ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ভাস্কর্য সরালে আপনার ‘বাবু’ নামটিও বদলাতে হবে

অজয় দাশগুপ্ত || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১০:৪৭, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ভাস্কর্য সরালে আপনার ‘বাবু’ নামটিও বদলাতে হবে

অজয় দাশগুপ্ত : এতদিন ধরে থাকলেও কোনোদিন কারো মনে হয়নি এটি আপত্তিকর! এখন মনে হচ্ছে, আদালতপ্রাঙ্গণ থেকে আইন ও বিচারের ন্যায্যতার মূর্তিটি সরাতে হবে। কেন? এটি কি আমাদের সমাজ ও নৈতিক মনোভাবের বিরুদ্ধে কিছু? যদি তা হয় তবে এতদিন থাকলো কীভাবে?

বাংলাদেশ এক সব সম্ভবের দেশ, আবার সব অসম্ভবের দেশও বটে। এদেশে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘অপরাজেয় বাংলা’ আমাদের অনন্য এক স্মারক। আছে রায়ের বাজারে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ। সবার ওপর আমাদের একুশের শহীদ মিনার।

আসুন আমরা ঘটনা মিলিয়ে দেখি। আজ যে শহীদ মিনার আমরা দেখছি সেটি কিন্তু পুনঃনির্মাণের পর এভাবে দেখতে পাচ্ছি। পাকিস্তানিরা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এই মিনার। তাতে কি আসলে চেতনা বা দেশের মানুষের মনের পরিবর্তন ঘটেছিল? একটি মিনার বা স্মৃতিসৌধ দেশের ইতিহাস ও গর্বের বা বেদনার প্রতীক। একদিনে তা তৈরি হয় না। সময় তাকে তার জায়গায় নিয়ে আসে। বাংলাদেশ কি একমাত্র মুসলিম দেশ যেখানে এই স্মারকগুলো বা মূর্তি আছে? দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যূষিত দেশ ইন্দোনেশিয়ায় অনেক মূর্তি চোখে পড়বে। তাদের জাতীয় আকাশ পরিবহনের নামও গরুড়। এই পাখিটি রামায়ণের বিখ্যাত এক পাখির নাম। ইন্দোনেশিয়া শুধু নামে নয়, নিজেদের পরিচয়েও সংস্কৃতি বা অতীত বাদ দেয়নি। যে কারণে তাদের সরকার প্রধানের নাম হয় সুকর্ণ সুহার্তো কিংবা মেঘবতী। পরিচয় মানুষের শুধু ধর্মে হয় না। তার নিজস্বতার এক গুরুত্বপূর্ণ দিক সংস্কৃতি, ঐতিহ্য।

বাংলাদেশের মানুষের পরিচয় হিসেবে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ'র একটি অবিস্মরণীয় উক্তি উল্লেখ করবো। তিনি বলেছিলেন: ‘প্রকৃতি মা নিজেই আমাদের চেহারায় পরিচয়ের চি্হ্ন এঁকে দিয়েছেন। সেটি বাঙালির এক আসল ও অকৃত্রিম অবয়ব। সে কারনে আমাদের দেশে ধর্ম ও সংস্কৃতি চলে হাত ধরাধরি করে।’

মধ্যপ্রাচ্যের কতো দেশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে নানা ধরণের ভাস্কর্য। আরবের রমণীরা আনন্দে উলুধ্বনি করেন। পুরুষরা হাত ধরাধরি করে নাচেন। দুনিয়াখ্যাত বেলি ড্যান্স বা নাভি দেখানো অপরূপ নৃত্যশৈলীও সেসব দেশের ঐতিহ্য। কই তারা তো তা বাদ দেয়নি। আমাদের হঠাৎ মতিভ্রমের কারণ আসলে কোথায়?

শাহবাগ আন্দোলনের পর যখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দেশে নতুন স্বপ্ন ও আশা জাগিয়ে দেশকে শুদ্ধ করে তুলছিল, তখন পরাজিত বিএনপি ও তাদের দোসর জামাতীরা থেমে থাকেনি। তারাও সক্রিয় ছিল। সময় সুযোগের জন্য ওৎ পেতে থাকা এদেশের দুশমনেরা পুরনো কায়দায় মাঠে নিয়ে এসেছিল সরলপ্রাণ মাদ্রাসা ছাত্রদের। সে আরেক অভিজ্ঞতা। এই দেশ প্রথমবারের মতো নিজেরা মুখোমুখি হলো নিজেদের। কীভাবে তা দমন হলো, কীভাবে তাদের ঘরে পাঠানো হয়েছিল সেসব আমাদের অজানা নয়। কিন্তু মুশকিল হলো, এরপর বিএনপি-জামাত কোনঠাসা হলেও শুরু হলো হেফাজত পর্ব। এর আগে এই হেফাজতের নাম কখনো শোনা যায়নি। তারা যে এত বড় কোনো শক্তি বা তাদের এত প্রভাব থাকতে পারে সেটা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। তারপরও তারাই চলে এলো দৃশ্যপটে। সে কি ভয়াবহতা! ধীরে ধীরে সরকারের সাথে আপোসের খেলাগুলো দেখছি আমরা। যেখানে তাদের হুংকার সেখানেই ছাড়। যার সবর্শেষ পরিণতি পাঠ্য বইয়ে পরিবর্তন। শিশুদের মনোজাগতিক পরিবর্তনে এর ভূমিকা হবে ভয়াবহ। তা জেনেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক নামে পরিচিত এই সরকারের নিস্পৃহ মনোভাব সত্যি দুঃখজনক।

বাবু নগরী যিনি হেফাজতের নেতা, এখন বায়না ধরেছেন, আদালত প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরানোর। এরা মূর্তির দেবদেবী, লালন-নজরুলের ভাস্কর্যের  তফাৎ বোঝেন না। তাদের এককথা এক গোঁ। বুঝলাম আপনাদের মনে আপনাদের দিলে এখন এটা অপরাধ। বিধর্মীদের প্রতিমূর্তি। তাই যদি সত্য হয়, আপনার নামের সাথে ‘বাবু’ নামটি কেন? সেটাও তো মালাউনের সাথে জড়িত। আপনাদের মতে তা এদেশ ও সংখ্যাগুরু মানুষের সাথে যায় না। এই মালাউন ঘেঁষা নামটি আপনি ব্যবহার করেন কেন? ভাস্কর্য সরানোর আগে নাম থেকে এই ‘বাবু’ শব্দটি বাদ দেবেন আপনি? আপনার বেলায় যদি এটা মানেন দেশের মানুষের অতীত ও ঐতিহ্য মানেন না কেন?

সরকার কঠোর না হলে, মানুষ না জাগলে, একদিন শহীদ মিনারও সরাতে হবে এ দেশে-এটা কি আসলেই অলীক কল্পনা?



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়