ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

নির্বিঘ্ন হোক প্রাণের বইমেলা

অঞ্জন আচার্য || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৪:৪১, ২৮ জানুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
নির্বিঘ্ন হোক প্রাণের বইমেলা

|| অঞ্জন আচার্য ||

বইয়ের যারা সারা বছরের ক্রেতা, বলতে গেলে আমি তাদের একজন। প্রায় প্রতি সপ্তাহে কোনো না-কোনো বই কেনা আমার হয়ই হয়। এটা আমার এক ধরনের নেশা। শাহবাগের আজিজ মার্কেট, কাঁটাবনের কনকর্ড টাওয়ার, পুরানা পল্টন কিংবা নীলক্ষেতের ফুটপাথে একবার ঢুঁ না দিলে কেমন যেন অস্থিরতা জাগে। এমনও হয়েছে, পকেটে রাখা অবশিষ্ট গাড়ি ভাড়াটুকু দিয়ে বই কিনে বাসায় ফিরেছি হাঁটতে হাঁটতে দীর্ঘ পথ ধরে। ভালো বই পেলে লোভ সংবরণ করার মতো সংযমী মানুষ আমি নই। আর এই আমার কাছে বই কেন্দ্র করে মেলা যে আলাদা অর্থবহন করে, তা নিশ্চয়ই বলে বোঝাতে হবে না।

মেলা মানেই মেলা মানুষের ভিড়। বাঙালির জাতীয় চেতনার এক বৃহত্তর আদর্শের নাম- অমর একুশে গ্রন্থমেলা। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম স্মৃতিবাহক এ মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস ও ঐতিহ্য। মাসব্যাপী এমন আয়োজন পৃথিবীর অন্য কোথাও হয় কিনা আমার জানা নেই। লেখক-পাঠক-প্রকাশকসহ সর্বস্তরের মানুষের এক প্রাণের মেলা এ বইমেলা। বাংলাদেশ, তথা সমগ্র বাঙালির এমন ধারাবাহিক ও মাসব্যাপী বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস ও সপ্রণোদিত সম্মিলন আমার কাছে বড় পবিত্র মনে হয়। অসাম্প্রদায়িক চেতনা উদ্বুদ্ধ করতে দেশের মানুষকে এক মঞ্চে ঠাঁই দেয় এই গ্রন্থমেলা।

স্বভাবগত দিক থেকে আমি আড্ডাপ্রিয় হলেও যতদূর সম্ভব কোলাহল এড়িয়ে চলি। বইমেলায় গেলেও আমি ঠাঁই হিসেবে বেছে নিই বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের লিটলম্যাগ চত্বর। জনপ্রিয় বা বাজারি লেখকদের কাছে যে জায়গাটি অচ্ছুৎ এবং তাদের ভাষায় স্থানটি আঁতেল কিংবা অতি বুদ্ধিজীবীদের আস্তানা হিসেবে গণ্য। তবে যারা তথাকথিত জনপ্রিয়তা বা আঁতেল সম্প্রদায়ের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থান করেন, তারা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণ- দু জায়গাতেই পা রাখেন। সুযোগ পেলে লেখক-কাম-বিক্রেতাদের মতো করে স্টলের ভেতর বসে ভক্তদের অটোগ্রাফ দেন, আবার ধূমপান বা আড্ডাবাজি করতে লিটলম্যাগ প্রাঙ্গণে এসে নিজেদের অবস্থা ও অবস্থানকে স্মরণ করিয়ে দেন। তবে গত বছর সার্বিক নিরাপত্তার অজুহাত তুলে মেলার নির্ধারিত সময়সীমা কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল শুরুর দিকে, যা ছিল বড় লজ্জার। কোথায় সময় বাড়ানো হবে তা নয়; সেখানে সময় কমিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণযোগ্য ছিল না। অবশেষে সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হয়। সময় ও নিরাপত্তা- দুই-ই বাড়ানো হয়। তাছাড়া বইমেলা তো কেবল বই কেনা-বেচার কোনো স্থান মাত্র নয়, এটি লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের একটা মিলন মেলা। বছরের একটি মাস সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটা জায়গায় এসে মিলিত হয়, আড্ডা দেয়, পরস্পরের সঙ্গে ভাব ও চিন্তা বিনিময় করেন। মেলা উপলক্ষ্যে ঢাকার বাইরে থেকেও লেখক-পাঠক আসেন। যানজটের এই ঢাকা নগরীতে কেউ চাইলেই একজন আরেকজনের সঙ্গে নিয়মিত দেখা করতে পারেন না- এটাই বাস্তবতা। তবে এই পারস্পরিক মিলনের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে বইমেলা।

একটু নিজের প্রসঙ্গে আসি। প্রতি বছর বই প্রকাশ করতেই হবে এমন লেখক আমি নই। সারা বছর লিখছি কিনা তাই আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এমন অনেককে দেখি, বছরজুড়ে যারা কোথাও এক লাইনও লিখেন না, তবে বইমেলা এলেই পাঁচ-ছয়টা করে বই প্রকাশ করেন। আত্মপ্রচারে কোমর বেঁধে নামেন। নিজের খরচে দৈনিক পত্রিকাগুলোতে নিজের ছবিসহ রঙিন বিজ্ঞাপনও দেন। এমন নির্লজ্জ ভাব দেখে বড় লজ্জা লাগে।

এক মেলায় একাধিক বই বের করার মতো সাহস আমার নেই। সত্যি বলতে, সেই মেধা বা ক্ষমতাও আমার নেই। আমি কেবল ভাবি, লিখি, লেখাটা হচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে ভাবি। তবে আমরা যারা পরীক্ষার আগে নাকে-মুখে লেখাপড়া করা ছাত্র, তাদের ক্ষেত্রে তাগাদা একটা ভালো ফল নিয়ে আসে। মেলা আসছে দেখে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লেখাগুলোকে একটু গুছিয়ে নেওয়া যায় আর কি। তবে এ কথাও সত্য, মেলার মধ্যে নিজের নতুন বই প্রকাশ না পেলে মেলাটাকে তেমন আপন মনে হয় না। বিমর্ষ হয়ে ইতস্তত ঘুরাফেরা করতে হয়। আত্মগ্লানিতে ভুগতে হয় লেখক-বন্ধুদের প্রকাশিত বই দেখে। বই প্রকাশের আনন্দে উদ্ভাসিত প্রিয় বন্ধুর মুখ দেখে ঈর্ষান্বিত হয়ে আগামী বছর যে করেই হোক কিছু একটা করে দেখানোর জেদও চাপে মনে মনে। আর মেলা শেষ হলে সেই জেদের আগুন নিভতে বেশি একটা সময়ও লাগে না। তবে যেবার মেলায় বই প্রকাশ পায়, সেই বারের কথা তো একেবারেই আলাদা। মনে হয়, পুরো মেলাটাই আয়োজন করা হয়েছে আমারই জন্য। স্কুল-কলেজের একান্ত অনুগত ছাত্রের মতো প্রতিদিন মেলায় আসা চাই-ই চাই।

প্রকৃতপক্ষে বই ঘিরে মেলা, এটা ভাবতেই ভালো লাগে। বইয়ের সারি সারি স্টল, নতুন বইয়ের ঘ্রাণ আমাকে মোহিত করে। তাছাড়া এই নাগরিক যন্ত্রণাময় ঢাকা শহরে বইমেলা একটু প্রাণে অক্সিজেন দেয়- এটাই-বা কম কীসে? তবে দুঃখের কথা হলো, যে পরিমাণ বই মেলাকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত হয়, তার অধিকাংশই অপাঠ্য-অগ্রহণযোগ্য। বইয়ের বিষয়বস্তু তো যা ইচ্ছা তা, সেই সঙ্গে বইয়ের সার্বিক প্রস্তুত প্রণালিও বড়ো করুণ। কি বানান-শব্দ-ভাষা সংশোধনে, কি প্রচ্ছদে বা অলঙ্করণে, কি বাঁধাই-কাটাইয়ে। তাই বইপড়ায় বিমুখ হয়ে পড়েন পাঠক। এদিকে কেবল নান্দনিকতার দিকটি তুলে ধরে পাঠককে ঠকাতেও দেখা যায় কাউকে কাউকে। বইয়ের বিষয়বস্তু কিছুই নয়, তবে নাম কিংবা অঙ্গসৌষ্ঠব দেখে মনে হয় যেন বেশ গুরুত্বপূর্ণ বই। এটা হঠকারিতা ছাড়া আর কি? অন্যদিকে গল্প-কবিতা-উপন্যাস ছাড়াও যে নানা বিষয়ের ওপর বই হতে পারে তা অনেক লেখকই উপলব্ধি করেন না। সস্তা জনপ্রিয় গল্প-উপন্যাসের বিক্রি দিয়ে মোটেও পাঠ বা পাঠককে বিচার করা উচিত হবে না। পাঠককে সমৃদ্ধ করতে হবে পাঠের ভিন্নতা দিয়ে। পাঠকের রূচিকে ঋদ্ধ করতে হবে বিষয়ের বৈচিত্র্যে। এ দায় আমাদের সবার। পাঠের নিম্নগামিতা কিন্তু সমাজে ভালো ফল নিয়ে আসে না। পাঠকের সৃজনশীলতা ও মননশীলতা বিস্তৃত করতে হলে বইয়ের বিষয় দিয়ে আগ্রহী করে তুলতে হবে। বইকে চাল-ডাল-আটা-বেগুনের মতো করে পণ্য হিসেবে দেখলে তার সর্বনাশের দায় সবার আগে বর্তাবে লেখকের ওপর, তারপর প্রকাশকের। যে পরিমাণ বইয়ের আবর্জনার স্তূপ জমে বইমেলা শেষে- তা কিন্তু অশনি-সংকেত বহন করে।

বইমেলা সম্পর্কে অনেকেই পরামর্শ চান আমার কাছে। বিশেষ কোনো পরামর্শ দেওয়ার কিছু নেই। সেই যোগ্যতাও আমার নেই; সেই ধৃষ্টাতাও আমি দেখাতে চাচ্ছি না। তবে এটি বাঙালি প্রাণের মেলা হলেও তার কিছু প্রতিবন্ধকতা চোখে পড়েছে মেলাকে ঘিরে। আমরা তো জানি, স্থান সংকুলানের অভাবে দীর্ঘদিন ধরেই চলছিল এর সম্প্রসারণ প্রক্রিয়া। তাই বইমেলাটি বাংলা একাডেমির সীমিত পরিধির বাইরে রেখে সম্প্রসারিত করা হয়েছে রমনার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। একাডেমির ভেতরে রাখা হয় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও ছোটকাগজের স্টলগুলো। ভালো উদ্যোগ। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে এ ধরনের বৃহৎ সিদ্ধান্তের ফলে দেখা দেয় অনেক কিছুর ঘাটতি। অপরিকল্পিত স্টল সজ্জা তো আছেই, সেই সাথে সবচেয়ে বড়ো যে বিষয়টি দেখলাম, তা হলো অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ। ধুলার ঝড়ে প্রাণের মেলার প্রাণ যেন ওষ্ঠাগত হয়ে পড়ে। এটা অবশ্যই আসছে বইমেলায় থাকবে না- এমনটা আশা করছি। মেলায় প্রবেশ ও প্রস্থানের পথটি সুশৃঙ্খল উপায়ে হয় না। টিএসসি থেকে শৃঙ্খলিতভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে প্রবেশদ্বারে এলেও প্রবেশ পথে এসে জটলা লেগে যায়। এটা বড় বিরক্তিকর ও দুর্ভোগের। তাছাড়া মাঠে যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলা, ধূমপান করা রোধ করতে হবে। স্টলকেন্দ্রিক আলোকসজ্জার বাইরে মেলার মাঠ ঘিরে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করা উচিত বলে আমি মনে করি।

এ বিষয়ে বাংলা একাডেমিকে উপদেশ দেয়ার কিছু নেই। তারা সবকিছুই খুব ভালো বোঝেন, ভালো জানেন। কিন্তু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হলেও প্রতিষ্ঠানটি সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠান ছাড়া কিছু নয়। আমি এক নিতান্ত কবি হয়ে হাজারো চিৎকার করলেও তারা তাতে কান দেবে বলে মনে করি না। এ বছরে শ্রাবণ প্রকাশনীকে দুই বছরের জন্য মেলায় নিষিদ্ধ করা এবং পরবর্তীকালে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা, গত বছর একটি বইকে কেন্দ্র করে বদ্বীপ প্রকাশনীর স্টল বন্ধ করা এবং প্রকাশককে গ্রেফতার করা, এর আগে রোদেলা প্রকাশনী বন্ধ করে দেয়াটা নিশ্চয়ই বাংলা একাডেমির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে না। এসকল নেতিবাচক দৃষ্টান্ত লেখক-পাঠকসহ সকল শ্রেণির মানুষের মনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে- এটা মনে রাখতে হবে। সকলের শুভ হোক। নির্বিঘ্ন হোক প্রাণের বইমেলা- এমনটাই প্রত্যাশা।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ জানুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়