ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

প্রাচীনবঙ্গের গর্বিত অধ্যায়: গঙ্গাঋদ্ধি

কে এম আব্দুল মোমিন || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:৪২, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
প্রাচীনবঙ্গের গর্বিত অধ্যায়: গঙ্গাঋদ্ধি

আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট, ছবি: উইকিপিডিয়া

|| কে এম আব্দুল মোমিন ||

১৯৭১ সালে বিপুল রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তদানীন্তন পাকিস্তানের স্বৈর-শাসকের নাগপাশ থেকে বিশ্ব মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশের প্রাগৈতিহাসিক ব্যাপ্তিকাল আজও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। সম্ভব হয়নি মানুষ ও ভাষার কালানুক্রমিক ইতিহাস সংরক্ষণ। এ দেশের প্রকৃতি যেমন মানুষকে অকৃপণ হস্তে দান করেছে অঢেল ঐশ্বর্য, কেড়েও নিয়েছে অনেক নির্দয়ভাবে তাদের প্রিয়-পরিজনসহ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের অসংখ্য মূল্যবান উপাদান।

প্রকৃতির প্রতিনিয়ত ভাঙ্গা-গড়ার খেলায় তাদের জীবনে উত্থান পতন এলেও তারা থেমে থাকেনি। বিভিন্ন যুগে অঞ্চলটি বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে নানা নামে অভিহিত হয়েছে। কখনো বা স্বাধীন সত্তায় আপন মহিমায় তার আলোকিত আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। ভৌগলিক আয়তনের ক্ষেত্রেও ঘটেছে নানা বৈচিত্র্য। কখনো সংকুচিত, কখনো আদিগন্ত প্রসারিত, কখনোবা স্বদেশের সীমানা পেরিয়ে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তৃত হয়েছে।

এ দেশের মানুষ কখনো নির্দিষ্ট ভৌগলিক সীমার মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। আবহমান কাল থেকে তারা জলে-স্থলে দূর্দান্ত সাহসী জাতি হিসেবে অবাধে বিচরণ করেছে। সমুদ্রচারী জাতি হিসেবেও তারা খ্যাতি অর্জন করেছে। পৃথিবীর নানা জাতির নানা সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে তাদের সাংস্কৃতিক লেনদেন হয়েছে। যা কিছু ভালো গ্রহণ করেছে উদারভাবে, যা কিছু খারাপ বর্জন করেছে অবলীলাক্রমে। কিন্তু তারা স্বকীয়তা বিসর্জন দেয়নি কখনো। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে তাদের স্বাধীন সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। স্বাজাত্যবোধ ও স্বদেশপ্রেমে এ দেশের মানুষ সহজাতভাবে উজ্জীবিত। এ দেশের সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যে তার প্রতিফলন ঘটেছে।

বাংলা শব্দটি অস্ট্রিক ‘বঙ্গা’ হতে উদ্ভূত। অস্ট্রিক শব্দের অর্থ পূর্ব। অস্ট্র-এশিয়াটিক অর্থ এশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয়। অস্ট্রিক বা অস্ট্র-এশিয়াটিক বলতে ইউরোপিয় ভাষাবিদগণ দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীন ভাষাগোষ্ঠী বুঝিয়েছে। বঙ্গা অর্থ সূর্যদেবতা। দ্রাবিঢ় পূর্বযুগে এ অঞ্চলের মানুষ সৌর উপাসক ছিল। দ্রাবিঢ় যুগে বং বা বঙ্গরূপে অঞ্চলটি পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে বঙ্গ শব্দ সংস্কৃত ভাষায় অবিকৃতরূপে গৃহীত হয়। প্রায় ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাসদেব রচিত ‘মহাভারত’, পৌরাণিক গ্রন্থ ও হরিবংশ হতে জানা যায়, কিস্কিন্ধা রাজ্যের রাজা বালিতার পাঁচপুত্রের নামানুসারে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুন্ড্র ও সুম্মরাজ্য দান করেন।

অপরদিকে, মুসলিম ঐতিহাসিক গুলাম হোসেন সেলিম মনে করেন, নবী নূহের পুত্র হাম, হামের পুত্র হিন্দ এ অঞ্চলে বং নামে প্রথম জনবসতি গড়ে তোলেন। বাঙ্গালা শব্দটি প্রথম ৮০৫ খ্রিস্টাব্দে নেসারি প্লেটে পাওয়া যায়। এ শিলালিপিতে তৃতীয় রাষ্ট্রকুট গোবিন্দ তদানীন্তন বাঙ্গালার রাজা হিসেবে ধর্ম পালের উল্লেখ করেন।

সম্ভবত, বঙ্গা > বঙ > বঙ্গ > বঙ্গওয়ালা > বাঙ্গালা > বাঙলা > বাংলায় শব্দটি রূপান্তরিত হয়। অপরদিকে, বঙ্গার অধিবাসীগণ বঙ্গাল > বাঙ্গাল > বাঙ্গালি > বাঙালি নামে অভিহিত হয়। তাদের ভাষা বঙ্গ > বাঙ্গালা > বাঙালা > বাংলা নামে পরিচিতি লাভ করে। বঙ্গদেশীয় বা বঙ্গভাষা অর্থে বঙ্গীয় এবং বঙ্গে যা জন্মে অর্থে বঙ্গজ শব্দ ব্যবহৃত হয়।

বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন শাসনামলে বঙ্গের সীমানা নানাভাবে নির্ধারিত হয়। বঙ্গ ছিল প্রাচীন ভারত বর্ষের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত জনপদ। বর্তমান বাংলাদেশ প্রাগৈতিহাসিক যুগ হতে ১৯১১ সাল পর্যন্ত অবিভক্ত বঙ্গের অন্তর্ভূক্ত ছিল। তারপর ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ‘পূর্ববঙ্গ’ নামে অভিহিত হয়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির ফলে পূর্ববঙ্গের নাম পরিবর্তন করে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ রাখা হয়। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর পূর্ব পাকিস্তানের পরিবর্তে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে অঞ্চলটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে।

খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দে ভারত বর্ষের মগধ অঞ্চলে নন্দবংশের রাজত্বকাল (৩৪৫-৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) লিখিত ইতিহাসের প্রথম অধ্যায়। শূদ্র মাতার সন্তান১ মহাপদ্ম নন্দ ৩৪৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মগধের রাজা শিশুনাগকে সিংহাসনচ্যুত করে নন্দ বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। মহাপদ্ম নন্দকে ক্ষত্রীয় নিধনকারী ও পঞ্চলা, কাশি, কলিঙ্গ২, অশ্মক, কুরু, মৈথিলা, সুরসেনা, ভিটিহোত্রসহ অসংখ্য রাজ্যপাট বিনাশকারী হিসেবে পুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি বঙ্গ হতে পাঞ্জাব ও বিন্ধা পর্বতমালা৩ হতে দাক্ষিণাত্য পর্যন্ত বিস্তৃত বিশাল ভূখণ্ড করায়ত্ব করেন।

নন্দ বংশীয় রাজা ধনানন্দের রাজত্বকালে গ্রিক সম্রাট আলেকজান্ডার জেরুজালেম, মিশর, মেসোপটেমিয়া, ব্যাবিলন, পারস্য, আফগানিস্তান ও তাজিকিস্তান জয় করে ভারতবর্ষের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে উপনীত হন। গান্ধার, তক্ষশিলা ও কন্বৌজসহ বিভিন্ন রাজ্য ও গোত্রের শাসনকর্তাগণকে আত্মসমর্পণের জন্য বার্তা প্রেরণ করেন। তাদের অনেকে আলেকজান্ডারের নিকট আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করেন। ৩২৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দের শীতকালে আলেকজান্ডার স্বয়ং তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মধ্য দিয়ে তিনি জয়লাভ করেন। এ যুদ্ধে উভয় পক্ষের বিপুলসংখ্যক সৈনিক হতাহত হয়। আলেকজান্ডার নিজেও আহত হন। বিজিত অঞ্চলে গ্রিক সৈনিকগণ নারকীয় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে মেতে ওঠে।

তারপর আলেকজান্ডার সিন্ধুনদ অতিক্রম করে পুরুর রাজ্য পাঞ্জাব৪ আক্রমণ করেন। মেসিডোনিয় বাহিনী ভয়ঙ্কর প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এ যুদ্ধে পুরুর পৌরুষ, বিক্রম ও সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে তিনি তার সঙ্গে মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাকে সাট্রাপবা স্থানীয় শাসনকর্তারূপে নিয়োগ করেন। হিদাসপিস (ঝিলাম নদী) নদীর তীরে সংঘটিত যুদ্ধে আলেকজান্ডারের প্রিয় অশ্ব বুকিফিলাস নিহত হয়। তার নামানুসারে তিনি নদীটির অপর তীরে ‘বুকিফালা’ নামে একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন। পাঞ্জাবের বর্তমান মং এলাকায় নিসিয়া নামে বিজয়ের স্মৃতি হিসেবে তিনি অপর একটি নগর প্রতিষ্ঠা করেন।

পুরুর রাজ্যের পরবর্তী রাজ্য ছিল মগধের নন্দ সাম্রাজ্য। তার পূর্বদিকে ছিল গঙ্গাঋদ্ধি সাম্রাজ্য। আলেকজান্ডারের সেনাবাহিনী ইতোমধ্যে ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়ে। তদুপরি মগধ ও গঙ্গাঋদ্ধির সমরশক্তি ও যুদ্ধপ্রস্তুতির বিবরণ জেনে তারা রীতিমত আতঙ্কিত হয়। হিপাসিস (বিয়াস) নদীর তীরে তারা বিদ্রোহ ঘোষণা করে এবং পূর্ব দিকে আর কোন রাজ্য আক্রমণে অস্বীকার করে। ফলশ্রুতিতে, এ নদী আলেকজান্ডারের দিগ্বিজয়ের সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দেয়।

প্রখ্যাত গ্রিক সমাজ ও সংস্কৃতিবিদ মেগাস্থিনিস (৩৫০-২৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এশিয়া মাইনর বর্তমান তুরস্কে জন্মগ্রহণ করেন। ১ম সেলুকাস তাকে রাষ্ট্রদূত হিসেবে ভারতের চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজ দরবারে প্রেরণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে পণ্ডিত, গবেষক, ঐতিহাসিক ও পরিব্রাজক। মানবসমাজ ও সংস্কৃতি নিয়ে ভারত, শ্রীলংকা ও হিমালয় সম্পর্কে অনেক তথ্য তিনি লিপিবদ্ধ করেন। ডাইয়োনিসাস ও হারকিউলিসের ভারত ভ্রমণের তথ্য তদানীন্তন গ্রিক পণ্ডিত মহলে ব্যাপক কৌতূহল সৃষ্টি করে। উল্লেখ্য, ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রদূত হিসেবে মেগাস্থিনিস আগমন করেন।

প্রাচীন বাংলার মানচিত্র


প্রাচীন ভারত সম্পর্কে গ্রিক ভাষায় প্রণীত ‘ইন্ডিকা’ গ্রন্থে মেগাস্থিনিস উল্লেখ করেন, ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গঙ্গার সম্পদ বা গঙ্গারাষ্ট্র হিসেবে গঙ্গাঋদ্ধি বা গঙ্গাহৃদয় নামে বঙ্গরাজ্য পরিচিতি লাভ করে। তখন গঙ্গাঋদ্ধির অন্তর্ভূক্ত ছিল বর্তমান বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। রাজধানী ছিল বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়ায়।

বিশ্বখ্যাত ভূগোলবিদ ক্লডিয়াস টলেমি (৯০-১৬৮ খ্রিস্টাব্দ) তার ‘জিওগ্রাফিয়া’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, গঙ্গার পঞ্চমুখ বা সমগ্র বদ্বীপ অঞ্চলে গঙ্গারাষ্ট্রের অবস্থান ছিল। স্ট্রাবো, প্লিনি, আরিয়ন প্রমুখ গ্রিক ঐতিহাসিকগণ গঙ্গাঋদ্ধির অবস্থান সম্পর্কে মেগাস্থিনিসের মতামত প্রাধান্য দিয়েছেন। গ্রিক, ল্যাটিন ও মিশরিয় ঐতিহাসিকগণের মতেও গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলের দক্ষিণ বঙ্গে গঙ্গাঋদ্ধির অবস্থান ছিল।

প্রাচি (মগধ) ও গঙ্গাঋদ্ধির সমরশক্তি ও আলেকজান্ডারের বিরুদ্ধে যুদ্ধপ্রস্তুতির বিবরণ সম্পর্কে জগদ্বিখ্যাত গ্রিক ঐতিহাসিক ও আলেকজান্ডারের জীবনীকার প্লুটার্ক (৪৬-১২০ খ্রিস্টাব্দ) বলেন, পুরুর সঙ্গে যুদ্ধে মেসিডোনিয়া বাহিনীর দিগ্বিজয়ের বাসনা স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং ভারত অভিমুখে বা ভারতের অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে তারা নিরুৎসাহিত বোধ করে। ... গঙ্গা নদী সম্পর্কে তারা শুনেছিল, এর প্রস্থ ৩২ স্টিডিয়া বা প্রায় ৬ কিমি ও গভীরতা ১০০০ ফ্যাদম বা ১৮০ মিটার।  তদুপরি, দূরতিক্রম্য এ নদীর দূরবর্তী উপকণ্ঠে দুর্ভেদ্য সশস্ত্র পদাতিক, অশ্বারোহী ও হস্তীবাহিনী মোতায়েন রয়েছে। আলেকজান্ডারের আক্রমণ আশঙ্কায় গঙ্গাঋদ্ধি ও প্রাচি রাজদ্বয় ৮০০০০ অশ্বারোহী, ২০০০০০ পদাতিক, ৮০০০ যুদ্ধরথ ও ৬০০০ ভয়ঙ্কর হস্তীবাহিনী সুসজ্জিত রেখেছেন।৫

গঙ্গাঋদ্ধি সম্পর্কে মেগাস্থিনিস (৩৫০-২৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) তার ইন্ডিকা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, গঙ্গাঋদ্ধির পূর্বসীমাজুড়ে ৩০ স্টিডিয়া প্রস্থবিশিষ্ট গঙ্গা নদী উত্তর হতে দক্ষিণে গিয়ে আপন জলরাশি উজার করে দিচ্ছে সাগরের বুকে। প্রচণ্ড শক্তিধর ও অসংখ্য বৃহদাকার হস্তী বাহিনী থাকায় কখনো বিদেশি কোন রাজশক্তি এ রাজ্য আক্রমণের চিন্তাও করেনি। কারণ তারা এ রাজ্যের এত বিশালসংখ্যক হস্তীবাহিনীর পরাক্রম সম্পর্কে অবগত ছিল। তাই মেসিডোনিয়ার আলেকজান্ডার সমগ্র এশিয়া জয় করেও গঙ্গাঋদ্ধি আক্রমণ করেননি। সমস্ত সেনাবাহিনী নিকটে এসেও যুদ্ধের জন্য চারহাজার প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত হস্তীবাহিনীর সংবাদ পেয়ে তিনি গঙ্গাঋদ্ধি ও ভারত জয়ের বাসনা ত্যাগ করেন।৬

৬০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে প্রণীত পেরিপ্লাসের বর্ণনা হতে জানা যায়, গঙ্গা নদীর তীরে নদীর নামানুসারে বাণিজ্যনগরী গঙ্গার অবস্থান ছিল। তেজপাতা জাতীয় মশলা, সুগন্ধী ভেষজ দ্রব্য, মুক্তা ও উৎকৃষ্ট শ্রেণির মসলিন কাপড় এ বাণিজ্য নগরী হতে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হতো। গাঙ্গেয় দ্রব্য হিসেবে বিদেশে এগুলোর ব্যাপক চাহিদা ছিল। এ অঞ্চলে সোনার খনি রয়েছে বলে শোনা যায়৭।

গ্রিক উপাখ্যানের সঙ্গে গঙ্গাঋদ্ধির প্রাগৈতিহাসিক যুগও বিজড়িত রয়েছে। বিষয়টি রীতিমতো কৌতূহলের উদ্রেক করে। রোডসের এ্যাপোলনিয়াসের আর্গোনটিকা কাব্যে বর্ণনা করা হয়েছে, গঙ্গাঋদ্ধির দেতিসনামের এক দলপতি তৃতীয় পার্সিসের পক্ষাবলম্বন করে ঈটিসের বিরুদ্ধে কলসির গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

কলসির অবস্থান ছিল বর্তমান জর্জিয়ার অন্তর্ভূক্ত কৃষ্ণসাগরের উপকূলে। ঈটিস সেই বিখ্যাত কলসি রাজ্যের রাজা ছিলেন। তার বিরুদ্ধে জেসন ও আর্গনট বাহিনী গোল্ডেন ফ্লিস উদ্ধার অভিযানে অংশগ্রহণ করেন। তৃতীয় পার্সিস ছিলেন রাজা ঈটিসের ভ্রাতা ও টরিয়ান গোত্রের রাজা। মহাকবি ভার্জিল ২৯ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রচিত জর্জিকস কাব্যে গঙ্গাঋদ্ধির বীর দেতিসের অসীম বীরত্ব ও সাহসিকতা বর্ণনা করেন।

দেতিস ছিলেন পারস্য সম্রাটের দারিউসের অধীনস্থ নৌ-সেনাপতি। গ্রিকদের বিরুদ্ধে পারস্য যুদ্ধে তিনি আর্টাফার্নিস বাহিনীর নেতৃত্ব দেন। আর্টাফার্নিস ছিলেন দারিউসের ভ্রাতা। ৪৯০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দেতিসের দায়িত্ব ছিল নেক্সাস অবরোধ করা ও নির্মমভাবে ইরিত্রিয়া লুণ্ঠন করা। একই বছর তিনি ম্যারাথন যুদ্ধে পারস্যের পক্ষে নেতৃত্ব প্রদান করেন। ইতিহাসের জনক হিরোডটাসের মতে, দেতিস এ যুদ্ধে সাফল্য লাভ করেন৮। প্রথম দারিউসের পক্ষে তিনি আর্টাফার্নিসের পাশাপাশি গ্রিকদের বিরুদ্ধে বিশ্বস্ততার সঙ্গে বীরত্বের পরিচয় দেন। থ্রেসিয় যুদ্ধে আহত হওয়ার কারণে তাকে কিছুদিন বিশ্রাম দেয়া হয়।

ঈর্ষান্বিত হয়ে গ্রিকনাট্যকার এরিস্টোফেনিস তার ‘পিস’ নাটকে দেতিসকে নিয়ে বিদ্রুপ করেছেন৯। অপর দিকে মহাকবি ভার্জিল গঙ্গাঋদ্ধির বীর দেতিসের মহিমা কীর্তন করেছেন।
এ থেকে অনুমিত হয়, গঙ্গাঋদ্ধির মানুষ শুধু ব্যবসা করত না, ক্রেতাদের স্বার্থ রক্ষার্থে (কাস্টমার কেয়ার) জীবনবাজি রেখে যুদ্ধও করত। গ্রিক ও রোমান ঐতিহাসিকগণ গঙ্গাঋদ্ধির উচ্চারণ ও বানান বিভিন্ন স্থানে বিভিন্নভাবে লিখত। গঙ্গাঋদ্ধি, গঙ্গারাষ্ট্র, গঙ্গারিদয়, গঙ্গারিদম, গঙ্গাহৃদ ইত্যাদি নামে উল্লেখ করা হলেও মূল নাম গঙ্গা অবিকৃতভাবে পাওয়া যায়। গঙ্গা তার সমস্ত সম্পদ এ অঞ্চলে উজার করে দিয়ে সাগরের সাথে মিলেছে। অঞ্চলটি যে অঢেল সম্পদে সমৃদ্ধ ছিল তা গ্রিক ও রোমানদের অবিদিত ছিল না। সুতরাং গঙ্গার সম্পদে সমৃদ্ধ বা গঙ্গাঋদ্ধ নামটি অধিকতর গ্রহণযোগ্য। ঋদ্ধ শব্দটির উচ্চারণ ও বানানের বিভিন্নতা অস্তিত্ব প্রকাশের ক্ষেত্রে মুখ্য নয়। গঙ্গাঋদ্ধি নিঃসন্দেহে তদানীন্তন বিশ্বে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছিল।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখাল দাস বন্দোপাধ্যায় বলেন, ‘চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে গঙ্গঋদ্ধি অন্ধ্র রাজ্যের মতো স্বাধীন ছিল এবং গঙ্গাঋদ্ধি কলিঙ্গের সঙ্গে যুক্ত ছিল১০। ড. এন কে সাহুর মতানুসারে উড়িশ্যা ও কর্ণাটকের বিখ্যাত গঙ্গাবংশ গঙ্গাঋদ্ধি হতে আগত ছিল। এ ছাড়াও গঙ্গাঋদ্ধির অনেক মানুষ দক্ষিণ ভারতে বসবাসের জন্য গমন করে। তিনি আরো মনে করেন, গঙ্গাঋদ্ধির মানুষ বঙ্গ হতে কলিঙ্গ ও মাদ্রাজ পর্যন্ত সমগ্র দক্ষিণ ভারতীয় উপকূল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।

চন্দ্রকেতু গড়, দ্বিগঙ্গা ও উয়ারি-বটেশ্বর প্রত্নপীঠসমূহ থেকে সম্প্রতি আবিষ্কৃত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন হতে প্রমাণিত হয় এগুলো তদানীন্তনকালে গঙ্গাঋদ্ধির সমৃদ্ধ বাণিজ্য নগরী ছিল। যে উন্নত মানের মসলিনের কথা বলা হয়েছে তা এ সমস্ত নগরী হতেও রপ্তানি করা হতো। গঙ্গাঋদ্ধির ব্যবসায়ীরা ‘কালতিস’ নামে এক প্রকার স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহার করত। গঙ্গা নামে বিধৃত নগরীর প্রকৃত অবস্থান সনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। হয়ত, সে নগরী গঙ্গা নদীর করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে গেছে। অথবা তা ভবিষ্যতে আবিষ্কৃত হবার সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে তা ছিল এবং বঙ্গদেশ তখন বহির্বিশ্বে গঙ্গাঋদ্ধি নামে পরিচিত ছিল।


1.       Nanda Dynasty – MSN Encarta. Archived from the original on 2009-11-01.
2.       Kalinga (India) formed part of the Nanda Empire but subsequently broke free until it was re-conquered by      AshokaMaurya, c. 260 BCE. (RayChaudhuri& Mukherjee 1996, pp. 204-209, pp. 270-271)
3.       RadhaKumudMookerji, Chandragupta Maurya and His Times, 4th ed. (Delhi: MotilalBanarsidass, 1988 [1966]), 31, 28–33.
4.       Tripathi, Rama Shankar (1999). History of Ancient India. pp. 124–25
5.       The Classical Accounts of India,RC Majumdar p. 198
6.       Megasthenes, Indika. (Diod. II. 35-42. ), Ancient India as Described byMegasthenes and Arrian. Translated and edited by J.W. McCrindle.
7.       The Periplus of the Erythraean Sea (1st century AD). Quoted from The Periplus of the Erythraean Sea, Wilfred H. Schoff, p. 47-8.
8.       Herodotus, Histories,I. 6.119; VI.94.
9.       Aristophanes, "Peace", lines 289-290
10.    RakhaldasBanarjee, "BangalarItihash"v-I, p. 23.


 






রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়