ঢাকা     বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৫ ১৪৩১

চুনিয়ার পূর্ণিমার রাত অন্তরে পশেছে || ৩য় কিস্তি

মাহমুদ নোমান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:১৮, ১৪ মার্চ ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
চুনিয়ার পূর্ণিমার রাত অন্তরে পশেছে || ৩য় কিস্তি

মাহমুদ নোমান : মান্দি জাতি মাতৃসূত্রীয়। আসার সময় পূর্ণিমা তার ছোটভাই সৃজনের বর বিদায়ের (পানচিনি) দাওয়াত দিয়ে রেখেছে। আমি আশ্চর্য হলাম- কেমনে বরবিদায়!

পূর্ণিমা বিস্তারিত বলল আমাকে। মান্দি জাতিতে ছেলেদের নিয়ে আসে মেয়ের বাড়িতে। আহা! অনুভব করছি আমাদের মধ্যে বিয়ে হলে কনে যেমন আছাড়পাছাড়ি করে কাঁদে- কি যে অনুভূতি!

ঠিক, তেমনি বুঝি হয় মান্দি জাতির ছেলেদের বিয়ের সময়? আমরা যেটাকে হেয় করে বলি- ঘরজামাই। কিন্তু এখানে সেটাই নিয়ম। বিয়ের পর বাচ্চাদের নামও রাখা হয় মায়ের গোত্রের সঙ্গে মিলিয়ে। এখানে বিয়ের সময় গোত্রের হিসাবটাও মিলতে হয়। যেমন মান্দিরা তিনটা গোত্রের: মারাক, সাংমা, মমিন। মারাক কখনো মারাককে বা সাংমা কখনো সাংমাকে বিয়ে করতে পারে না। কিন্তু মমিন, এক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে। মমিন মমিনকে এমনকি মারাক ও সাংমা উভয় গোত্রেই বিয়ে করতে পারে। সম্পত্তির মালিকও মেয়েরা। তাই মান্দি জাতিদের মধ্যে মেয়ে বাচ্চা হলে এই আনন্দ বংশ রক্ষার প্রদীপ।



প্রথমবার চুনিয়া ঘুরে এসে আমি বিস্মিত। সত্যিকার মানুষের সন্ধান পেয়েছি ওখানে। সে বিশ্বাস আমার মননে, বোধে পোক্ত হয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার হুট করেই চলে গেলাম। সরাসরি চট্টগ্রাম থেকে। চট্টগ্রামের অলঙ্করণ থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টার পর থেকে ৮:৩০ পর্যন্ত ৩ টা ‘প্রতিনিধি’ বাস ছাড়ে। বাসটি ময়মনসিংহ দিয়ে ২৫ মাইলে সরাসরি যাওয়া যায়। ২৫ মাইল হয়ে বাসটি মধুপুর, অতঃপর জামালপুর পর্যন্ত যাবে। সেই বাসে মধুপুর বা ২৫ মাইল গেলে ভাড়া ৬০০ টাকা। রাতের এই ভ্রমণে কুয়াশা চিড়ে গাড়িটি যখন ২৫ মাইল পৌঁছল তখন সবেমাত্র ফজরের আযান শেষ হয়েছে। অপেক্ষা করতে হলো অটো বা মোটরবাইকের জন্য। কিছুক্ষণ পর, ভাগ্য ভালো যে, একটা মোটরবাইক পেলাম। সাঁ সাঁ করে ১৫ মিনিটেই দোখলা মধুপুর জাতীয় উদ্যানের সামনে পৌঁছে গেলাম। ৪০ টাকা ভাড়া গছিয়ে দিয়ে হাঁটা দিলাম শালবনের মধ্য দিয়ে। অনেক পুরনো লম্বা বড় বড় শালগাছের ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের কিরণ লুটিয়ে পড়ছে। হাজার পাখির ডাকে, পায়ে শিশির মাড়িয়ে এগিয়ে যাচ্ছি অন্যরকম অনুভূতি নিয়ে। পূর্ণিমাদের ঘরে ঢুকতে ৭:৩০ টা বেজে গেল। সারারাত জার্নি বা নির্ঘুমের জন্য কিছু খেয়ে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলাম।

বিকেলে আচ্ছু জনিকের কাছে গেলাম। সেখানে চু দিয়ে আপ্যায়ন করা হলো। খেতে গিয়ে নাক সিটকাচ্ছি। ঐ ঘরের মাসি খটখটে হেসে বললো, মদ খাওয়া অভ্যেস করো, নয়তো মান্দি বিয়ে করতে পারবা না। আমিও ঠিক তাদের মতো হাসিতে তাল মেলালাম। এইবার তেমন জমলো না ঘুরোঘুরি বা দেখাদেখি। আচ্ছু চট্টগ্রামের কাঁকড়া খাওয়ার বায়না দিয়ে রাখলেন। ১১৪ পেরিয়ে গেলেও এখনো যুবকের চেয়ে ভালো খেতে পারে। আমার সামনে দেশি মুরগির মাথা কীভাবে যে চিবিয়ে, চুষে খাচ্ছেন! পূর্ণিমা বললো, মাথা খায় কারণ মাথায় সব বুদ্ধি যে তাই! সেবার ঘুরে এসেছিলাম বিশেষ কোনো অভিজ্ঞতা না নিয়েই। 

পরের বার কাঁকড়া নিয়ে যাবো এই ভাবনায় দিন গুনছি অথচ যেদিন বাজারবার সেদিন থেকে দুইদিনের ধর্মঘট। অথচ যেতে যখন মনস্থির করেছি, আমি অধৈর্য্য হয়ে গেলাম। বাজারে কাঁকড়াও পাইনি, তবুও ভাড়া দ্বিগুণ দিয়ে রেলস্টেশনে এসে যখন পৌঁছলাম তখন সাড়ে তিনটা। বিকেল ৩টা ১৫ মিনিটে ময়মনসিংহের রেল ছাড়ার কথা অথচ প্ল্যাটফর্মে দৌড়াদৌড়ি করতে গিয়ে পেয়ে গেলাম সেই ট্রেনটি। লোকাল ট্রেনের যাত্রার সময় এদিকওদিক করাটা আমার জন্য সুফল বয়ে আনল। কিন্তু ভেতরে সিট তো নেই-ই, দাঁড়ানোরও তিল পরিমাণ জায়গা নেই। জীবনে প্রথম ট্রেনের ছাদে উঠে গেলাম। রেলের ছাদে উঠে ভ্রমণ মানে বিশ্ব দেখা- এমন কথাই আমার মনে হয়েছে। শীত এসে গেছে, ছাদে উঠে বুঝতে পারলাম। ঝিরঝির বৃষ্টির মশকরা চলছে। সঙ্গে মাজারের এক খাদেমের গলা ঝেড়ে গান, গপ্পোয় ট্রেন এগুচ্ছে। সন্ধ্যার পরে এই আরেক জগৎ। ঐশ্বরিক সৌন্দর্যে আমার দুই চোখ নেচে উঠছে। ওদিকে সময় কেটে যাচ্ছে সময়ের নিয়মে। প্রায় স্টেশনে ট্রেন থামছে। বাদাম, ঝালমুড়ি ছাদে উঠে আসছে। ঘণ্টাখানেক পরপর আমারও খেতে হচ্ছে। প্রস্রাবের বেগও পেয়েছে, রাত তখন বারোটা। কুমিল্লা পার হয়ে এক স্টেশনে নেমে পড়লাম। হালকা হলাম সেখানেই। পুনরায় উঠে গেলাম ছাদে।



ট্রেন ময়মনসিংহ পৌঁছতে পৌঁছতে একটা বিকেল, একটা রাত পেরিয়ে সকাল ৯টা বেজে গেছে। ময়মনসিংহ টাউন হলের সামনে তখন কাঁচাবাজার জমে উঠেছে। পত্রিকার স্তূপ দেখতে পেলাম। বাস চলবে না। সিএনজিও চলতে দিচ্ছে না। অটো কিংবা ভ্যানই ভরসা। কিন্তু ভাগ্য ভালো, সিএনজি পেলাম কালীবাড়ি পর্যন্ত। সেখান থেকে মুক্তাগাছায় ভ্যান, সেখান থেকে ২৫ মাইল আবারও ভ্যানে। দোখলা পৌঁছতে তখন ১১টার কাছাকাছি। চুনিয়ায় পৌঁছে আমার শরীর অবশ হয়ে এলো। পরদিন বের হলাম বনের দিকে। জয়নাগাছা পেরিয়ে বেদুরিয়ায় উৎপল নকরেকের বাড়ি। উৎপল নকরেক ঐতিহাসিক এক সাক্ষী। প্রাকৃতিক স্বর্গ চুনিয়ায় ইকোপার্ক করার সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিল উৎপলও। শেষে পঙ্গু হয়ে ঘরবন্দি। খারাপ লাগছিল ওর সাথে কথা বলে, কেননা সে আমার বয়সী। উৎপলকে দেখে মুনমুনদের বাসায় গেলাম। তাঁর মা চু এনে দিলেন। এখানে অতিথিদের ভাত, চা না দিলে সমস্যা হবে না, কিন্তু চু দিতেই হবে। এটাই রেওয়াজ। নয়তো অতিথিকে অপমান করা হয়। অগত্যা গিলতে হয় অতিথিদেরও। আমিও সাহস করে গিলে নিলাম। চ্যাপা শুঁটকি ( পুঁটিমাছের), ধনিয়ার পাতার সাথে বেঁটে ভর্তা দিলো সঙ্গে। একটু একটু মুখে দিয়ে চু পান করছি। আস্বাদে দু'কান আর চোখ মুদে আসছে। আহা! জীবনরে আমার...। এরপর এনে দিলেন বেলের চা। খেয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম। ভেতরটা বেশ নেচে উঠলো। এখানে ঘরজামাই হয়ে আসার সাহস হয়ে এলো ইতোমধ্যে!

মুনমুনদের বাড়িতে ভাত খেয়ে ভ্যানযোগে চুনিয়ায় ফিরতে ফিরতে  সন্ধ্যা। রাতও চলে গেছে এই মুগ্ধতায়। সকালে ঘুম থেকে উঠতেই খবর এলো হালুয়াঘাটে কবি পরাগ রিছিলের বাবা মারা গেছেন। পূর্ণিমা তো আর এক জায়গায় দাঁড়াচ্ছে না। ও খুব জেদি, মায়ের বারণ শুনলোই না। যাবেই। সঙ্গে আমিও যাচ্ছি হালুয়াঘাটে। বিকেল তিনটায় সমাহিত করার কথা। আমরা ২টার দিকে পৌঁছলাম। ধুতি কিনলাম হালুয়াঘাট থেকে। সেখানে এসে পৌঁছলেন ‘সমকাল’ সাংবাদিক রাজীব নূর, কুষ্টিয়া ইসলামিক ইউনিভার্সিটির অধ্যাপিকা, মান্দি অন্তঃপ্রাণ ফারহা তানজিম তিতিল, জুয়েল বিন জহিরসহ আরো অনেকে। সেই প্রথম দেখলাম খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের কাউকে কবরস্থ করা। বুকের ভেতরটা বিষম ধরে গেছে। লালজলের একটা ঘটিতে সাদাটে কি একটা জিনিস চুবিয়ে খাচ্ছেন ফাদার। নারী-পুরুষের সমবেত বেদনা-সঙ্গীতে আমার ভেতরটা হুঁ হুঁ করে কাঁদলো। আমি সইতে পারছি না- কি যেন হয়ে যাচ্ছে আমার। কেঁদে দিলাম সন্ধ্যার আঁধার ঘনালে, একা একা।



রাত হয়ে এলে ফেরার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। ফারহা তানজিম তিতিলকে পূর্ণিমা ‘মা’ ডাকে। আমিও ডাকলাম মা। একেবারে মনেপ্রাণে বিশ্বাস রেখে। মা, তিতিল আমাদের একজন মহিলার সঙ্গে অটোতে এক জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন রাতে থাকার জন্য। সঙ্গে আরো দুয়েকজন। মহিলাটির পরিচয় আমি একটু পরে জেনেছি। কেননা আমার ভেতরটাতে কি যেন হচ্ছে- সারাপথ অটোতে নিজেকে লুকিয়ে কেঁদেছি। পূর্ণিমা রাতের আঁধারে বিলের ওপারে লাল লাল হ্যাজাক বাতির আলো দেখিয়ে বলল, নোমান, ঐতো ইন্ডিয়ার বর্ডার। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে  তাকিয়ে থাকলাম। ভেতরটা কষ্টে কেঁদেই যাচ্ছে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৪ মার্চ ২০১৯/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়