ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একটা সিরিজ হারা মানে সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়

রুহুল আমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩০, ২৪ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একটা সিরিজ হারা মানে সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়

রুহুল আমিন : ক্রিকেট নিয়ে আমাদের আগ্রহ ব্যাপক। কেউ বুঝে-শুনে ক্রিকেট খেলা দেখেন, ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করেন। আবার কেউ আছেন না বুঝেই খেলা দেখেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে যারা আছেন, তাদের নিয়ে সমস্যা হলো-তারা বাংলাদেশের জয় ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেন না। যেকোনো মূল্যে তারা বাংলাদেশকে জয়ী দেখতে চান। এটা অন্যায় কিছু নয়। তবে অতিমাত্রায় প্রত্যাশা খেলোয়াড়দের ওপর চাপ তৈরি করে। আর আমরা নিশ্চয় ইতোমধ্যে এমন দলে পরিণত হইনি যে, যেকোনো দলের সঙ্গেই খেলতে মাঠে নামি না কেন, হেসে খেলে জিতে যাব। অন্তত আমাদের গত দেড় দুই বছরের ক্রিকেট ইতিহাস সে কথা বলে না।

একটা সময় ছিল বাংলাদেশ বড় কোনো দলের বিরুদ্ধে জিতলে ক্রিকেটের ‘বড় ধরনের অঘটন’ মনে করা হতো। বিশ্বের খেলাধুলা বিষয়ক সংবাদ মাধ্যমগুলোও ‘অঘটন’ হয়েছে বলে ফলাও করে সংবাদ প্রকাশ করত। ধীরে ধীরে আমরা সেই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসছি। এমনকি অন্য যেকোনো দল এখন বাংলাদেশের মুখোমুখি হবার আগে বেশ সতর্ক থাকে। আগে যেখানে দলের মূল খেলোয়াড়দের বাইরে রেখে মাঠে নামত, সেখানে এখন পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নামে তারা। শুধু কি তাই, ক্ষেত্র বিশেষে তো ক্রিকেট রাজনীতিরও আশ্রয় নেয়। এগুলো বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের উন্নতির ইঙ্গিত। বাংলাদেশ দলটি যে ধীরে ধীরে পরিণত হচ্ছে তার ইঙ্গিত।

ক্রিকেটের সবচেয়ে কমন যে ব্যাপার তা হলো, নিজেদের মাঠে চেনা কন্ডিশনে যেকোনো দলই আমন্ত্রিত অতিথি দলের চেয়ে শক্তিশালী। তারপরও যেসব দল নিজেদের সামর্থ্য ইতোমধ্যে প্রমাণ করে ফেলেছে তাদের ক্ষেত্রে ভিন্ন হতে পারে। আর শক্তির বিবেচনাটা তো সব সময় থাকেই। আছে ক্রিকেট রাজনীতির সুযোগ-সুবিধা। কারণ কোন দল বছরে কয়টি সিরিজ পাবে তা তো কিছুটা হলেও ক্রিকেট রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত। এই সব হিসেবে নিকেশের পর, নানা মারপ্যাঁচের পর বাংলাদেশের উন্নতি নিয়ে বর্তমান সময়ে বিশ্বের অনেক কিংবদন্তি খেলোয়াড়দেরও মন্তব্য করতে দেখেছি। ব্যক্তিগত পর্যায়েও বাংলাদেশের অনেক খেলোয়াড় তাদের কৃতিত্ব দেখাচ্ছেন। দেশের জন্য সুনাম কুড়িয়ে আনছেন। ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরো বাড়বে বলে আশা রাখি। কারণ অনেক ব্যক্তিগত অর্জনের সমষ্টিতেই দলীয় অর্জনের পাল্লা ভারী হবে। দল সমৃদ্ধ হবে। দলীয়ভাবে বাংলাদেশ ক্রিকেট এগিয়ে যাবে।

বাংলাদেশের নিউজিল্যান্ড সফর শেষ হয়েছে। টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে ও টেস্ট তিন ফরম্যাটেই বাংলাদেশ হোয়াইট ওয়াশ হয়েছে। কিছু সুযোগ বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা মিস করেছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আরো বেশি দায়িত্বশীলতার পরিচয়ও দেওয়ার সুযোগ ছিল। এর বাইরে অচেনা কন্ডিশন ও খেলোয়াড়দের ইনজুরি নিউজিল্যান্ড সফর‍জুড়ে বাংলাদেশ দলকে ভুগিয়েছে। তবে দলের স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যান ও বোলাররা যদি একটু সতর্ক হতেন হয়তো হোয়াইট ওয়াশের বদলে অন্য কিছুও হতে পারতো। কিন্তু যা হয়নি, তা নিয়ে কথা বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। সামনের দিনে প্রতিটি খেলোয়াড় নিজেদের দায়িত্ব ও দল এবং দেশের ক্রিকেট দর্শকদের প্রত্যাশার কথা মাথায় রেখে খেলবেন এমনটা আশা করতেই পারি।

তিন ফরম্যাটে বাংলাদেশের পরাজয়ের পর অনেককেই দেখলাম নাখোশ হতে। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তো বাংলাদেশ দলের সমালোচনার শেষ নাই। আমাকে প্রশ্ন করা হতে পারে তাহলে কি বাংলাদেশের পরাজয়ে আমি খুশি? ব্যাপারটি মোটেও তা নয়। আবেগ ও প্রত্যাশার বাইরে ক্রিকেট পরিসংখ্যানের দিকে তাকালেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে। বলা হয় ক্রিকেট গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা। কিন্তু সেটা তো আর সব সময়, সব ম্যাচ আর সব দলের ক্ষেত্রে মানানসই নাও হতে পারে। আর ওই যে নিজ দেশে সব দলই বাঘ সে কথা তো ক্রিকেটে বহু পুরোনো। বিদেশের মাটিতে তাই ক্রিকেটের পরাশক্তিকেও নাকানি চুবানি খেতে হয়। শুধু যেন বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই এমনটা ঘটা মানা। দেশ-বিদেশের ক্রিকেট বোদ্ধারা বাংলাদেরশ দর্শকেদের ক্ষেত্রে একটা কথা প্রায়ই ব্যবহার করেন যে, তারা এখনো ম্যাচিউর হতে পারেনি। নিউজিল্যান্ড সফর শেষে সত্যিই তা মনে হচ্ছে। কোনো কিছু বুঝতে চাই না, শুধু বাংলাদেশের জয় চাই।

উপমহাদেশে আমাদের চেয়ে অনেক আগেই ভারত, শ্রীলংকা ও পাকিস্তান ক্রিকেটে নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছে। ক্রিকেটের পরাশক্তির মধ্যে এই দলগুলোর নাম প্রথম দিকে। বাংলাদেশে শুধূ উপমহাদেশের না, ক্রিকেট বিশ্বের যেকোনো দলকে হারানোর সামর্থ্য রাখে। আর তা অঘটন হিসেবে নয়, নিয়মিতই হারাতে পারে এখন। তারপরও তো আমরা এখনো ভারত কিংবা শ্রীলংকার সমপর্যায়ের দল হয়ে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয় না। আমাদের এখনো অনেক পথ পাড়ি দিতে হবে সে জন্য। একদিনে সে জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব না। বাংলাদেশ দলের হারকে সমর্থন করতে নয়, ক্রিকেটে যে এই রকমটা স্বাভাবিক এটাই বলতে চাচ্ছি। কারণ ভারত পাকিস্তান ও শ্রীলংকার উপমহাদেশের বাইরে, বিদেশের মাটিতে সর্বশেষ তিন সিরিজের দিকে তাকালেই এই ব্যাপারটি আরো পরিষ্কার হবে। যেমন ভারত সর্বশেষ ওয়েস্টইন্ডিজ সফর করেছে। সেখানে তারা চারটি টেস্ট খেলেছে। এর মধ্যে দুটিতে জয় ও দুটিতে ড্র করেছে। ওয়েস্টইন্ডিজের বর্তমান ক্রিকেট সামর্থ্য নিয়ে নতুন করে বলার কিছূ নেই। তার আগে জিম্বাবুয়ে সফরে যায় ভারত। সেখানে তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের তিনটিতেই জয় পায় ভারত। আর তিনটি টি-টোয়েন্টির সিরিজ জেতে ২-১ এ। তার মধ্যে একটা আবার তিন রানের জয় আছে। আর জিম্বাবুয়ের বর্তমান ক্রিকেট সামর্থ্য তাদের র‌্যাঙ্কিংই বলে দেয়। তারও আগে অস্ট্রেলিয়া সফরে যায় ভারত। সেখানে পাঁচ ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজে ৪-১ হারে ভারত। তবে ভারত তিন টি-টোয়েন্টির সিরিজ জিতে ৩-০ তে।

আর শ্রীলংকা সর্বশেষ দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে গিয়ে তিন টেস্টের তিনটিতেই হারে। দুটি টি-টোয়েন্টির একটিতে হারে, একটিতে জিতে। তার আগে জিম্বাবুয়ে সফরে দুটি টেস্টের ‍দুটিতেই জয় পায়। জিম্বাবুয়ের সামর্থ্যের ব্যাপারে আগেই বলা হয়েছে। তারও আগে ইংল্যান্ড সফরে যায় শ্রীলংকা। সেখানে পাঁচ ওয়ানডের তিনটিতে হারে, একটি টাই হয়, আর একটি পরিত্যক্ত হয়। আর একমাত্র টি-টোয়েন্টি ম্যাচেও শ্রীলংকা হারে।

এবার আসা যাক পাকিস্তানের পরিসংখ্যানে। পাকিস্তান বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া সফর করছে। পাঁচ ওয়ানডের চারটিতে হেরেছে। একটিতে জিতেছে। আর তিন টেস্টের তিনটিতেই হেরেছে পাকিস্তান। এর আগে নিউজিল্যান্ড সফরে দুটি টেস্টের ‍দুটিতেই হেরেছে পাকিস্তান। তারও আগে ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড সফর করে পাকিস্তান। একমাত্র টি-টোয়েন্টিতে ইংল্যান্ডের সঙ্গে পাকিস্তান জেতে। পাঁচ ম্যাচ ওয়ানডেতে ৪-১ হেরেছে পাকিস্তান। আর চার ম্যাচ টেস্টের দুটিতে হেরেছে, দুটিতে জিতেছে। আর আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে দুটি ওয়ানডের একটিতে জেতে পাকিস্তান। অন্যটি পরিত্যক্ত হয়।

দল জিতুক সমর্থকরা প্রত্যাশা করতেই পারে। তবে তা যেন ‍যুক্তি আর ক্রিকেট মাঠের পরিসংখ্যান এবং ক্রিকেট জ্ঞানের বাইরে গিয়ে না হয়। কারণ আমাদের যুক্তিহীন প্রত্যাশা খেলোয়াড়দের ওপর চাপ তৈরি করে। আবারো বলছি, নিউজিল্যান্ড সফরে আমাদের দলের হয়তো আরো ভালো খেলার সুযোগ ছিল। মাঠে কিছু সহজ সুযোগ হারিয়েছে বাংলাদেশ। তার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল তাদের অতীতের অবস্থানে চলে গেছে। হারের বৃত্তে বন্দি হয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। চলতি বছরের মে মাসে নিউজিল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ত্রিদেশীয় সিরিজ আছে বাংলাদেশের। নিউজিল্যান্ড সফরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আশা করি ত্রিদেশীয় সিরেজেই ‍ঘুরে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ জানুয়ারি ২০১৭/রুহুল/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়