ঢাকা     মঙ্গলবার   ২৩ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১০ ১৪৩১

তিনকূলে নেই কেউ, তাদেরও এসেছে খুশির ঈদ

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১২:১১, ৬ জুন ২০১৯   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তিনকূলে নেই কেউ, তাদেরও এসেছে খুশির ঈদ

হাসান মাহামুদ : ভাগ্যের অভাব, নিয়তি কিংবা দুর্ঘটনা হয়তো অনেকের জীবনে খুশির উপলক্ষ্যগুলো হাসি নিয়ে আসতে পারে না। আবার কারো জীবনে খুশিটুকু মেখে দেওয়ার মতো তিনকূলেই কেউ থাকে না। তবুও একরাশ হাসি আর খুশি বারতা নিয়ে বছর ঘুরে আসে ঈদ। ভাগ্যাহতদের জন্য ঈদ আসে খুশির বারতা নিয়ে। যার এক জলজ্যান্ত প্রমাণ মিলবে রাজধানীর শিশু সনদগুলোতে গেলে।

পথের ধারে হয়তো কুড়িয়ে পাওয়া গেল কাউকে, কেউ হয়তো জন্ম হওয়ার সাথে সাথেই পরিচয়হীন হয়ে পড়েছে। এমন নিয়তির নির্মম শিকার শিশুদের নিরাপদ-আশ্রয়ের পাশাপাশি আনন্দ-আশ্রম হয় শিশু সদনগুলো। ঈদের দিনে এবং ঈদের কয়েকদিনে এসব স্থানেও নেমে আসে আনন্দের জোয়ার, শুনা যায় ঝুনঝুনি-বাঁশির শব্দ। থাকে বিশেষ খাওয়ার ম্যানু। থাকে নতুন নতুন উপহার।

রাজধানীর আজিমপুরে অবস্থিত শিশু সদনে ঈদের পরদিন ‍গিয়েও দেখা গেছে ঈদের মতো আনন্দ পরিবেশ বিরাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পরিচালিত হয়। শিশু সদনটির নাম ‘ছোটমনি নিবাস’। পিতৃ-মাতৃ পরিচয়হীন শুন্য থেকে ৭ বছর বয়সী পরিত্যক্ত বা পাচার হতে উদ্ধারকৃত শিশুদের ছোটমনি নিবাসে লালনপালন করা হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তর ৬ বিভাগে অবস্থিত ৬টি ছোটমনি নিবাসে শিশুদের মাতৃস্নেহে প্রতিপালন, রক্ষণাবেক্ষণ, খেলাধুলা ও সাধারণ শিক্ষা প্রদান করছে। এর পাশাপাশি রয়েছে ১৮টি সরকারি শিশু পরিবার। এগুলোকে বলা হয়- দেশের এতিম ও গরীব শিশুদের অন্যতম আশ্রয়স্থল।

বৃহস্পতিবার সকালে আজিমপুর ছোটমনি নিবাসে গিয়ে দেখা যায়, শিশুরা ঈদের খেলনা নিয়ে খেলছে। গতকাল ঈদের সকালে এখানকার সকল শিশু পেয়েছে নতুন ঈদের জামা সাথে খেলনা। সারা দিন ছিল সেমাই, মাংসসহ ঈদের বিশেষ খাওয়ার ব্যবস্থা।

এখানে কারো মা, কারো বাবা- কারো আবার বাবা-মা কেউই নেই। এমন সব সম্পর্ক ছাড়াই, ঠিকই আনন্দে কাটছে এতিম শিশুদের ঈদ। আছে মা-বাবার স্নেহ-ভালোবাসা না পাওয়ার বেদনা।তারপরও তাদের চোখে-মুখে আনন্দ, খুশির অভিব্যক্তি। ঈদের খুশি তামান্না, রিমা, শহিদের চোখে।  এমনকি কয়েক মাসে আলোড়ন তোলা মেহেরুনও রয়েছে এই নিবাসে। তার হাসিতেও ঈদ আনন্দ ফুটে উঠছে।

সংস্থাটির দায়িত্বপ্রাপ্ত সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (কার্যক্রম) আবদুল্লাহ আল মামুন রাইজিংবিডিকে বলেন, বাবা-মায়ের মতো না পারলেও যথাসম্ভব ভালোবাসা দিয়ে বড় করতে কর্তৃপক্ষের চেষ্টার কমতি থাকে না। আমরা সর্বদাই চেষ্টা করি শিশুদের আনন্দের মধ্যে রাখতে, তাদের মানসিক অবস্থা ভাল রাখতে।

তিনি বলেন, এই শিশুরা যেন অন্য শিশুদের মতো ঈদ উদযাপন করতে পারে, সেজন্য কর্তৃপক্ষ বিশেষ ব্যবস্থার আয়োজন করে। এখানকার শিশুদের ভাগ্য হয়তো অন্য স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা শিশুদের মতো নয়, কিন্তু আমরা চাই তাদের স্বাভাবিক একটি শৈশব দিতে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের এই যুগ্ম-সচিব আরো বলেন, এখানকার শিশুদের জীবনে স্বজনদের ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন হয়তো স্বপ্নই থেকে যাবে, কিন্তু জীবন থেমে থাকে না। আমরা চাই তারা আনন্দে বেড়ে উঠুক, আলো ছড়াক সবার জীবনে- আমাদের চেষ্টাও থাকে তেমনই।



সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ১৯৬১ সালে শিক্ষা দপ্তর থেকে স্টেট অরফানেজগুলোর পরিচালনার দায়িত্ব সমাজকল্যাণ পরিদপ্তরের ওপর ন্যস্ত করা হয়। এই স্টেট অরফানেজ বা সরকারি এতিমখানাগুলোকে পরবর্তী সময়ে সরকারি শিশু সদন হিসেবে নামকরণ করা হয়। বর্তমানে পারিবারিক পরিবেশে এতিম শিশুদের ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান ও সহচর্য দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিপালনের জন্য শিশু সদনগুলোকে সরকারি শিশু পরিবারের রূপান্তরিত করা হয়েছে।

১৯৪৪ সালের এতিমখানা এবং বিধবা সনদ আইন, ১৯৭৪ সালের শিশু আইনের বিধান মোতাবেক পিতৃ-মাতৃহীন বা পিতৃহীন এতিম ও দুঃস্থ শিশুদের পূর্ণমর্যাদা দেওয়া, তাদের অধিকার এবং স্বার্থ সংরক্ষণ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। শিশু সদন, শিশু পরিবার এবং এ ধরনের কিছু প্রতিষ্ঠান মিলে বর্তমানে দেশে ৮৫টি সরকারি শিশু পরিবারে এতিম ও দুঃস্থ শিশুদের লালন-পালন করা হচ্ছে।

ছোটমনি নিবাসের একটু কাছেই আজিমপুরের স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা। ঈদে অন্য সবার মতো এখানকার এতিম শিশুরাও মেতে উঠেছিল উৎসব আনন্দে।

এতিমখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, এখানে ঈদের দিনে শিশুদের জন্য সকালে সেমাই ও নুডলস এবং দুপুরে পোলাও ও মিষ্টান্ন দেওয়া হয়েছে। আর শিশুদের মধ্যে ছেলেদের নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি এবং দেওয়া হয়েছে ফ্রক ও মেয়েদের সালোয়ার-কামিজ।

জানা গেছে, অনেকে ব্যক্তিগতভাবেও এতিম শিশুদের নতুন পোশাক দিয়েছেন। ফলে অনেক শিশু একাধিক জামা পেয়েছে।

সমাজের বিভিন্ন লোকের অনুদান, সাহায্য ও যাকাতের ওপর চলে ১৯০৯ সালে যাত্রা শুরু করা এই এতিমখানা। এ ছাড়া সরকারিভাবেও এতিমদের জন্য প্রতি মাসে বরাদ্দ দেওয়া হয়।

মেয়েদের হোস্টেলের ভারপ্রাপ্ত হোস্টেল সুপার সালেহা বেগম প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। নিজে এতিম হওয়ায় জীবনের বেশি সময় কেটেছে এই এতিম শিশুদের সঙ্গে। ঈদের দিনের অভিজ্ঞতা সর্ম্পকে তিনি রাইজিংবিডিকে বলেন, অন্য সবার মতো এখানকার শিশুরাও আনন্দেই ঈদ কাটায়। এখান থেকে বড় হয়ে অনেকে আজ প্রতিষ্ঠিত। তাদের কেউ কেউও আসে ঈদের দিনে। সবাই মিলে আনন্দ করে।

তিনি বলেন, আমাদের এখানকার মেয়েরা বিভিন্ন জায়গায় সরকারি চাকরি করছে। তারা অনেকেই এখন ডোনার হিসেবেও আছেন। বাচ্চাদের পেন্সিল, খাতা, কলম অনেক কিছুই তাদের কাছ থেকে আসে। আর ঈদের জন্য তো গিফট আসেই।

একশ বছরের বেশি পুরনো স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানায় বর্তমানে ২৬০ জন এতিম শিশু আছে। এদের মধ্যে ১৩৯ জন ছেলে। ১২১ জন মেয়ে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বাবা-মা হারা অসহায় নিঃস্ব এই এতিমরা এখানে থেকে লেখাপড়া করে। এতিমখানার পক্ষ থেকে এসব ছেলে-মেয়েদের যাবতীয় খরচ বহন করা হয়।

বাবা-মা হারানো সমাজের নিঃস্ব, বিপন্ন, অসহায় ছেলে-মেয়েরাই মূলত এতিমখানায় থাকে। একসঙ্গে পড়াশোনা করে। শিশু  শ্রেণি থেকে এইচএসসি পর্যন্ত বিনা খরচে এতিমদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে এতিমখানার নিজস্ব স্কুলে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত ছেলেদের জন্য রয়েছে পড়াশোনার ব্যবস্থা। আর মেয়েদের জন্য রয়েছে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়ার ব্যবস্থা। এরপর এতিমদের ভর্তি করে দেওয়া হয় পাশের ফরিদউদ্দিন সিদ্দিকী উচ্চ বিদ্যালয়ে। এখান থেকে এসএসসি পাসের পর তারা তাদের ইচ্ছেমতো যে কোনো কলেজে ভর্তি হতে পারে। সেক্ষেত্রে তাদের পড়াশোনার খরচ এতিমখানা কর্তৃপক্ষই বহন করে।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ জুন ২০১৯/হাসান/সাইফ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়