ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

বায়োস্কোপ দেখিয়ে চলে তার সংসার

এম আর লিটন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:২৫, ২৪ এপ্রিল ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
বায়োস্কোপ দেখিয়ে চলে তার সংসার

এম আর লিটন : গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্য বায়োস্কোপ, যা বর্তমানে হারিয়ে যাওয়ার পথে। এই ঐতিহ্যকে নেশা ও পেশায় রূপ দিয়ে এখনো জীবিকা নির্বাহ করছেন মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর উপজেলার পয়লা গ্রামের বাসিন্দা পাষাণ ফকিরের ছেলে মো. আতোয়ার রহমান (৪০)।

স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তিরা জানান, নব্বই দশকে ঘিওর অঞ্চলে ব্যাপক আকারে দেখা মিলতো বায়োস্কোপের। তখন বিভিন্ন উৎসব-পার্বণে, বিশেষ করে বৈশাখী মেলায় বায়োস্কোপ প্রদর্শন করতেন একদল বায়োস্কোপওয়ালা। কিন্তু কালের বির্বতনে বায়োস্কোপ এখন বিলুপ্তির দোরগোড়ায়। একসময় চিত্ত বিনোদনের আধুনিক মাধ্যম ছিল বায়োস্কোপ। বর্তমানে গ্রামের প্রায় প্রতিটি ঘরে টেলিভিশন, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের ব্যবহারের ফলে ঐতিহ্যবাহী বায়োস্কোপ হারিয়ে গেছে। আজকের প্রজন্মের অনেকেই জানে না বায়োস্কোপ কী।

ঐতিহ্যটি যেখানে বিলুপ্তির দোরগোড়ায় এসে ঠেকেছে, সেখানে বায়োস্কোপ নিয়ে হাল ছাড়েননি মধ্যবয়সি আতোয়ার রহমান। ছুটছেন বিভিন্ন প্রান্তে। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সকলকে বায়োস্কোপ দেখিয়ে বিনোদন ও আনন্দ দিচ্ছেন। এছাড়াও বায়োস্কোপ দেখিয়ে অর্থ উপার্জন করে স্ত্রী ও ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার চালাচ্ছেন তিনি।

আতোয়ার রহমানের পিতা পাষাণ ফকির বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে (পঞ্চাশের দশকে) শখ করে একটি বায়োস্কোপের বাক্স বানিয়েছিলাম। তখন টাকার মূল্য খুব কম ছিল, কয়েক পয়সার বিনিময়ে বিভিন্ন মেলা-উৎসবে বায়োস্কোপ দেখাতাম। আমার বয়স হয়ে যাওয়ায় বায়োস্কোপের বাক্স নাড়াচাড়া করতে পারি না। এখন এসব বাদ দিয়েছি। এখন আমার ছেলেই এ কাজ করছে।’

আতোয়ার রহমান বলেন, ‘বাবার হাত ধরে আমি এ পেশায় আসি। প্রায় ২০ বছর যাবৎ আমি এ কাজের সঙ্গে যুক্ত। মানুষকে আনন্দ দিতে পেরে আমার ভালো লাগে। এখনো বায়োস্কোপের প্রতি মানুষের প্রবল আকর্ষণ রয়েছে। কোথাও মেলা-উৎসব হলে মানুষ আমাকে ডাকে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সময় ও স্থান বুঝে বায়োস্কোপ দেখার মূল্য ঠিক করি। কোথাও ১০ টাকা, কোথাও ২০ টাকা, আবার ৩০ টাকাও নেই। বৈশাখী মেলা উৎসবে বায়োস্কোপের কদর একটু বেশি থাকে।’

কালের পালাবর্তন হলেও এখনো কোনো মেলা উৎসবে বায়োস্কোপ দেখলে মানুষ ভিড় জমায়। বায়োস্কোপ দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে পড়ে দর্শকরা।  

বায়োস্কোপ প্রদর্শনের আগে আতোয়ার রহমান ভেঁপু বাঁশি বাজিয়ে বায়োস্কোপের সামনে মানুষের ভিড় জমান। বায়োস্কোপের চার কোণার একটি টিনের বাক্সে গোলাকৃতি ৬টি কাচের জানালা খুলে দেন। হাত দিয়ে প্যাডেল ঘুরিয়ে দর্শনীয় স্থান, কিংবা বিভিন্ন চিত্রকর্মের ছবি, রাজা-বাদশা, জনপ্রিয় নায়ক নায়িকা, বিভিন্ন ধর্মীয় পবিত্র স্থাপনা, মৃত্যুর পরের নানা কাল্পনিক কাহিনির ছবি দেখানো হয়। যা বাক্সের দুই পাশে দুটি ঘুড়ির লাটাইয়ে পেঁচিয়ে প্রদর্শন করা হয়। সেই সঙ্গে বায়োস্কোপওয়ালা সুরে সুরে বলেন, দুলদুল ঘোড়া, মক্কা-মদিনা, আজমির শরীফ অথবা ক্ষুদিরামের ফাঁসি দেখবেন। আতোয়ারও সুরে সুরে গেয়ে যান, ‘কী চমৎকার দেখা গেল এইবারেতে আইসা গেল, ঢাকার শহর দেখেন ভালো। কী চমৎকার দেখা গেল।’ বাইরে থেকে স্বচ্ছ কাচের ওপর চোখ রাখেন নানা বয়সি মানুষ। আনন্দ ও বিনোদনে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায় দর্শকরা।

এ বিষয়ে পয়লা সরকারি প্রথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক, কবি আব্দুস সাত্তার বলেন, ‘‘আমরা এক সময় অনেক বায়োস্কোপ দেখতাম। এখন আর আগের মতো বায়োস্কোপ চোখে পড়ে না। সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার এ ঐতিহ্য। কিন্তু কিছু মানুষ এখনো টিকিয়ে রেখেছে এ ‘জাদুর বাক্স’।’’ 

তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের ঐতিহ্য বায়োস্কোপ বিলুপ্তির হাত থেকে উদ্ধার করতে হলে সকলকেই আন্তরিক হতে হবে। সেই সঙ্গে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।’



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ এপ্রিল ২০১৯/ফিরোজ/শান্ত

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়