ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ২৫ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

স্বর্ণ নীতিমালা চূড়ান্ত

কেএমএ হাসনাত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৩৩, ১২ ডিসেম্বর ২০১৮   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
স্বর্ণ নীতিমালা চূড়ান্ত

বিশেষ প্রতিবেদক : স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮ এ মাসেই ঘোষণা করা হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। আমদানি পর্যায়ে প্রতি ভরিতে ২ হাজার টাকা, প্রতি ভরিতে ৫ শতাংশ ভ্যাট এবং ব্যাগেজ রুলে   প্রতি ভরিতে ৩ হাজার টাকা কর নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া, প্রতি ভরিতে ১ হাজার টাকা ট্যাক্স দিয়ে পুরাতন স্টক বৈধ করা যাবে বলে সূত্র জানিয়েছে।

গত মাসে স্বর্ণ শিল্পে অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত ও স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে ‘স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮’ বাস্তবায়নে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিকে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তাদের পর্যালোচনা প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছিল।

বুধবার  সচিবালয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভা কক্ষে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে উচ্চ পর্যায়ের এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের (আইআরডি) জ্যেষ্ঠ সচিব মোশাররফ হোসেন ‍ভূইঞা, অর্থ বিভাগের সচিব আব্দুর রউফ তালুকদার, বাণিজ্য সচিব মো. মফিজুল ইসলাম, বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন প্রতিনিধি এবং বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) সভাপতি জি সি মালাকার উপস্থিত ছিলেন।

বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮’ মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। নীতিমালায় আমদানি কর, ভ্যাট নির্ধারণসহ কয়েকটি বিষয় পর্যালোচনা করতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি তাদের প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। ব্যবসায়ীরা নীতিমালা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তবে কী হারে ভ্যাট ও আমদানি কর আরোপ করা হবে তা এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এ ধরনের বিষয় নিয়ে পর্যালোচনা করতে কোনো বাধা নেই। অনেক আগেই এ নীতিমালা মন্ত্রিসভা অনুমোদন দিয়েছে।

বৈঠক শেষে বাংলাদেশ জুয়েলারি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি জি সি মালাকার বলেন, সরকার যে স্বর্ণ নীতিমালা করেছে তাতে আমরা সন্তুষ্ট। এই নীতিমালার ফলে এ ব্যবসায় অনেক সমস্যা দূর হবে বলে আমি মনে করি। আমরা প্রতি ভরিতে ৩ শতাংশ ভ্যাট আরোপের দাবি করেছিলাম। যেহেতু ভ্যাটের সর্বনিম্ন হার ৫ শতাংশ, তাই এ দাবি মানা হয়নি। আমরাও ৫ শতাংশ  হারে ভ্যাট আরোপের যৌক্তিকতা মেনে নিয়েছি।

বাজুস সভাপতি বলেন, নতুন নীতিমালায় আমদানি পর্যায়ে প্রতি ভরিতে ২ হাজার টাকা, ব্যাগেজ রুলের আওতায় প্রতি ভরিতে ৩ হাজার টাকা আরোপ করা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রতি ভরিতে ১ হাজার টাকা দিয়ে অঘোষিত পুরাতন স্টকের স্বর্ণ বৈধ করা যাবে।শুধু স্বর্ণ ব্যবসায়ীরাই এ সুযোগ পাবেন।

স্বর্ণ চোরাচালান রোধ এবং স্বর্ণ আমদানিতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ‘স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮’ এর খসড়ায় গত ৩ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। এর আগে গত ২৩ মে  অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সভাপতিত্বে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়।

সূত্র জানায়, বৈঠকে গঠিত কমিটিকে ‘স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮’ এর আলোকে স্বর্ণ আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে কী হারে কর আরোপ করা হবে তা নির্ধারণ করবে।একই সঙ্গে বিদ্যমান ব্যাগেজ রুল পর্যালোচনা করে যুগোপযোগী করবে। কারণ, স্বর্ণ নীতিমালা না থাকায় স্বর্ণ আমদানি  এবং স্বর্ণের তৈরি গহনা রপ্তানির ক্ষেত্রে কর আরোপ করার সমস্যা দেখা দেয়। একই সঙ্গে ব্যাগেজ রুলের ফাঁক-ফোকর গলিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান হয়ে থাকে।

অর্থমন্ত্রী বলেন, দেশে কোনো স্বর্ণ নীতিমালা ছিল না। এ খাতে নানা ধরনের সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছিল। এছাড়া, অবৈধভাবে স্বর্ণ দেশে ঢুকছিল। এসব ব্যবস্থা একটি নিয়মের আওতায় আনার জন্য স্বর্ণ নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। এখন বৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি করে এ দেশের ব্যবসায়ীরা তার সঙ্গে মূল্য সংযোজন করে বিদেশে রপ্তানি করতে পারবেন।

তিনি বলেন, স্বর্ণ আমদানির ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ট্যাক্স দিতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে লাইসেন্স নিতে হবে। লাইসেন্স ফি কত হবে সেটা বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারণ করবে।

এদিকে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বর্ণ আমদানিতে বন্ড সুবিধা থাকছে। আমদানি করে দেশের ভেতর অলঙ্কার বানিয়ে তা বিদেশে রপ্তানি উন্মুক্ত করতে এ সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের রপ্তানিকারকদের নগদ প্রণোদনা সহায়তাসহ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমিও বরাদ্দ দেওয়া হবে। এছাড়া, অলংকার তৈরি করে যারা দেশের মানুষের কাছে বিক্রি করবে, তারাও আমদানি করা স্বর্ণ ব্যবহার করতে পারবেন।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত ডিলার সরাসরি স্বর্ণের বার আমদানি করতে পারবেন। তবে ডিলার স্বর্ণের বার ছাড়া কোনো স্বর্ণালঙ্কার বা অন্য কোনো ফর্মে স্বর্ণ আমদানি করতে পারবেন না। স্বর্ণের বার আমদানির সময় ডিলার বন্ড সুবিধা নিতে পারবেন। এসব ডিলার স্বর্ণালঙ্কার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বর্ণের বার বিক্রি করবেন।

তবে স্বর্ণালঙ্কার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া চাহিদার বিপরীতে স্বর্ণের বার আমদানির আগে সম্ভাব্য কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হবে তা বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়ে ওই ব্যয় পরিশোধের বিষয়ে অনাপত্তি নেবে। বৈদেশিক মুদ্রা বাজার পরিস্থিতি বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংক ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে অনাপত্তি বিষয়ে অবহিত করবে। স্বর্ণ ব্যবসায়ী ও স্বর্ণালঙ্কার প্রস্তুতকারীকে জেলা প্রশাসকের কাছ থেকে লাইসেন্স নিতে হবে এবং মূসক (মূল্য সংযোজন কর) নিবন্ধিত হতে হবে।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত ডিলার স্বর্ণের বার আমদানির সময় বন্ড সুবিধা গ্রহণ করে স্বর্ণ আমদানি করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে স্বর্ণের বার আমদানি করার নিমিত্ত অনুমোদিত ডিলারকে আবশ্যিকভাবে আমদানি নীতি আদেশ এবং কাস্টমস অ্যাক্টের বিধানাবলী অনুসরণপূর্বক বন্ড লাইসেন্স গ্রহণ করতে হবে।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, নিবন্ধিত বৈধ স্বর্ণ ব্যবসায়ীরা স্বর্ণালঙ্কার রপ্তানিকারক সনদ নিতে পারবে। বৈধভাবে স্বর্ণালঙ্কার রপ্তানি উৎসাহিত করতে রপ্তানিকারকদের স্বর্ণালঙ্কার তৈরির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে রেয়াতসহ বিভিন্ন প্রকারের প্রণোদনামূলক বিশেষ সহায়তা দেওয়া হবে। স্বর্ণালঙ্কার রপ্তানির উদ্দেশ্যে আমদানি করা স্বর্ণের ক্ষেত্রে ডিউটি ড্র-ব্যাক ও বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা দেওয়া হবে।

নীতিমালায় পুরনো স্বর্ণ কেনাবেচায় স্বচ্ছতা আনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, গ্রাহকের কাছ থেকে রিসাইকেল্ড (পুরনো) স্বর্ণ ক্রয়ের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা বিধানের লক্ষ্যে উক্ত গ্রাহক/বিক্রেতার জাতীয় পরিচয়পত্র/পাসপোর্টের কপি এবং পূর্ণাঙ্গ যোগাযোগের ঠিকানা সংরক্ষণ করতে হবে।

নীতিমালায় স্বর্ণের মান নির্ণয়, যাচাই ও নিয়ন্ত্রণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকার স্বর্ণের জন্য নিজস্ব মান প্রণয়ন করবে। স্বর্ণের মান যাচাই ও বিশুদ্ধ স্বর্ণের পরিমাণ যাচাই নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর ল্যাবটেস্ট, ফায়ার টেস্ট বা হলমার্ক টেস্ট সুবিধাসহ পরীক্ষাগার প্রতিষ্ঠা করবে। এই পরীক্ষাগারকে বাংলাদেশের অ্যাক্রিডিটেশন বোর্ড বা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান থেকে অ্যাক্রিডিটেশন গ্রহণ করতে হবে। স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কারের মান সুনিশ্চিত করার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে হলমার্ক ব্যবস্থা চালু করতে হবে। স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কার কেনাবেচার ক্ষেত্রে হলমার্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক হবে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়ম অনুযায়ী স্বর্ণ ও স্বর্ণালঙ্কারে খাদের পরিমাণ সুনির্দিষ্ট করতে হবে।

নীতিমালায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকে দেশের স্বর্ণ খাত সংশ্লিষ্ট একটি কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা করা হবে। এতে বাৎসরিক চাহিদা, আমদানি, রপ্তানি, ক্রয়-বিক্রয়, দোকান সংখ্যা, রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ, বাজেয়াপ্তকৃত স্বর্ণের পরিমাণ, নিলামে স্বর্ণ বিক্রির পরিসংখ্যান ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে।

দেশে স্বর্ণ চোরাচালান বেড়ে যাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত দেশে স্বর্ণ আমদানির কোনো নীতিমালা আছে কি না, এ বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের উত্তর পাওয়ার পর তিনি স্বর্ণ নীতিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেন। পরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সমন্বয়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির সুপারিশে ‘স্বর্ণ নীতিমালা-২০১৮’ এর খসড়া নীতিমালায় মন্ত্রিসভা কমিটি নীতিগত অনুমোদন দেয়। এখন এটি বাস্তবায়নের পর্যায়ে রয়েছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১২ ডিসেম্বর ২০১৮/হাসনাত/রফিক

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়