ঢাকা     শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

ঐতিহাসিক ভাষণটি নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৭ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ঐতিহাসিক ভাষণটি নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা প্রয়োজন

হাসান মাহামুদ: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কালজয়ী ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে কথা বলছিলাম মুনতাসির মামুন স্যারের সাথে। তিনি বললেন, ‘এই ভাষণটি থিসিস কিংবা গবেষণার সাবজেক্ট হওয়া দরকার ছিল জাতীয়ভাবে’। এরপর ভাবলাম ভাষণটি নিয়ে গবেষণা হওয়া উচিত- এই মর্মে আমাদের কথা বলা প্রয়োজন। কিন্তু একটু খোঁজ করতেই দেখলাম আজ থেকে তিন বছর আগেই ভাষণটি নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে গবেষণার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাও আবার বিদেশের মাটিতে। এটি একদিকে আমাদের গৌরবের, অন্যদিকে কিছুটা লজ্জারও বটে।

আমরা এতো এতো সাধারণ বিষয়ে মনোযোগ দিতে পারি, কিন্তু জাতিগতভাবে আমাদের বিকাশ হলো যে ভাষণের মাধ্যমে, সেই ভাষণটিকে স্মরণ করাও আমরা মৌসুমী বানিয়ে ফেলেছি। শুরু থেকেই আমরা ঐতিহাসিক ভাষণটি নিয়ে কূটনৈতিক তৎপরতা চালাইনি। যে কারণে রোমান নেতা জুলিয়াস সিজারের মৃত্যুর পর মার্ক অ্যান্টনির ভাষণ, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের গেটিসবার্গ ভাষণের চেয়েও ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বেশি গুরুত্ববাহী ও হৃদয়গ্রাহী হওয়া সত্ত্বেও মহাকাব্যিক দ্যোতনায় সেদিন ধ্বনিত হওয়া জাতির মুক্তির সনদটি এখনো আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পায়নি।

আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি, পৃথিবীতে যে ক’টি ভাষণ একটি জাতিকে নাড়া দিয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম আমাদের জাতির জনকের ভাষণ। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, কূটনৈতিক তৎপরতা চালানোর আগে জরুরি হচ্ছে জাতীয় দায়িত্ব পালন করা, সেই দায়িত্বটি আমরা ঠিকমতো পালন করিনি।

ঐতিহাসিক ভাষণটি এখনো ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেমে সংরক্ষণ করা হয়নি। আজ থেকে ৪৬ বছর আগে বাংলাদেশে উন্নত সাউন্ড সিস্টেম ছিল না। তখনকার সাউন্ড সিস্টেমে রেকর্ড করা ভাষণটিই আমরা এখনো শুনছি।  পাড়া-মহল্লায় নীচু মানের মাইকে যখন এই ভাষণটি বাজানো হয়, তখন কর্কর শব্দ হয়। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য লজ্জাকর।

আবার ধরুন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) যে স্থানে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ভাষণটি দিয়েছিলেন, সেই স্থানটিও চিহ্নিত করে আমরা সংরক্ষণ করিনি।  উদ্যানের ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ভাষণ দিয়েছিলেন তা নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানে না। ওই স্থানটিসহ উদ্যানের মোট ৭টি ঐতিহাসিক স্থান চিহ্নিত ও সংরক্ষণ করতে সরকারকে নির্দেশ দিয়েছিলেন উচ্চ আদালত। কিন্তু এসব নির্দেশনা উপেক্ষিত হয়েছে, উপেক্ষিত হয়েছে ৭ মার্চের ভাষণের আবেদনও। যা কখনোই কাম্য নয়।

এবার বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণটি নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন। মাত্র কয়েক মিনিটের সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধুর মাত্র ছয়টি কথায় সেদিন সাত কোটি বাঙালি এক হয়েছিল। প্রথমত, বঙ্গবন্ধু সেদিন দিয়েছিলেন ‘বাংলাদেশ ঘোষণা’। তিনি বলেছিলেন-‘আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট, কাচারি, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে’।

দ্বিতীয়ত, বঙ্গবন্ধু সেদিন ‘সার্বিক প্রস্তুতির নির্দেশ’ দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেলিন- ‘তোমাদের উপর কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং রাস্তাঘাট যা যা আছে সবকিছু, আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দিবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো’।

তৃতীয়ত, ‘সৈন্যদের প্রতি নির্দেশ’ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন-‘তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। ৭ কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না’।

চতুর্থত, ‘জাতির প্রতি নির্দেশ’ দিয়ে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন- ‘শুনেন মনে রাখবেন, শত্রু বাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু, মুসলমান, বাঙালী, নন-বাঙালী যারা আছে তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যাতে বদনাম না হয়’।

পঞ্চমত, ‘যুদ্ধের চূড়ান্ত অঙ্গীকার’ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি বলেছিলেন-‘বাঙালীরা বুঝে সুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তা নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিবো। এদেশের মানুষকে মুক্তি করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ’।

ষষ্ঠত, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ সংগ্রামী এই উচ্চারণের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সেদিন মূলত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ দিয়েছিলেন।

বলছিলাম ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে গবেষণার কথা। ২০১৪ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি লন্ডনভিত্তিক একটি গবেষণা সংস্থা অগ্রনি রিচার্জের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নূরউদ্দিন আহমদ, বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে গবেষণা শুরু করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। যেদিন তিনি পূর্ব লন্ডনে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ গবেষণা কার্যের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিচ্ছিলেন, তখন একটি খুব সুন্দর কথা বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সেই ভাষণের মাধ্যমে বিশ্ব মানচিত্র আজীবনের জন্য বদলে যায়’। কথাটির সত্যতা নিয়ে দ্বিমত করার কোনো অবকাশ নেই। অথচ নূরউদ্দিন আহমদের কথার রেশ ধরেই বলতে হয়- ইংরেজী দৈনিক গার্ডিয়ান বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ১৪টি ভাষণের যে তালিকা করেছে সে তালিকায় বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ সংকলিত করেনি। এটি দুঃখজনক।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ নিয়ে এই নিবন্ধটি লেখার আগে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ভাষণ সর্ম্পকে খোঁজ করছিলাম। দেখলাম ইতিহাসে বিশ্বের মোট ২১৫ জনের ৩৮১টি ভাষণ শ্রেষ্ঠ হিসেবে রেকর্ড রয়েছে। এর মধ্যে ৮০ শতাংশ বক্তাই শেতাঙ্গ এবং ইংরেজী ভাষার। অশেতাঙ্গ এবং ইংরেজী ভিন্ন অন্য ভাষার বক্তৃতা খুবই কম। বিষয়টি কিছুটা রহস্যজনকও বলা যায়।

আবার এটিও সত্য যে, যুগে যুগে এই অঞ্চল অবহেলিত ছিল। তারা আমাদের অর্জনগুলোতে সহজে স্বীকৃতি দিতে নাও পারে। তাই বলে আমাদের বসে থাকা উচিত নয়। আমরা একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি নিতে পেরেছি। আমরা সমন্বিতভাবে প্রচেষ্টা চালালে বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণও ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ভাষণের তালিকায় লিপিবদ্ধ করতে পারবো। এ জন্য আমাদের নিজেদের জাতীয় দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি ঐতিহাসিক এই ভাষণের যোগ্য সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। কেননা এটি স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধতার একটি অংশ।

লেখক: সাংবাদিক

 

 

রাইজিংবিডি/ঢাকা/৭ মার্চ ২০১৭/হাসান/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়