ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

জনশূন্য নির্জন পাহাড়ে চায়ের দোকান

ইকরামুল হাসান শাকিল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১০, ২৫ জানুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
জনশূন্য নির্জন পাহাড়ে চায়ের দোকান

আজকেও হিটার ঘিরে বসে থাকা অন্যদের মতো আমি শরীর উষ্ণ করছি। অন্যান্য লজের ছেলেমেয়েরাও আছে। তাদের মধ্যে ষোল সতের বছর বয়সী একটি মেয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে আমাকে বললো, বাংলাদেশে আমার একটা ফেসবুক ফ্রেন্ড আছে। মনে হয় সেটা তুমি। তোমার নাম কি ইকরামুল?

আমি আকাশ থেকে পড়লাম! অবাক হয়ে বললাম, বলতে পারছি না। তবে হতে পারে। আচ্ছা, তোমার নাম কী? সে জানালো তার নাম, নানু মায়া গুরঙ। যদি এখানে নেটওয়ার্ক পেতাম তাহলে হয়তো চেক করে দেখা যেত। ডিনার শেষ করে ঘুমাতে চলে এলাম। কালকের গন্তব্য সামদো। তাই বেশি রাত না জেগে ঘুমিয়ে পড়লাম।

তাপমাত্রা প্রায় হিমাঙ্কের শূন্যেরও নিচে। শীতে কাঁপুকাঁপু শরীরে ভোর পাঁচটায় খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে আছি। মানাসলুর চূড়ায় প্রথম সূর্যের আলো দেখার আশায়। প্রকৃতি আমাদের আশা পূরণ করতে একটুও কার্পণ্য করেনি। ভোরের প্রথম আলোয় ঝলমল করে উঠলো পুরো উপত্যকার চারপাশ। সেই আলো গায়ে মেখে আমরা প্রস্তুতি নিলাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য সামদোর উদ্দেশ্যে। আজ আমাদের মতো অনেকেই সামদো যাবে। সকালের নাস্তা সেরে রওনা হয়ে গেলাম। তেমন চড়াই নেই, পথটাও বেশি লম্বা না। শেষের দিকে কিছুটা চড়াই থাকলেও পুরো পথটাই প্রায় সমতল।  ঘন্টাখানেক হাঁটার পর সামদোর দেখা পেলাম দূর থেকে। আজ পথে কোন লজ বা খাবার জায়গা নেই। তাই একদম সামদো গিয়েই খাবার খেতে হবে। মাঝ পথে একটা যাত্রা বিরতি দেয়া হলো। আমাদের সঙ্গে থাকা শুকনো খাবার দিয়েই হালকা নাস্তা করে নিলাম।



প্রায় সাড়ে ১২টার দিকে আমরা সামদো পৌঁছলাম। দোতলার রুমে গিয়ে ব্যাকপ্যাক ছেড়ে ডাইনিং রুমে চলে এলাম। খাবারের মেনু সেই আলু ভর্তা, ডিম ভাজি আর ডাল। খাবার শেষে কিছু সময় রোদে বসে শরীর গরম করে নিলাম। বিকেলের দিকে আমরা হাইট গেইনের উদ্দেশ্যে বের হলাম। সামদোর পাশের পাহাড়টায় উঠতে লাগলাম। আমরা এখন আছি ট্রি-লাইনের উপরে। তাই গাছ বা গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ নেই। একদম ন্যাড়া। রুক্ষ পাহাড়ের উপত্যকায় শো শো শব্দে হাওয়ার দাপট চলছে। শীতের পরিমাণও বেড়ে গেছে। বেশি সময় সেখানে থাকা গেলো না ঠান্ডা হাওয়ার দাপটে। তাই দ্রুত নিচে নেমে আসতে হলো। সামদোতে তিব্বতিদের স্থায়ী বসতি। এখান থেকে তিব্বতের দূরত্ব খুব বেশি নয়। কাছেই নেপাল-তিব্বত সীমান্ত। এখন থেকেই তিব্বতি আবহাওয়ার অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। পাশেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ছ’হাজার মিটারি পর্বত সামতো পিক। পুরো গ্রাম রঙিন হয়ে আছে প্রেয়ার ফ্লাগে। অন্যান্য ট্রেকাররাও এখানেই আস্তানা গেড়েছে। সন্ধ্যার আগেই মেঘে চারপাশ ছেয়ে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে তাপমাত্রা নেমে গেলে। আজ আরো গরম পোষাক বের করে গায়ে চাপিয়ে নিলাম। কিছুসময় ডাইনিংয়ে আড্ডা দিয়ে ডিনার শেষ করে রুমে চলে এলাম। উষ্ণ কম্বলের ভিতর শুয়ে সারাদিনের কথা স্মরণ করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম।

চোখে এক সমুদ্র ঘুম নিয়ে কম্বলের ভিতর থেকে বেরিয়ে আসতে হলো নুর ভাইয়ের ডাকে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে ডাইনিং-এ চলে এলাম। সকালের নাস্তা সেরে হাঁটা শুরু করলাম। আমাদের আজকের গন্তব্য ৪ হাজার ৪৬০ মিটার উচ্চতায় ধরমশালা। আজকেও তেমন চড়াই নেই। আকাশটা বেশ পরিষ্কার। রোদের তাপমাত্রা অনেক বেশি। কিছু সময় হাঁটার পর শরীরে শীতের পোষাক আর রাখতে পারলাম না। খুলে ফেলতে হলো। আজ আমাদের তেমন তাড়াহুড়ো নেই বললেই চলে। এখন পর্যন্ত মানাসলু দেখা যাচ্ছে। তবে গতকাল পর্যন্ত যে পাশটা দেখেছি আছ সেই পাশটা দেখা যাচ্ছে না। এই পাশ থেকে মানসলুর ক্যাম্প-১ এর পাশটা দেখা যাচ্ছে। একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে মুহিত ভাই ক্যাম্প ওয়ান থেকে উপরে দিকে যাওয়ার রাস্তাটা দেখালেন। একটা উঁচু পাহাড়ের চূড়ার একটু নিচ দিয়ে ইউ আকৃতির রাস্তা পার হলাম। এটা ল্যান্ড স্লাইড জোন। আলগা ঝুরঝুরে মাটি আর ছোট ছোট পাথরে মোরেনের পথ। এখানে পা রাখার জায়গা নেই, তারমধ্যে যেখানেই পা রাখি সেখানকার মাটি নিচে নেমে যায়। উপর থেকেও গড়িয়ে গড়িয়ে পাথর পড়ছে। এখান থেকে নিচে পড়লেই হলো বা ধ্বস হলেই হলো। জীবনের ইতি এখানেই ঘটে যাবে। খুব সতর্কতার সঙ্গে এই জায়গাটুকু পার হয়ে এলাম।

দুপুরের মধ্যেই আমরা ধরমশালায় চলে এলাম। এখানে আর লজ নেই। লারকে বেস ক্যাম্প ও লারকে পাসের আগে এটিই  আমাদের শেষ আশ্রয়। তবে এখানে কোনো স্থায়ী জনবসতি নেই। আছে শুধু অস্থায়ী তাঁবু। বড় লম্বা একটা তাঁবুর এক অংশে আমরা ছয়জন, অপর অংশে বিদেশি একটি গ্রুপ উঠেছি। এই জায়গাটা এখন তাঁবুর রঙিন গ্রাম হয়ে গেছে। আজ বিভিন্ন দেশের প্রায় ৩০০ জন ট্রেকার এখানে অবস্থান করছে। শুধুমাত্র আমরাই এসেছি অভিযানে। ফলে সবার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠলাম আমরা। সবাই এসে আমাদের সাথে হাই-হ্যলো করে যাচ্ছে। বিকেলে আমরা হাইট গেইনে উপরে গেলাম। প্রথমে রোদ ছিলো বলে ভালোই লাগছিলো উপরে উঠতে। কিছুক্ষণ পর যখন মেঘে চারপাশ ছেয়ে গেলো তখন আর উপরে থাকতে পারলাম না। এখানে প্রথমবারের মতো ল্যামার গিয়ার দেখার সুযোগ হলো। ল্যামার গিয়ার হিমালয়ের প্রবাদপ্রতিম এক প্রজাতির শকুন। বিশাল ডানা মেলে সে খাবারের খোঁজে বের হয়েছে।



রাত ২টার পর থেকেই এখানে ট্রেকারদের কোলাহল শুরু হয়ে গেলো। সবাই ঘুম থেকে উঠে বেরিয়ে পরছে লারকে পাস অতিক্রম করার উদ্দেশ্যে। যারা লারকে পাস অতিক্রম করবে তারা ভোর রাতে উঠেই রওনা দিলো ধরমশালা থেকে। তাদের কোলাহলে ঘুম ভেঙে গেলো। সবাই চলে গেলো ধরমশালা ছেড়ে। এখন আর কোলাহল নেই। প্রায় জনমানব শূন্য। আর ঘুম হলো না। সকালে বিছানা থেকে উঠে তাঁবুর বাইরে এসে দেখি কোনো তাঁবুই নেই! সবাই গুটিয়ে নিয়ে গেছে।

বিস্বাদ ম্যাকারনি দিয়ে সকালের নাস্তা সেরে পা বাড়ালাম লারকে বেসক্যাম্পের পথে। সূর্য তার পূর্ণ তেজ নিয়ে জানান দিলো দিনের শুরুটা। ঝলমলে রোদে হেঁটে চলছি। গাইড মাল্লা আমাদের আগেই বেরিয়ে গেছে বেসক্যাম্প স্থাপন করতে। তাশি শেরপা আছেন আমাদের সাথে। এখন আর পথে ট্রেকার নেই। আমরাই সবার পরে বেরিয়েছি। সবাই লারকে পাস অতিক্রম করবে আর আমরা পাসের আগেই বেসক্যাম্পে যাবো। ধরমশালা থেকে কিছুটা পথ আসার পর থেকেই শুরু হলো পাথুরে মোরেইন এলাকা। এখন আর ঘাসও নেই। শুধু পাথর আর পাথর। লারকে রেঞ্জ বাম পাশে রেখে এগিয়ে চলছি। আর ডানপাশে রুক্ষ ধূসররাঙা ন্যাড়া পাহাড়। মাল্লা আগেই জানিয়েছিলো লারকে পর্বতের মূল চূড়া এপাশ থেকে দেখা যায় না। তবে শ্বেতশুভ্র লারকে রেঞ্জ পাশাপাশি থাকছে। ছোট-বড় পাথরের ঢেউয়ের ভাঁজ আর উঁচু-নিচু ওঠা-নামার পথে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলছি। আমরা এসে দাঁড়ালাম একটি ছোট লেকের পাড়ে। চারপাশে পাথরের মোরেইন ঘেরা এই লেক। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে পর্বত। সেই পর্বতের গ্লেশিয়রি থেকে লেকের উৎপত্তি। আমার বিস্ময়ে শুধু নির্বাক তাকিয়েই রইলাম লেকে গঢ় নীল জলের দিকে।



কিছুটা পথ দূরত্বেই একটি করে  লোহার খুঁটি দিয়ে পথ নির্দেশনা করা হয়েছে। মোরেইনের কারণে পথ চেনা দায়।  তাই খুঁটির মাধ্যমে পথ দেখানো হয়েছে। এই জনশূন্য নির্জন পথে এটি চায়ের দোকান পেলাম। ধরমশালা আর লারকে পাসের মাঝ পথেই এই দোকানের অবস্থান। এই দোকান শুধুমাত্র এপ্রিল-মে ও সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের ট্রেকিং মৌসুমে চালু থাকে। ভোররাতে রওনা দিয়ে এখানে এসে চা পানের বিরতি দেন ট্রেকাররা। আমরাও চা পানের বিরতির জন্য দাঁড়ালাম। এখানের চায়ের দাম আকাশ ছোঁয়া। তাই আমরা ছয়জন তিন কাপ চা ভাগ করে পান করলাম। এর আগে ধরমশালায় প্রতি ফ্লাক্স গরম পানি চড়া দামে কিনতে হয়েছে। প্রতি ফ্লাক্স পানির দাম দিতে হয়েছে প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ রুপি। চায়ের দোকানে দুইজন ছেলে। তাদের সঙ্গে কিছু সময় কথা হলো। তাদের মাধ্যমেই জানতে পারলাম এ বছর আমাদের আগে এখন পর্যন্ত কয়েকটি দল লারকে শিখর আরোহণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু একটি অভিযানও সফল হয়নি।

ছবি: কাজী বিপ্লব



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ জানুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়