ষেত্র, মহাভারতীয় যুগের গঙ্গাদ্বার। তীর্থকামী কিংবা ভ্রমণপিয়াসীদের মধ্যে হরিদ্বারে আসার মনোবাসনা নেই এমন মানুষের সংখ্যা পাওয়া যাবে না। অথচ হরিদ্বারে এসেও দেখা হয়নি বিল্বকেশ্বর মহাদেব, এমন তীর্থযাত্রীর সংখ্যা অনেক। মোক্ষভূমি তীর্থ হরিদ্বারে এর দর্শন না করলে এই তীর্থ দর্শন, স্নান ও দানের কোনও ফল লাভই হয় না। একইরকম ভাবে কাশীতে কালভৈরব, বৃন্দাবনের বংশীবটে গোপীশ্বর মহাদেব, কালীঘাটে নকুলেশ্বর এদের দর্শন না করলে তীর্থ দর্শনের ফল পাওয়া যায় না। এগুলি প্রায় সকলেরই বাদ পরে যায়, সবাই শুধু গঙ্গা ঘাটে স্নান সেরে ফিরে যায়। মন্দিরগুলি চলার পথে পরে তবে উপেক্ষিত হয় কেবল না জানার কারণে। অথচ সেখানে না যাওয়ারও কোনও কারণ নেই। আমরা কিন্তু জেনেও যেতে পারছি না। কারণ একটাই, ঘুরে দেখার মতো সময় আমাদের হাতে নেই।



হরিদ্বার গঙ্গাঘাটকে কয়েকটি নামে বিভক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ঘাট হলো ‘হর কি গৌড়ি’। ট্রেন স্টেশন থেকে হর কি গৌড়ি ঘাটের দিকে বাঁ-পাশ ধরে কিছুটা এগোলেই বাবা কালীকমলিওয়ালার ধর্মশালা। আর খানিকটা এগিয়ে গেলেই অবাংলাভাষীদের কথায় পরবে ‘চৌরাহা’। এই চৌমাথা থেকে সামান্য এগোলেই ঢালু পিচের রাস্তা চলে গিয়েছে বাঁ-দিকে। পরবে রেল পোল। তার নিচে দিয়ে একটু গেলেই মেলা চিকিৎসালয়। আরও কয়েক পা এগুনোর পর ডানদিকে সামান্য চড়াই ধরে শুরু হয়েছে গভীর জঙ্গল, একেবারেই যেন তপোবন। এই তপোবনের পরিবেশেই হরিদ্বারের ক্ষেত্রপাল দেবতা বিল্বকেশ্বর মহাদেবের অধিষ্ঠান। হর কি গৌড়ি  যাওয়ার প্রধান রাস্তা থেকে হেঁটে খুব বেশি হলে মিনিট পাঁচেকের পথ। লোকালয়ের কোলেই এমন একটা পরিবেশ বাইরে থেকে কিছুতেই বোঝার উপায় নেই। 

গঙ্গাঘাটে সন্ধ্যা ছ’ টায় সন্ধ্যা আরতি হয় প্রতিদিন। আমরা আজকের সন্ধ্যা বসে থেকে কাটাতে চাই না। তাই আমি ও সানভী ভাই বেরিয়ে পরলাম। আমরা ঘাটের চারপাশ ঘুরে দেখছি। হাজার হাজার নারী পুরুষ গঙ্গার পবিত্র শীতল জলে স্নান করছে। পূজা করছে। মনো বাসনা পূরণের লক্ষ্যে জলের স্রোতে নারকেল, পয়সা ছুড়ে মারছে। ঠিক সন্ধ্যা ছ’ টার সময় শুরু হলো আরতি। আরতি শেষে জলে প্রদীপ জ্বালিয়ে ভাসিয়ে দিচ্ছে। কি দারুণ দেখা যাচ্ছে জলের স্রোতে রাতে মিটিমিটি আলোয় প্রদীপ ভেসে যাচ্ছে। (চলবে)




রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৬ অক্টোবর ২০১৮/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়