ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

একুশের চেতনা জিনিসটা কী?

মিনার মনসুর || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:২৫, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একুশের চেতনা জিনিসটা কী?

|| মিনার মনসুর ||


আমাদের জাতিগত অস্তিত্বে একুশের অধিষ্ঠান সূর্যের মতো। সূর্য যেমন কোটি কোটি বছর ধরে ক্লান্তিহীনভাবে আলো বিলিয়ে যাচ্ছে, এক অর্থে আমাদের জাতীয় জীবনে একুশও তাই; যদিও একুশের বয়স এখনো শতবর্ষ পূর্ণ হয়নি। কিন্তু এ-ও তো সামান্য কথা নয় যে, গত ৬৬ বছর ধরে একুশ আমাদের কেবল অন্ধকারে পথই দেখাচ্ছে না, পথ চলার শক্তিও জুগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এতে তার শক্তি এতটুকু ক্ষয় হয়নি, বরং দিনদিন তা আরও বেড়ে চলেছে। উজ্জ্বলতর হচ্ছে তার আলো।
আবু জাফর শামসুদ্দিন লিখেছেন: ‘একুশই আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে’। কথাটি তাৎপর্যপূর্ণ। সেই তাৎপর্যটি হলো, একুশ আমাদের কেবল স্বাধীনতার পথই দেখায়নি, সেই পথ তৈরিও করে দিয়েছে। জুগিয়েছে পথ চলার অদম্য শক্তি ও সাহস। অনস্বীকার্য যে একুশ আমাদের অঢেল দিয়েছে। আমাদের প্রাপ্তির কলস পূর্ণ করে দিয়েছে কানায় কানায়। শুধু কি স্বাধীনতা? অবশ্যই নয়। স্বাধীনতার চেয়ে বড় দান যে আর কিছুই হতে পারে না তা অস্বীকার করার সাধ্য কারো নেই। কিন্তু একুশের ভূমিকা কেবল তাতেই সীমাবদ্ধ নয়। একুশের হাত ধরে আমরা যে স্বাধীনতা পেয়েছি, অতন্দ্র প্রহরীর মতো আজতক একুশই সেই স্বাধীনতাকে সুরক্ষা দিয়ে চলেছে।

কে না জানেন যে, জন্মলগ্ন থেকেই আমাদের স্বাধীনতা দেশি-বিদেশি শত্রু ও ষড়যন্ত্রকণ্টকিত। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের ব্যবধানে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট, সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে মূলত স্বাধীনতাকেই হত্যার অপচেষ্টা চালানো হয়েছিল সর্বাত্মকভাবে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত টানা ২১ বছর অব্যাহত ছিল স্বাধীনতাবিনাশী সেই অপচেষ্টা। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৮ বছর পর এখনো যে সেই ষড়যন্ত্র থেমে নেই তাও সুবিদিত। কিন্তু যতবার যতভাবে ষড়যন্ত্র হয়েছে, ব্যতিক্রমহীনভাবে একুশই তা রুখে দিয়েছে অমিত বিক্রমে। আইয়ুব-ইয়াহিয়া হয়ে জিয়াউর রহমান-এরশাদ পর্যন্ত সব সামরিক স্বৈরশাসকই তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছিল। সে কারণেই আশির দশকের শুরুতে ক্ষমতা দখলে নিয়েই তৎকালীন সেনাপ্রধান এরশাদ একুশের প্রভাতফেরি ও আলপনা আঁকা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। ঘোষণাটি কার্যকর করার জন্যে বালির বস্তা দিয়ে সেনা প্রহরাও বসিয়েছিলেন শহীদ মিনারে। কিন্তু মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বালির বাঁধের মতোই তা ভেসে গিয়েছিল জনরোষে। প্রতিবাদী জনতার ঢল নেমেছিল রাস্তায়। ফলে বহুরূপী এরশাদ তার জীবদ্দশায় আর কখনোই শহীদ মিনারে হাত দেওয়ার দুঃসাহস দেখাননি।

একুশ আমাদের যা যা দিয়েছে- সবই আমরা ডালাভরে নিয়েছি অকুণ্ঠচিত্তে। কিন্তু একুশের যে অপরিমেয় শক্তি ও সম্ভাবনা বিস্ময়করভাবে তা আমাদের নজর এড়িয়ে গেছে বরাবরই। সূর্যের উদাহরণ দিয়েই এ লেখাটি শুরু করেছিলাম। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীমাত্র জানেন, সূর্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রাণ ও প্রকৃতিজুড়ে এমন কিছু কাজ করে যাচ্ছে নিভৃতে যার ব্যত্যয় ঘটলে ধরিত্রী ধ্বংস হয়ে যাবে। কিন্তু মানুষ যদি কেবল তাতেই তৃপ্ত থাকতো তাহলে সভ্যতা আজ এ পর্যায়ে আসতে পারতো না। সূর্যের শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে অভাবনীয় সব কর্মযজ্ঞ। পৃথিবীর জন্যে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠা জীবাশ্ম জ্বালানির সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য বিকল্প হয়ে উঠেছে যে সৌরবিদ্যুৎ- তারও উৎস সূর্য। কিন্তু এসব আপনাআপনি হয়নি: এর জন্যে বিপুল মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করতে হয়েছে। একুশের বিপুল শক্তিভাণ্ডার কাজে লাগানোর জন্যে তেমন কোনো উদ্যোগ কি আমরা নিতে পেরেছি স্বাধীনতার গত প্রায় অর্ধশতকে? অপ্রিয় হলেও সত্য যে, পারিনি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেরকম কোনো ভাবনাচিন্তাও দৃশ্যমান নয় আমাদের কাজে-কর্মে। অথচ সব বাধাবিপত্তি পায়ে দলে দেশ কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। এই অগ্রযাত্রার গতি ও ব্যাপ্তি এতটাই চমকপ্রদ যে বিশ্বজুড়ে তা আলোচনার বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। যুগপৎ বিস্ময় ও প্রশংসার শিশিরে সিক্ত হচ্ছে বাংলাদেশের এই অভাবনীয় অর্জন। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের জীবনমান। শুধু যে আয় ও আয়ু বেড়েছে তা-ই নয়, গত এক দশকে মাথাপ্রতি গড় আয় প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই সচ্ছলতার ছাপ যেমন গ্রাম-নগর ও ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে প্রায় সর্বত্রই দৃশ্যমান, তেমনি অবকাঠামোগত ব্যাপক পরিবর্তনের ধারায় বিস্ময়কর গতিতে বদলে যাচ্ছে বাংলাদেশের চিরচেনা অবয়ব। উদ্বেগের বিষয় হলো- বস্তুগত উন্নয়নের এই যে মহাপ্লাবন তা কেবল পলিমাটিই বয়ে আনছে না, সেসঙ্গে ব্যাপক ভাঙচুরও চালাচ্ছে সমাজ ও জনমানসে। তার তীব্র অভিঘাতে নদীভাঙনের মতো ধসে পড়ছে সমাজের দীর্ঘদিনের সুপ্রতিষ্ঠিত ইতিবাচক বহু নিয়ম-নীতি ও নৈতিকতা। বিপজ্জনকভাবে উন্নয়নের গতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে সমাজমানসের এই অবক্ষয়।

এই উদ্বেগ এখন সর্বব্যাপ্ত যে আমরা ধনে যত বড় হচ্ছি, মন ও মননের দিক থেকে ততই ছোট হয়ে যাচ্ছি। শুধু যে সমাজে নানা ধরনের অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে তা-ই নয়, তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে নৃশংসতা, দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা। নিয়ম-নীতি ও আইন না-মানার প্রবণতা যেমন ক্রমবর্ধমান, তেমনি যেকোনো উপায়ে রাতারাতি বিত্তবান হওয়ার জন্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে মানুষ। ফলে ‘ক্রসফায়ার’-এর মতো শূন্য-সহিষ্ণুতা দিয়েও ঠেকানো যাচ্ছে না মাদক ও ধর্ষণের মহামারী। কিছুতেই রোধ করা যাচ্ছে না দুর্নীতির আগ্রাসন। এটা যে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে সরকারের নীতিনির্ধারক মহলও তা অকপটে স্বীকার করছেন। আর অর্থনীতিবিদরা বলছেন, কেবল দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলাই গিলে খাচ্ছে প্রবৃদ্ধির দুই শতাংশ! অনতিবিলম্বে এই ফুটো বন্ধ করতে না পারলে আমাদের সম্মুখযাত্রাই কেবল ব্যাহত হবে না, ইতোমধ্যে যা কিছু আমরা অর্জন করেছি তাও উধাও হয়ে যেতে খুব বেশি সময় লাগবে না।

সমাজমানসের এই ফুটো বন্ধ করার কথা সবাই বলছেন, কিন্তু তার উপায়টা কী তা কেউই স্পষ্ট করে বলছেন না বা বলতে পারছেন না। আমি তো দ্বিধাহীনভাবে মনে করি যে, এক্ষেত্রে একুশই হতে পারে আমাদের অব্যর্থ সুরক্ষা বর্ম। কীভাবে? তার সরাসরি উত্তর হলো, একুশের অপরিমেয় শক্তি ও সম্ভাবনাকে পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগানোর মাধ্যমে। এটা তো অস্বীকার করা যাবে না যে একুশ অযাচিতভাবে যা দিয়েছে, অদ্যাবধি আমরা শুধু সেটুকু গ্রহণ করেই তৃপ্ত থেকেছি। কিন্তু একুশের অবিনাশী আলো দিয়ে সারা দেশকে আলোকিত করার কথা বলা হয়তো হয়েছে, কিন্তু সে-লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ কোনো উদ্যোগ অদ্যাবধি গৃহীত হয়েছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। প্রসঙ্গত একটি কথা বলতে খুব প্রলুব্ধ হচ্ছি। সেটি হলো, ২০০৮ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, তখন সারা দেশেই বিদ্যুতের জন্যে হাহাকার চলছিল। এমনকি শহরেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকতো না। আর গ্রামে তো বিদ্যুৎ বাবু দয়া করে কদাচিৎ আসতেন! সেই বাংলাদেশে, মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে, বিদ্যুতের গাড়ি ঘরে ঘরে যাচ্ছে। চাহিবামাত্র সংযোগ পাচ্ছে গ্রাম-গঞ্জের মানুষ। আর এই বিদ্যুতের আলো বিদ্যুৎগতিতে পাল্টে দিচ্ছে বাংলাদেশের চেহারা।

একুশের যে আলো তার ক্ষমতা বিদ্যুতের চেয়ে সহস্রগুণ বেশি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার যেভাবে সুপরিকল্পিতভাবে ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিয়েছেন, ঠিক সেরকম সংকল্প ও অনমনীয় দৃঢ়তা নিয়ে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিতে হবে একুশের আলো। সেটা করতে হলে সবার আগে একুশের আলো জিনিসটা কী তা বুঝতে হবে স্পষ্টভাবে। একুশের চেতনা বলে যে-কথাটি প্রবলভাবে প্রচলিত আছে তা শুধু যে অতি ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেছে তা-ই নয়, এর মাধ্যমে ঠিক কী বোঝানো হয়- এ প্রজন্মের কিশোর-তরুণ-যুবকরা দূরে থাক- প্রবীণ প্রবক্তাদের কাছেও বিষয়টি স্পষ্ট কিনা তা নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। একুশের প্রসঙ্গ এলেই সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর কথাটি বেশ জোরেশোরেই বলা হয়। এটাই কি তবে একুশের সেই চেতনা বা মর্মবাণী? না, একুশের মূল চেতনা বা মর্মবাণী বলতে যা বোঝায় এটা তা নয়। একুশের মূল চেতনা হলো অধিকার- মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার এবং সর্বোপরি, মানুষ হিসেবে ধর্ম-বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী, নারী-পুরুষ ও শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষে সমান মর্যাদা নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার অধিকার। আমরা যে তা থেকে অনেক দূরে সরে এসেছি তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অথচ এই চেতনার ভিত্তিতেই বাংলাদেশের জন্ম। বায়ান্ন’র অবিনাশী চেতনায় উজ্জীবিত লাখো নারী-পুরুষ জীবন ও সম্ভ্রম দিয়ে যে আলো প্রজ্বলিত করে গেছেন সেটাই অমর একুশের আলো। সেই আলো সুপরিকল্পিতভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে ঘরে ঘরে। অন্যথায় বিপর্যয় আমাদের পিছু ছাড়বে না। 



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ