ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

তিনি থাকুন চন্দ্রে, জোছনা ও জলতরঙ্গে

শিহাব শাহরিয়ার || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৯:৩৯, ৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
তিনি থাকুন চন্দ্রে, জোছনা ও জলতরঙ্গে

|| শিহাব শাহরিয়ার ||
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ক্যানসারের সাথে লড়াই করে, রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা মাথায় নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা গেলেন সত্তর লাখ টাকার দুর্নীতির কলঙ্ক গায়ে নিয়ে। কেউ কেউ বিশেষ করে তথাকথিত কোনো কোনো মিডিয়া তাকে ‘কালো বিড়াল’ও বানিয়ে ফেলল- কি বিচিত্র আমাদের চরিত্র! ইচ্ছে করলেই, আমরা কাউকে বানিয়ে ফেলি রাজপুত্তুর, আবার ইচ্ছে করলেই ফেলে দেই ডাস্টবিনে; অভিযোগ প্রমাণিত হবার আগেই দোষী সাব্যস্ত করি। আজ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মারা গেছেন বলে কি এ কথা বলছি? না, বলছি আমাদের মানসিক বিকারগ্রস্ততা নিয়ে। আমরা একবারো ভাবি না, একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কি সহজেই তৈরি হয় বা বানানো যায়! একজন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কি হঠাৎ করেই আকাশ থেকে পড়েন। আর পড়েই কি বর্ণাঢ্য-জীবন ধারণ করেন। তাহলে ‘তিল তিল করে’ বাক্যটির মর্যাদা থাকতো না। বলছি এ কারণে যে, মৃত্যুর পর আমরা একজন মানুষকে এতো মহান ভাবি যে, মৃত্যুর আগে তাকে ১০ ভাগ সাধুও ভাবতে পারি না! এখন দেখা যাবে এই তথাকথিত মিডিয়াই বা কতিপয় ব্যক্তি বলবেন, তার মতো (সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত) জিনিয়াস রাজনীতিবিদ বাংলাদেশে দ্বিতীয়টি নেই। কেন এই হীনমন্যতা? আমাদের কেন এই অধঃপতন?

৫ জানুয়ারি ২০১৭, আমরা ঘুম ভেঙে একটি দুঃসংবাদের মুখোমুখি হলাম- খুব ভোরে চির নিদ্রায় চলে গেলেন বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মণ্ডলির সদস্য, বর্তমান দশম জাতীয় সংসদের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক কমিটির সভাপতি, বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রবক্তা, এদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রধানতম পুরুষ, ১৯৭২ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত প্রতিটি সংসদের নির্বাচিত সদস্য, মানবতাবাদী, অসাম্প্রদায়িক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনাধারী, অনল বক্তা, বিশিষ্ট আইন বিশেষজ্ঞ, রসিক ও প্রাণবন্ত মানুষ শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তার এই মৃত্যুতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, রাজনীতি, সুন্দর সমাজনীতির ক্ষেত্রে অপূরণীয় ক্ষতি হলো। এই বিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান তার বক্তৃতায়, আচরণে, লেখায় এবং উচ্চারণে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর গণতন্ত্রকামী মানুষের জন্য নিরলস কাজ করে গেছেন। কোনো ডিগবাজী নয়, বাংলাদেশ নামক দেশের নিমিত্তে স্থির থেকে আমৃত্যু স্বপ্ন দেখেছেন সমৃদ্ধ বাংলাদেশের, সুখী মানুষের আর সুন্দর পৃথিবীর। মৃত্যুর পর পরই তার একমাত্র পুত্র সৌমেন সেনগুপ্ত বলেছেন: ‘বাবা বলতেন মানুষের সব সময়ই উপকার করবে।’

শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ১৯৪৬ সালের ৫ মে হাওর অঞ্চল সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আনোয়ারপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। শুরুতে বাম রাজনীতি করতেন। ১৯৭০ সালে তিনি পাকিস্তান পার্লামেন্টের তরুণ পার্লামেন্টারিয়ান ছিলেন, তখন তার বয়স ছিল মাত্র ২৬ বছর; যিনি তখন সবচেয়ে কনিষ্ঠতম সদস্য। এরপর যুক্ত হন বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মহান মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি স্বাধীন দেশের প্রথম পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি বঙ্গবন্ধুর বাকশালে যোগদান করেন। পরবর্তীতে তিনি যোগদান করেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি এই ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির সঙ্গেই যুক্ত ছিলেন। নীতি ও আদর্শে অটুট ছিলেন বলেই এই রাজনৈতিক দৃঢ়তা তাকে মহান রাজনীতিবিদের মর্যাদা দিয়েছে। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের আরেকজন প্রয়াত বর্ষীয়ান নেতা আবদুস সামাদ আজাদ ছিলেন একই অঞ্চলের সমমর্যাদার মানুষ। মতগত কিছুটা স্বাভাবিক পাথর্ক্য থাকলেও চেতনা ও আদর্শগতভাবে দুজনেরই ছিল বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের মানুষের প্রতি আস্থা, নির্ভরশীল ও প্রাণান্ত ভালবাসা।

বঙ্গবন্ধুর পর তারই সুযোগ্যা তনয়া সুপ্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গণতন্ত্রের পক্ষে নিরলস কাজ করে গেছেন।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে একজন আইন প্রণেতা হিসেবে মর্যাদা দিয়েছেন, বানিয়েছেন সরকারের রেলমন্ত্রী। আইন বিশেষজ্ঞ এই রাজনীতিবিদের কাছ থেকে তার সহযোদ্ধারা সব সময়ই বুদ্ধি, পরামর্শ ও সহযোগিতা গ্রহণ করতেন। প্রবীণ রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমু তার মৃত্যুর পর এক স্মৃতিচারণে বলেছেন: ‘আইন বিষয়ে কোন প্রয়োজন হলেই আমি ছুটে যেতাম সুরঞ্জিতদার কাছে।’

আমরা যারা শ্রোতা, আমরা যারা সাধারণ নাগরিক, তারা তন্ময় হয়ে শুনতাম সংসদ কিংবা বিভিন্ন জায়গায় দেওয়া তার সত্য ভাষণ ও গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা। উপমা দিয়ে, যুক্তি দিয়ে আর অত্যন্ত নান্দনিক করে তিনি কথা বলতেন। অত্যন্ত রসিক মানুষও ছিলেন। এখানে তাকে নিয়ে একটি স্মৃতিকথা বলি। ১৯৯৮ সালের কথা। আমি তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনে অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করি। জেনারেল এম এ জি ওসমানীর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠান হবে। অনুষ্ঠানের পরিকল্পক ও প্রযোজক বললেন, এতে শ্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের একটি সাক্ষাৎকার নিতে হবে। আমি বললাম, ঠিক আছে। আমাকে দায়িত্ব দেওয়া হলো, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমি যোগাযোগ করে জানলাম, তিনি সেদিন সুনামগঞ্জ নিজ এলাকায় আছেন। টেলিফোন করা হলে, তিনি জানালেন, দুপুরের পর পরই তিনি বিমানে ঢাকায় আসবেন। আমাদের তিনি সংসদ ভবনে তার অফিস কক্ষে বেলা ২.৩০ মিনিটের মধ্যে ক্যামেরা ইউনিট নিয়ে উপস্থিত থাকতে বললেন। আমরা সে অনুযায়ী সেখানে উপস্থিত হলাম। তিনিও যথাসময়ে এসে হাজির হলেন। আগেও বহুবার তাকে দেখেছি, কিন্তু আজ খুব কাছে থেকে, খুব অন্তরঙ্গ দেখার সুযোগ হলো, কারণ তার সাক্ষাৎকারটি আমি নিজে নিচ্ছি। তিনি কক্ষে ঢুকেই একটি হাসি দিয়ে সিলেটের আঞ্চলিকতায় রসিকতা করলেন। মুহূর্তেই পাল্টে গেল আমাদের কক্ষের পরিবেশ। সামনাসামনি না হলে বুঝতাম না রাজনীতিক সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের ব্যক্তি মানস ও মানসিক গভীরতা। আমিও নিজেকে ভাগ্যবান মনে করলাম যে, বাংলাদেশের সমবয়সী যে পার্লামেন্টারিয়ানের মুখোমুখি হয়ে তার উচ্চারণ থেকে ইতিহাসের পাতার অনেক অক্ষর, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনা নায়ক জেনারেল ওসমানী সম্পর্কে অনেক অজানা অধ্যায় জানতে পারলাম। সাক্ষাৎকার শেষ হলে তিনি অনানুষ্ঠানিক পর্বে আরো কিছুক্ষণ খোলামেলা অনেক কথা বললেন, রসিকতা করলেন, আপ্যায়ন করালেন এবং আমন্ত্রণ জানালেন, যে কোনো সময় যে কোনো প্রয়োজনে তার কাছে যেতে।

আন্তরিক এই বর্ণাঢ্য রাজনীতিবিদ মানুষটি মাত্র ৭১ বছর বয়সে পাড়ি জমালেন সুদূরের অন্তহীন দেশে। আত্মাবিহীন তিনি ফিরে গেলেন, নিজ জন্মগ্রামে। শেষ ইচ্ছায় তিনি বলেছেন: তাকে যেন চন্দন কাঠে দাহ করা হয়। তাকে মনে রাখবে হাওর, মনে রাখবে, সুরমা, মনে রাখবে সুনামগঞ্জ থেকে সুন্দরবন। মনে রাখবে, বাংলাদেশ, বাংলাদেশের গণতন্ত্র, বাংলাদেশের আইন ও শাসন ব্যবস্থা, মনে রাখবে বাংলাদেশের মানুষ। আর আমি মনে রাখবো, স্মৃতির অনিন্দ্য আয়নায়। মনে রাখবো শেষ মুখচিহ্নটি, সেটি মৃত্যুর কয়েকদিন আগে, জাতীয় সংসদের দশম অধিবেশনের একটি দিনে, যেদিন সর্বশেষ তাকে দেখলাম নিজের চেয়ারে বসে অন্য একজন সদস্যের চমৎকার বক্তৃতার সময় হাততালি দিচ্ছিলেন, মাথা নেড়ে সমর্থন দিচ্ছিলেন এবং মাঝে মাঝেই হেসে উঠছিলেন। এই হাসিমুখটিই থাকুক লুই কানের ডিজাইন করা চমৎকার সংসদ ভবনে, থাকুক ঝিগাতলায়, থাকুক আনোয়ারপুর গ্রামে, থাকুক হাওরের জলতরঙ্গে। তিনি থাকুন চন্দ্রে, জোছনায় ও জলতরঙ্গে।        



রাইজিংবিডি/ঢাকা/৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়