ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

একাশিতে ড. আনিসুজ্জামান

শাহ মতিন টিপু || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৬:৫৮, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একাশিতে ড. আনিসুজ্জামান

শাহ মতিন টিপু : ড. আনিসুজ্জামান একজন জীবন্ত কিংবদন্তি।তার কর্ম ও সৃষ্টির ব্যাপকতা অবাক করার মতো।যাকে নিয়ে রীতিমতো গর্ব করা যায়। দেশবরেণ্য অনন্য প্রতিভাবান, গুণেমানে কীর্তিমান, প্রবন্ধকার, গবেষক, অনুবাদক, লেখক, সাহিত্যিক ড. আনিসুজ্জামানের ৮১তম জন্মদিন আজ।

১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের ২৪ পরগনা জেলার বসিরহাটে জন্মগ্রহণ করেন। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রফেসর ইমেরিটাস। তিনি প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস নিয়ে ড. আনিসুজ্জামানের গবেষণা উল্লেখযোগ্য।

বাবা এ টি এম মোয়াজ্জেম ছিলেন বিখ্যাত হোমিও চিকিৎসক। মা সৈয়দা খাতুন গৃহিণী হলেও লেখালেখির অভ্যাস ছিল। পিতামহ শেখ আবদুর রহিম ছিলেন লেখক ও সাংবাদিক। পাঁচ ভাই-বোন। তিন বোনের ছোট আনিসুজ্জামান, তারপর আরেকটি ভাই। বড় বোনও নিয়মিত কবিতা লিখতেন। বলা যায়, শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যসমৃদ্ধ ছিল তাদের পরিবার।

কলকাতায় শিক্ষাজীবন শুরু হলেও সপ্তম শ্রেণির পরে এ দেশে ভর্তি হন খুলনা জিলা স্কুলে। পরের বছরই পরিবারের সঙ্গে চলে আসেন ঢাকায় । এরপর ম্যাট্রিক, আইএ, বিএ সবই ঢাকায়। সে সময় বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। শিক্ষক হিসেবে তিনি পেয়েছিলেন শহীদ মুনীর চৌধুরীকে। ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে স্নাতক সম্মান এবং এমএতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন আনিসুজ্জামান।

পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে তিনি বাংলা একাডেমির প্রথম গবেষণা বৃত্তি পেলেন। কিন্তু এক বছর যেতে না যেতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক-শূন্যতায় বাংলা একাডেমির বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেন এই বিশিষ্ট লেখক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে তার কর্মজীবন শেষ করে বর্তমানে অবসরে রয়েছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ গবেষণাগ্রন্থ রয়েছে তার। গবেষক ও সাহিত্যিক হিসেবে একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কারসহ বেশ কিছু পুরস্কারে তিনি ভূষিত হয়েছেন।

'ইংরেজ আমলের বাংলা সাহিত্যে বাঙালি মুসলমানের চিন্তাধারায় ১৭৫৭-১৯১৮' বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি পিএইচডি করেন । শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'উনিশ শতকের বাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস : ইয়ং বেঙ্গল ও সমকাল' বিষয়ে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন।

আনিসুজ্জামানের কর্মজীবনও ছিল আলোকোজ্জ্বল। মাত্র ২২ বছর বয়সেই কর্মজীবন শুরু। প্রথমে অ্যাডহক ভিত্তিতে চাকরি হলো তিন মাসের। এরপর কয়েক মাস বেকার । তারপর পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের গবেষণা বৃত্তি পেলেন। এর কয়েক মাস পর অক্টোবর মাসে আবার যোগ দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায়। ১৯৬৯ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের রিডার হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেই অবস্থান । পরে ভারতে গিয়ে প্রথমে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন 'বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি'র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তারপর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ অ্যাকাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা-প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত। ১৯৮৫ তে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেন ২০০৩ সালে। পরে সংখ্যাতিরিক্ত অধ্যাপক হিসেবে আবার যুক্ত হন। তিনি মওলানা আবুল কালাম আজাদ ইনস্টিটিউট অব এশিয়ান স্টাডিজ (কলকাতা), প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয় এবং নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভিজিটিং ফেলো ছিলেন। এ ছাড়া তিনি নজরুল ইনস্টিটিউট ও বাংলা একাডেমির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি শিল্পকলাবিষয়ক ত্রৈমাসিক পত্রিকা যামিনী এবং বাংলা মাসিকপত্র কালি ও কলম-এর সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন।

প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ১৯৫০ সাল থেকে তার পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা। মুজিবনগরে তিনি তাজউদ্দীনের বিচক্ষণ কর্মকাণ্ড সরেজমিনে কাছ থেকে দেখেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। মহান ভাষা আন্দোলন, রবীন্দ্র উচ্ছেদবিরোধী আন্দোলন, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী আন্দোলন এবং ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন।

এ বছর বাংলা একাডেমির সভাপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানকে ‘সাম্মানিক ডি. লিট’ উপাধিতে ভূষিত করেছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের আসানসোলের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়। ১৬ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য কেশরীনাথ ত্রিপাঠী ড. আনিসুজ্জামানকে এ উপাধি প্রদান করেন। এর আগে তিনি রবীন্দ্রভারতী ও নেতাজি সুভাষ মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি. লিট লাভ করেন।

নতুন বছরেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।স্বজনরা তাকে ইউনিভার্সেল কার্ডিয়াক হাসপাতালে ভর্তি করান । এ সময় ফুসফুসে সংক্রমণের কারণে তিনি বমি করছিলেন এবং খেতে পারছিলেন না। হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, ড. আনিসুজ্জামানের হার্টে পাম্প ক্ষমতা কমে গেছে। এ ছাড়াও ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাও রয়েছে তার। তার ইলেক্ট্রোলাইটেও সমস্যা রয়েছে। আগেই দুটো রিং পরানো রয়েছে তার । অবশ্য পরে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। ৮১তম জন্মদিনের এই লগ্নেও সুস্থ আছেন এই কৃতীপুরুষ। তিনি দীর্ঘায়ু হবেন, এটাই প্রত্যাশিত। তিনি যত দীর্ঘায়ু হবেন, এ জাতি ততই লাভবান হবে।




রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/টিপু/ এএন

রাইজিংবিডি.কম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়