‘তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয় পাকবাহিনীকে’
সাইফুল ইসলাম: বহুলী ইউনিয়নের ছাব্বিশা গ্রামের ডা. আব্দুল মজিদ তালুকদারের ছেলে শহীদুল ইসলাম তালুকদার (৬৫)। গ্রামে থেকেই শহরের স্কুলে পড়াশোনা করতেন। ১৯৬৯-এ এসএসসি পাশ করে ভর্তি হন সিরাজগঞ্জ কলেজে। স্কুল জীবন থেকেই ভাবতেন কবি, সাহিত্যিক হবেন। মিশতেন শহরের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মধ্যমণি ডা. মতিয়ার রহমান, তার কম্পাউন্ডার সুসাহিত্যিক কমলকুমার গুণসহ অন্যান্য লেখকদের সঙ্গে। কিন্তু সময়ের দাবিকে অস্বীকার করবেন কিভাবে? বিশেষ করে যখন জনগণ জেগে উঠেছে? জনগণের স্বতঃস্ফূর্ততা তাকে তাড়িত করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে।
মার্চের প্রথম সপ্তাহে শহীদুলের গ্রামের তরুণেরা আনসার সদস্যদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে লেফট-রাইট অনুশীলন করতে শুরু করেন। ক’দিন পরেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চলে আসেন তাদের নেতা আলাউদ্দিন, যার বাড়ি বহুলীতে। তিনি প্রশিক্ষণ ক্যাম্প চালু করেন বহুলী হাটখোলায়। প্রথমে ডামি রাইফেল, তারপর আসল রাইফেলও আসে দু’একটি। তাই দিয়েই অস্ত্র ছুঁয়ে দেখার প্রথম অভিজ্ঞতা শহীদুলের। তখন মাঠের চারপাশ ঘিরে থাকতো সাধারণ মানুষ আর অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতো তাদের প্রশিক্ষণ নেওয়া। তখন হয়তো মানুষ ভাবতো যে, এই সব তরুণেরা কি পারবে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তাগড়া জওয়ানদের পরাজিত করে দেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে?
২৭ এপ্রিল শহীদুলের প্রিয় শহর দখলে নেয় পাকিস্তানীরা। হতাশা নেমে আসে সাধারণ মানুষের মনে। ছত্রভঙ্গ হতে শুরু করে মুক্তিযোদ্ধারা। তখনো ভারতে যাওয়ার হিড়িক পড়েনি তরুণদের মধ্যে। আলাউদ্দিন সবার সঙ্গে দেখা করেন, সবার খোঁজখবর নিয়ে চলে যান ভারতে। এ সময়েও শহীদুল এলাকার তরুণদের সঙ্গে সংগঠিত থাকেন। রাতে বাড়িতে ঘুমাতেন না, সব সময় দু’তিনজন থাকতেন একসঙ্গে। মাস দেড়েকের মধ্যেই এলাকায় ফিরে আসেন আলাউদ্দিন। দল গড়ে তোলেন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে।
মুক্তিযোদ্ধাদের ফিরে পেয়ে আবারো সংগঠিত হতে শুরু করে জনগণ। মুক্তিযোদ্ধাদের থাকা, খাওয়া, পথ দেখানোর দায়িত্ব নেয় তারা। শহীদুলরা সাধারণত কোন আশ্রয়ে একদিনের বেশি থাকতো না, থাকার নিয়ম ছিল না। এমনকি একই বাড়িতে তিন বা চারজন মুক্তিযোদ্ধার বেশী থাকতো না। দল বেঁধে একটি গ্রামে ঢুকে বিভিন্ন বাড়িতে ভাগ করে দেয়া হতো তাদের। সারাদিন সে বাড়িতে থাকতো, আবার রাতের কোনও এক সময় পরবর্তী আশ্রয়ের দূরত্ব অনুযায়ী বের হতো। এভাবেই এলাকায় কাজ করতো। যুদ্ধের পরিকল্পনা করতো কমান্ডারেরা। সে অনুযায়ী তারা বের হতো অপারেশনে। শহীদুলদের অবাক লাগে সেদিনের শৃঙ্খলার কথা মনে পড়লে। এমনকি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদও ঘটেনি কখনো। কারণ সবার উদ্দেশ্যই তো এক- দেশের স্বাধীনতা, জনগণের মুক্তি। তারা মনে করতো, এই শৃঙ্খলাই তাদের শত্রু ঘায়েলে সহযোগিতা করবে। জনগণের মধ্যেও দেখা গেছে এক অভূতপূর্ব শৃঙ্খলা, পরস্পরকে সহযোগিতার শৃঙ্খলা। শহীদুলদের মনেই হয়নি যে এ দেশে কোনও জাতি-ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ আছে। হিন্দু বাড়ির মানুষগুলো খুব সহজেই এসে আশ্রয় নিয়েছে মুসলমান বাড়িতে। যেন সবাই ভাই-ভাই। এদেশে জাতপাতের তফাৎ ছিল না কোনো কালেই। শহীদুলদের তৎপরতায় স্বাধীনতাবিরোধীরা গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নেয় শহরে। এখন শহর থেকে পাকিস্তানীদের তাড়ানোর পালা।
এসে যায় বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। মিত্রবাহিনী যুক্ত হয় ডিসেম্বরে। স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় নেপাল, ভুটান, ভারত। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস বেড়ে যায় কয়েক গুণ। জনতাকে সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তান আর্মির শৈলাবাড়ি ক্যাম্পে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় আশপাশে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল। মিলিটারিদের পালানোর একটি পথ খোলা রেখে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলা হয় তাদের। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটাতে গিয়ে আহত হন শহীদুল। সহযোদ্ধারা সঙ্গে সঙ্গেই তাকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে যায় শাহানগাছা গ্রামে। সেখান থেকে ভুড়ভড়িয়া, তারপর বেজগাঁতী গ্রামে।
এদিকে, ১৪ ডিসেম্বর মুক্ত হয় সিরাজগঞ্জ। শহীদুলকে নিয়ে আসা হয় শহরে, ভর্তি করা হয় সদর হাসপাতালে। ঠাঁই হয় এক নম্বর বেডে। যুদ্ধ বিধ্বস্ত অবস্থায় হাসপাতালে অবস্থানরত চিকিৎসকরা আন্তরিকতা নিয়ে সেবা দিতে থাকে আহত মুক্তিযোদ্ধা শহীদুলকে। চিকিৎসক নার্সদের সে সেবা কোনো দিনও ভোলার নয়। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা শহীদুল ইসলাম জানান, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে যে শৃঙ্খলা গড়ে উঠছিল, তা আজ হারিয়ে গেছে। ফলে মুক্তিযুদ্ধের সে গৌরবও আজ অনেকটা ম্লান। তবে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আবার ফিরে পাবে বাঙালি জাতি, ফিরে আসবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা- এটা তার বিশ্বাস।
রাইজিংবিডি/ঢাকা/৫ ডিসেম্বর ২০১৮/তারা
রাইজিংবিডি.কম
আরো পড়ুন