ঢাকা     বুধবার   ২৪ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১১ ১৪৩১

শিক্ষাক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক কিছু দিক

মাছুম বিল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০২:৪০, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
শিক্ষাক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক কিছু দিক

মাছুম বিল্লাহ : শিক্ষাক্ষেত্রে ভালমন্দ যা কিছুই ঘটে শিক্ষা সংশ্লিষ্টরা তা নিয়ে কথা বলেন, আলোচনা করেন ও লেখেন। এগুলো কেবল সমালোচনা নয় বরং সরকারের জন্য এক ধরনের পজিটিভ ফিডব্যাক।

সরকারে যারা থাকেন তারা মাঠের আসল খবর সব সময় পান না। কারণ, চাটুকারের দল তাদেরকে সর্বদাই ঘিরে রাখে। আবার রাজনীতিতে সত্যিকারের বিরোধী দলও নেই যে, তারা খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সরকারের ত্রুটি বের করবে আর সরকার সাবধান হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। তাই মিডিয়া ও বিভিন্ন পেশাজীবীরা যা বলেন তার মধ্যে সরকারকে বার্তা খুঁজতে হবে। আমরা যারা শিক্ষা নিয়ে কাজ করি, লেখালেখি করি তারা শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলোর আলোচনা, সমালোচনা, প্রশংসা- যেটির ক্ষেত্রে যা প্রাপ্য তাই করে থাকি। শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের মধ্যে এমন কিছু পদক্ষেপ থাকে যেগুলো প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য।

এটি একটি আনন্দের সংবাদ যে, এবারই (২০১৭ সালে) প্রথমবার পাঁচ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর ২৪ হাজার ৬৬১ শিশুকে বিনামূল্যে দেওয়া হচেছ ৫১ হাজার ৭৮২টি বই। নৃগোষ্ঠীর শিশুরা প্রথম স্কুলে গিয়ে বাংলা ভাষা ঠিকমতো বোঝে না। তাই অনেকেই পড়ালেখা ঠিকমতো করে না। এজন্য চাকমা, মারমা, সাদ্রী, গারো ও ত্রিপুরা- এ পাঁচ ভাষায় শিশুদের জন্য প্রাক-প্রাথমিক স্তরে তাদের মাতৃভাষায় বই দেওয়া হচ্ছে। এবারই প্রথম দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য ব্রেইল বইও ছাপানো হয়েছে। একহাজার  ২৩১ জন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে দেয়া হয়েছে ৯ হাজার ৭০৩টি ব্রেইল বই।

দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের সঠিক পরিসংখ্যান সরকারের হাতে নেই। এ ব্যাপারে জরিপ চলছে, আগামীতে সব দৃষ্টি প্রতিবন্ধীই ব্রেইল বই পাবে। পাঠদানের সুবিধার্থে এবার শিক্ষকদের জন্য এক কোটি ১৪ লাখ ২৮ হাজার ৭৬৮টি ‘শিক্ষক নির্দেশিকা’ বিতরণ করা হচেছ। কীভাবে পড়াতে হবে, সে বিষয়ে শিক্ষকদের জন্য নির্দেশনা আছে তাতে।

২০১৭ শিক্ষাবর্ষে ৪ কোটি ২৬ লাখ ৩৫ হাজার ৯২৯ জন শিক্ষার্থীর হাতে তুলে দেওয়া হচেছ ৩৬ কোটি ২১ লাখ ৮২ হাজার ২৪৫টি বই। ঢালাওভাবে সবার জন্য বিনামূল্যে বইয়ের বিষয়টি সমর্থণযোগ্য বা প্রশংসনীয় বলে আমি মনে করি না। তবে এই বিষয়টির প্রশংসা না করে পারছিনা যে, দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে ব্রেইল বই দেয়া হচেছ। ধনী দরিদ্র, শহর গ্রাম, সব জায়গায় বিনামূল্যে বই বিতরণ করতে গিয়ে প্রতিবছরই বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। কারণ এটি একটি বিশাল কর্মযজ্ঞ যা করতে গিয়ে অনেক ভুল-ভ্রান্তি তো আছেই, মানের দিকে কেউই খেয়াল রাখতে পারছে না।

এক্ষেত্রে আমি মনে করি, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থী ও বস্তিবাসীদের বিনামূল্যে বই দেয়া এবং প্রতিবন্ধীদের বিনামূল্যে বই ও উন্নতমানের শিক্ষন সামগ্রী দেয়ার উপরই জোর দেয়া উচিত। সরকার এই কাজটি এবার শুরু করায় ধন্যবাদ পাওয়ার উপযুক্ত। আর একটি প্রশংসনীয় কাজ হচ্ছে শিক্ষকদের জন্য শিক্ষক নির্দেশিকা বিতরণ। নতুন অনেক শিক্ষক এসেছেন শিক্ষকতা পেশায়, যাদের অভিজ্ঞতা নেই, নতুন ধরনের বই-পুস্তকের সাথে পরিচিতি নেই। এই শিক্ষকদের জন্য শিক্ষক নির্দেশিকা খুবই প্রয়োজনীয় একটি উপকরণ।

২০১৫ সাল থেকে প্রাথমিকের সব শিশুই এসেছে উপবৃত্তির আওতায়। আগে ৭৮ লাখ শিশু উপবৃত্তির আওতায় ছিল। এখন এক কোটি ৩০ লাখ। প্রতিমাসে  ১০০ টাকা হারে উপবৃত্তি দেওয়া হচেছ। তবে আগের মতোই সিটি কর্পোরেশন ও পৌর এলাকার স্কুলগুলোকে উপবৃত্তির বাইরে রাখা হয়েছে। শিশুদের প্রতিমাসে উপবৃত্তি দেওয়া হলে এই টাকা দিয়ে তারা খাতা-কলম কিনতে পারবে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা অভিভাবকগণ যখন দেখবেন যে, তাদের সন্তানদের পড়াতে কোন খরচই হচ্ছে না, তখন অসচ্ছল অভিভাবকগণও তাদের বাচ্চাদের স্কুলে পাঠাবেন। কাজেই সরকারের এটি একটি চমৎকার পদক্ষেপ।

বাচ্চাদের উপবৃত্তির টাকা অভিভাবকদের মোবাইল ফোনে দেয়া হবে বলে জানা যায়। এটি আরও একটি ভাল দিক। রূপালী ব্যাংকের শিউর ক্যাশ-এর মাধ্যমে এই উপবৃত্তির টাকা দেয়া হবে।

১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ৮৪৩টি বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার। জাতীয় পার্টি ও বিএনপি সরকারের আমলে মাত্র ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি করা হয়েছে। বিষয়টি অত্যন্ত দু:খজনক কারণ, জাতীয় পার্টির সরকার কিংবা বিএনপির সরকার যেই হোক সেই সরকারের সবাই বাংলাদেশের মানুষ। কীভাবে তারা বিষয়টিকে একেবারেই গুরুত্ব না দিয়ে চলতে পেরেছন তা বুঝতে কষ্ট হয়। ২০০৮ সালের এক জরিপে দেখা যায়, ১৬ হাজার ১৪২টি গ্রামে কোন প্রাথমিক বিদ্যালয় নেই। তবে সরকার এমন গ্রামে স্কুল স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়, যে গ্রামের লোকসংখ্যা কমপক্ষে দুই হাজার ও দুই কিলোমিটারের মধ্যে কোন স্কুল নেই। সেই হিসাবে ১৫০০ গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এসব বিদ্যালয় স্থাপনের কাজ প্রায় শেষ। ইতিমধ্যে ১২০০ বিদ্যালয়ের কাজ শতভাগ এবং ৩০০ স্কুলের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে।

এর আগে ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক স্কুল জাতীয়করণ করা হয়, এটিও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ। বিদ্যালয়হীন ১৫০০ গ্রামে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপনের কাজও প্রায় শেষের দিকে। বেশির ভাগ স্কুলেই  ২০১৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ফলে বিদ্যালয়হীন গ্রামের শিশুরা সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষায়। প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যাদাও বাড়ানো হয়েছে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণিতে উন্নীত করা হয়েছে। সহকারী শিক্ষকদের বেতন স্কেলও এক ধাপ উন্নীত করা হয়েছে। আবার একইসাথে এটিও দেখতে হবে যে, বেসরকারি হিসাবে ৯৭ শতাংশ শিশু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে, সরকার যদিও দাবি করে এই হার শতভাগ। তবে যে শিশুরা ভর্তি হচ্ছে তাদের মধ্যে প্রায় ২১ শতাংশই পঞ্চম শ্রেণি শেষ না করেই ঝরে যায়। সব মিলিয়ে ২৪ শতাংশ শিশু প্রাথমিকের গ-ি পার হতে পারছেনা। এ বিষয়টিতে এখন নজর দিতে হবে।

সেই সাথে শিক্ষার্থীদের যোগ্যতা ও দক্ষতা মূল্যায়নের  ক্ষেত্রে পরিবর্তন নিয়ে আসতে হবে। দুইঘণ্টা বা তিন ঘণ্টার প্রান্তিক পরীক্ষা অনেকটাই লটারির মতো। শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত ‘শিক্ষন দুর্বলতা’ এ ধরনের মূল্যায়নে ঠিকমতো নির্ণয় করা যায় না। কাজেই কোন প্রান্তিক পরীক্ষা শিক্ষার্থীদের শিক্ষার মানোন্নয়নে খুব একটা সহায়ক ভূমিকা রাখে না বরং নিয়মিত শ্রেণিপাঠ এতে বিঘিœত হয়; শিশুরা অপ্রয়োজনীয় চাপে থাকে। সাথে সাথে জ্ঞানার্জনের চেয়ে পাস করানোর চিন্তা, উচ্চগ্রেড পাওয়ার চিন্তা সৃষ্টি হয় আর তার সাথে আসে কোচিং, স্পেশাল ক্লাস , প্রাইভেট পড়া ইত্যাদি।

যে কোন বিষয় যেমন ইতিহাস, ভূগোল, দর্শন, বিজ্ঞান, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন ও গণিতের বাহন হচ্ছে ভাষা। বাংলা ও ইংরেজি- এই দুটো ভাষাই সেখানে জরুরি। যে কোন বিষয়ের ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, বোঝার চেষ্টা বা বোঝানোর চেষ্টা করা সবক্ষেত্রেই আমরা ব্যবহার করছি ভাষা। ভাষা যত প্রাঞ্জল হবে, কোন বিষয় বুঝতে ও বোঝাতে তত সহজ হবে। কাজেই আমাদের শিক্ষার্থীদের এই ভাষাজ্ঞান, ভাষা ব্যবহারের দক্ষতার ওপর প্রথম থেকেই জোর দেয়া উচিত।

এক সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশে ১৫ বছরের ঊর্ধ্বে অর্থনৈতিকভাবে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ছয় কোটি সাত লাখ। তার মধ্যে চার কোটি বেকার। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী সাময়িকী ইকোনমিস্টের ‘ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স’ ইউনিটের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয় বর্তমানে বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশ ¯œাতকই বেকার। একটি সমাজের বড় সম্পদ তার তরুণ সম্প্রদায়। সেই তরুণ সম্প্রদায়ই যদি নিস্ক্রিয় থাকে, তাহলে সমাজের উন্নয়ন কীভাবে সম্ভব হবে, বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে।

জাতিসংঘের ২০৩০ সালের মধ্যে সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলস নামক পরিকল্পনার ১৭টি গোল  বা লক্ষ্য অর্জনের মিছিলে অমরা শরিক হতে পারব কিনা তাও ভেবে দেখতে হবে। আমাদের দেশের বর্তমান প্রজন্মকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে হলে শিক্ষার বিকল্প নেই। টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা। বাংলাদেশে বেকারদের মধ্যে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বেশি কারণ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারা। বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বেসরকারি খাতেই কর্মসংস্থান বেশি সৃষ্টি হওয়ার কথা। বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থানের জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত মানবসম্পদ। মানবসম্পদ সৃষ্টি হয় শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে।

দেশে বর্তমানে ৩১ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। ৩৮টি পাবলিক ও ৯৬টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে দেশে। ৬৩ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশুনা করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আগে একমাত্র ভারতেই ৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার জন্য যেত। ফলে দেশ বিশাল অংশের দেশি মুদ্রা হারাতো। উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতে যাওয়ার সংখ্যা এখন প্রায় শুণ্যের কোঠায়। এখন যেটি প্রয়োজন তা হচ্ছে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানের দিকে জোর দেওয়া যাতে একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার উপযোগী সৎ, যোগ্য ও মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন নাগরিক হিসেবে শিক্ষার্থীরা এসব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেড়িয়ে আসতে পারে। আমরা এই বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে পারলে পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ থেকে আমাদের দেশে উচচশিক্ষা গ্রহণ করতে অনেকেই আসবে।

সরকারকে আর একটি বিষয়ে কঠোর হতে হবে। সেটি হচেছ, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতির নামে যা হচ্ছে তা কঠোর হস্তে দমন করা। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কারা কি করছে তার নিরপেক্ষ হিসাব সরকারকে রাখতে হবে যাতে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও আমরা বিদেশি শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে পারি।

লেখক : শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক।

 

(মতামত লেখকের নিজস্ব)।

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়