ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

শাকিলের জন্য অবিচুয়ারি

অমি রহমান পিয়াল || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৫১, ৭ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শাকিলের জন্য অবিচুয়ারি

প্রিয় শাকিল,

কথাগুলো আমি ঠাট্টার ছলে নিয়েছিলাম।

 

দু’হাতের মুঠোয় আমার ডান তালুটা আকড়ে ধরে বলেছিলে, ‘আমি মারা গেলে আমার জন্য একটা অবিচুয়ারি লিখবা পিয়াল ভাই?’

 

হাসতে হাসতে বলেছিলাম, ‘আচ্ছা, কিন্তু সিনিয়ারিটিতে তো আমার আগে মরার কথা। আমারটা কে লিখবে!’

 

কখনও ভাবিনি সেই প্রতিশ্রুতির দায় শোধের তাড়াটা এতো দ্রুত আসবে। সকালে ক্লাশের মধ্যে ফোনে তোমার খবরটা এলো। তারপর থেকে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আছে। চারপাশ এবং কি বোর্ডের অক্ষরগুলো। মা ছাড়া শেষ কবে কার জন্য এতো কেঁদেছি স্মরণ নেই। সারাটা ক্ষণ তোমার স্মৃতিগুলো অবিচুয়ারির অক্ষর হয়ে সামনে এসে স্মরণ করায়। আর সব ঝাপসা হয়ে যায়।

 

কিন্তু কী লিখবো তোমাকে নিয়ে? কাউকে বিব্রত না করে কতটুকু লিখলে সৎভাবে আমি চেনাতে পারবো তোমার সত্তা। সেই সত্তাটুকু যা রাজনৈতিক নয়। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী নয়। শুধুই মাহবুবুল হক শাকিল। যে কবি, সম্প্রতি ছোটগল্পেও অনবদ্য হয়েছে। পুরনো দিনের সিনেমার গানে গজলে যার অনুরাগ। এবং যে উদাসী এক প্রেমিক কৈফ মজনুনকে ধারণ করে পদ্য লিখে যায় হাতছাড়া প্রেয়সী বিহনে। খৈয়ামী মৌতাতে কখনও কেঁদে যায়। কতটা স্পর্শকাতর কতটা সংবেদন নিয়ে তোমার যাপিত জীবন তা কয়জনে জানে?

 

তুমি চাইলে আমাকে কোটিপতি করে দিতে পারতে। হ্যাঁ, তোমার আমার সম্পর্কের গাঢ়তায় কত যে সুপারিশ প্রতিদিন আসতো, ব্যবসায়িক। সেগুলো যদি করে দিতে, গাড়ি বাড়ি কোনটারই অভাব হতো না আমার। বলিইনি তো কোনোদিন কিছু। নিজের জন্যও না। এজন্যই বলতে, ‘পিয়াল ভাই তোমারে যে দিনে রাতে ত্যাক্ত করি, তার কারণ একটাই। তুমি আমার কাছে ধান্দা করতে আসো না।’

 

আসলেই তাই। ‘পিয়াল ভাই কই আছো, কতক্ষণ লাগবে তোমার আসতে? একটা সিএনজি নিয়া চলে আসো।’ সেই ডাক উপেক্ষা করার সাহস আমার কোনোকালেই ছিলো না। আমরা কবিতা নিয়ে কথা বলতাম। গান নিয়ে কথা বলতাম। কখনও পাল্টাপাল্টি কবিতার সুপারিশ হতো। তবে সবচেয়ে বড় অর্জন বঙ্গবন্ধুর অপ্রকাশিত ডায়েরিটা আমাকে তুমি পড়িয়েছিলে। অপ্রকাশিত আত্মজীবনীর দ্বিতীয় খণ্ড হিসেবে ওটার সম্পাদনা চলছিলো। বঙ্গবন্ধুর নানা ঘটনা আমরা উচ্চারণ করে পড়ছিলাম। এর মাঝেই তোমার কান্না। এত্তো আবেগী! এত্তো সংক্রামক সে কান্না!

 

বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার প্রতি তোমার আনুগত্য এবং ভালোবাসা নিয়ে নতুন কিছু না বলি-এতো সবাই জানে। কিন্তু কয়জন জানে শাহবাগের গণজাগরণে তোমার ভূমিকার কথা! কীভাবে অভিভাবকের মতো আগলে রেখেছিলে গোটা আন্দোলন; নেপথ্যে থেকে- কয়জন জানে সে কথা? কয়জন বলে সে কথা? আমি সাক্ষী, আমি জানি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বলে যাবো সে কথা। গতমাসে আমার জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানোর পর ফোনে বলেছিলে, ‘আর রাজনীতি করবো না পিয়াল ভাই, কিন্তু আপারে তো ছাড়তে পারবো না।’

 

জবাবে বলেছিলাম, ‘তিনিও তোমারে ছাড়বেন না। রাজনীতির যে অংশটুকু বিবেকে বাধে উপেক্ষা করো, নোংরামীটুকু এড়িয়ে চলো, লেখায় থাকো।’

 

তার কিছুদিন আগে আমাকে শুনিয়েছিলে তোমার নতুন গল্পের প্লট। ‘রেখো মা দাসেরে মনে’। আমাকে মাথায় রেখে গল্পটা লিখেছিলে। বলেছ, ‘পিয়াল ভাই, বিদেশ তোমার জায়গা না, দেশে তোমারে ফিরতেই হবে। জানি তোমার সইবে না।’

 

নানা ঘটনা, নানা স্মৃতি মনে আসছে। সেসব লিখতে পারছি না। কিছু ব্যক্তিগত ব্যাপার জনতার জন্য নয়। সেগুলো ব্যক্তিগতই থাক। আসলে কিছুই লিখতে পারছি না। এটুকু লিখেছি বার কয়েকের চেষ্টায়। তারপরও মনে হয় কিছুই লিখিনি। আসলে যদি লিখি সেটা মহাকাব্য হয়ে যাবে, ফুরাবে না তাও; অনেক না বলা কথাও আড়ালে রয়ে যাবে। তুমি আমাকে পড়তে পারতে। সমস্যা না বললেও তোমার অজানা থাকতো না কিছুই। রাজকন্যার জন্য প্রগাঢ় ভালোবাসা কখনও লুকাওনি তুমি। মা মারা যাওয়ার পর ভোর রাতে ছুটে এসে সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিলে যাতে কোনো কিছুতেই না সমস্যা হয়।

 

তোমার কাছে অনেক ঋণ আমার শাকিল। সেই দেনা শোধ করার উপায় তুমি রাখোনি। তোমার জন্য শোকগাথার দায়টাও শোধাতে পারলাম না। কারণ তোমাকে নিয়ে কিছু লেখার সাধ্য আমি রাখি না ভাই। শুধু বলি, যার উপেক্ষায় অভিমানে অগস্ত্য যাত্রায় অকালে নাম লেখালে, তোমার বিদেহী ভালোবাসায় সে জ্বলবে আ-জনম। এ অভিশাপ নয়; নিয়তি। ভালো থেকো কৈফ মজনুন...

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ ডিসেম্বর ২০১৬/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়