ঢাকা     মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

ধন্য পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান

ড. এম. হাসিবুল আলম প্রধান || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ০৮:২৬, ১৬ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
ধন্য পুরুষ শেখ মুজিবুর রহমান

অলঙ্করণ : অপূর্ব খন্দকার

ড. এম. হাসিবুল আলম প্রধান : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি নাম, একটি ইতিহাস। বাঙালির হাজার বছরের এই শ্রেষ্ঠ সন্তান বাংলার কোমল পলিমাটির বুকে এক ভাগ্যবতী জননীর কোলে জন্মেছিলেন বলে হাজার বছরের পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে বাঙালি দেখেছিল বিজয়ের লাল সূর্য, বাঙালি পেয়েছিল একটি স্বাধীন মানচিত্র, একটি সংবিধান, একটি পতাকা ও একটি জাতীয় সংগীত। বাংলা, বাঙালি, বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম, বাংলাদেশ এই শব্দগুলোর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু নামটি মিশে আছে একাকার হয়ে। বঙ্গবন্ধু যেমন লড়াই সংগ্রাম করে আমাদের বাংলাদেশ দিয়েছেন, বিনিময়ে বাংলার মাটি, মানুষ, বৃক্ষ, নদী ভালোবেসে আপন করে নিয়েছে কালজয়ী এই মহানায়ককে। বঙ্গবন্ধু তাঁর সাহসী নেতৃত্ব, দীর্ঘ ত্যাগ-তিতীক্ষা আর রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার জন্য জনগণকে প্রস্তুত করেছিলেন এবং ১৯৭১ সালে তাঁরই হুঙ্কারে বাঙালি লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে পাকিস্তানি অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর কবল থেকে বাংলাকে মুক্ত করে। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩ বছর বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম আর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষকে মরতে শিখিয়েছিলেন বলেই তাঁর ডাকে ৩০ লাখ বাঙালির বুকের রক্ত আর ২ লাখ মা-বোনের লজ্জার বিনিময়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল। বাংলাদেশের জন্য সংগ্রাম করতে গিয়ে, স্বাধীনতার জন্য জনগণকে প্রস্তুত করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু ৪৮ বার গ্রেফতার হন এবং ১২ বছর কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে কাটান। তাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস জানতে হলে বঙ্গবন্ধুর জীবন, দর্শন ও রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস জানতে হবে।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে শেখ সাহারা খাতুনের কোলে মুজিব চোখ মেলে পৃথিবী দেখেন। পিতা শেখ লুৎফর রহমানের ৬ ছেলেমেয়ের মধ্যে মুজিব তৃতীয়। ১৯৪০ সালে শেখ মুজিব নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে হাতেখড়ি নেন। ১৯৪২ সালে তিনি এন্ট্রান্স (এসএসসি) পাশ করার পর কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে মানবিক বিভাগে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হন। ১৯৪৭ সালে উক্ত কলেজ থেকেই বিএ পাশ করেন। এর আগের বছর তিনি কলেজের ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে দেশ ভাগের পর ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি আইন বিভাগে ভর্তি হন। কিন্তু ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে ঐ বছরের ২৯ মার্চ কর্তৃপক্ষ তাঁকে অযৌক্তিকভাবে জরিমানা করে। তিনি এই অন্যায় সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন, জরিমানা না দেয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাঁকে বহিষ্কার করেন। ছাত্রাবস্থায় মুজিবের সঙ্গে শেখ ফজিলাতুন্নেছার বিয়ে হয়। কিন্তু তাঁর দাম্পত্যজীবন কখনও ছাত্র রাজনীতি এবং পরবর্তীতে জাতীয় রাজনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলে নি। বরং শেখ ফজিলাতুন্নেছা বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত একজন মহীয়সী ও সাহসী নারী হিসেবে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে স্বামীকে অনুপ্রেরণা ও সাহস যুগিয়েছেন। সে কারণেই আজ তিনি আমাদের ‘বঙ্গমাতা’।

১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে এই উপমহাদেশে নতুন দুটি ‘ডোমিনিয়ন’-এর সৃষ্টি হয়। পূর্ব-বাংলা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় পাকিস্তান অংশে যুক্ত হয়ে এখানকার জনগণ নতুনভাবে বাঁচবার স্বপ্ন দেখে। কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই পূর্ব-বাংলার জনগণের স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত হয়। তারা বুঝতে পারে এক ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে আর এক ঔপনিবেশিক শাসনের খপ্পরে পড়েছে তারা। ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন আইন পরিষদে ‘পূর্ব-পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে মেনে নিবে’ বলে ঘোষণা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে শেখ মুজিব এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন। মূলত ১৯৪৮ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষায় পরিণত করার সংগ্রামে নিজেকে সমর্পণ করার মধ্য দিয়ে মুজিব পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হন। যে কারণে ১৯৪৮ সালের পর বাঙালির অধিকার আদায়ের জন্য যতো আন্দোলন হয়েছে তার প্রায় প্রতিটি আন্দোলনে তিনি নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পূর্ব-পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে বন্দি থাকা অবস্থায় দলের যুগ্ম-সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ ঘটনা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনকে এক নতুন অধ্যায়ে শামিল হতে সহায়তা করে।

ভাষা আন্দোলন বেগবান করার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জেলে থাকা অবস্থায় টানা ১৩ দিন অনশন করেন। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহযোদ্ধাদের জেলে অনশন ভাষা আন্দোলনকারীদের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষার দাবীতে আহুত ছাত্র ধর্মঘটকে সফল করতে এবং ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করে। ১৯৫৩ সালে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং ১৯৬৬ সালে দলটির সভাপতি নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত একই পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালের ১০ মার্চ পাকিস্তানি শোষকদের বিরুদ্ধে এবং তাদের দোসর মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বাঙালি জনমতকে সংগঠিত করবার জন্য যুক্তফ্রন্ট গঠন করে নির্বাচন করার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ অবদান রাখেন। ঐ নির্বাচনে ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট পায় ২২৩টি আসন, যার মধ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগের ছিল ১৪৩টি আসন। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা ওয়াহিদুজ্জামানকে ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত করে গোপালগঞ্জ থেকে নির্বাচিত হন। এ বছরের ১৫ মে শেখ মুজিব প্রাদেশিক সরকারের কো-অপারেটিভ মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৫৫ সালে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী মুসলিম লীগকে ঢেলে সাজাবার উদ্যোগে নেন এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ ভাবাপন্ন একটি ধর্মনিরপেক্ষ দলে পরিণত করতে সচেষ্ট হন। এজন্য এ বছর ২১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি প্রত্যাহার করা হয় এবং বঙ্গবন্ধু পুনরায় দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

১৯৫৮ সালে সামরিক জান্তা আইয়ুব খান ক্ষমতায় এলে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপর শুরু হয় নিপীড়ন-নির্যাতন। ১৯৬১ সালে সামরিক শাসন ও আইয়ুববিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে মুজিব গোপন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন। এ সময় তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের লক্ষ্যে কাজ করার জন্য বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের দ্বারা ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে একটি গোপন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৬ সাল বাঙালি ও শেখ মুজিব উভয়ের জন্য একটি ঐতিহাসিক বছর। কারণ এ বছর তিনি পেশ করেন তাঁর ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি, বাঙালির বাঁচার দাবি। তিনি ঘোষণা দিলেন: ‘তোমাদের এই অত্যাচার মানি না আর তোমাদের শোষণ চলবে না, পুর্ব-পাকিস্তানের ন্যায্য হিস্যা দাও।’

৬ দফায় পূর্ব-পাকিস্তানের পূর্ণ সায়ত্ত্বশাসন দাবি করা হলো। অনেকেই একমত ৬ দফা স্বাধীনতার চিন্তা থেকেই রচিত। ৬ দফার সমর্থনে বঙ্গবন্ধু উল্কার মতো ছুটে বেড়ালেন বাংলার প্রতিটি জনপদে। ৬ দফার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দেখে ভীত হয়ে পাকিস্তান সরকার ৬৮ সালের ৩ জানুয়ারি শেখ মুজিবকে ১ নম্বর আসামী করে মোট ৩৫ জন সেনা ও সিএসপি অফিসারের বিরুদ্ধে পাকিস্তান বিছিন্ন করার অভিযোগ এনে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের ও শেখ মুজিবসহ তাঁর সহযোগীদের গ্রেফতার করায় পূর্ব-বাংলার জনগণের উত্তাল আন্দোলন ক্রমান্বয়ে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিতে থাকে। ১৯৬৯-এ আইয়ুববিরোধী আন্দোলন সমগ্র বাংলায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সামরিক জান্তা আইয়ুব খান আন্দোলন দমন করতে হত্যা, নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। ২০ জানুয়ারি ছাত্র নেতা আসাদকে হত্যা করা হয়, ২৪ জানুয়ারি কিশোর মতিউরকে হত্যা করা হয়, ১৮ ফেব্রুয়ারি রাবি শিক্ষক ড. শামসুজ্জোহাকে হত্যা করা হয় এবং হত্যা করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্রের অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে। এতো কিছুর পরও আইয়ুব খান গণঅভ্যুত্থান ঠেকাতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে গণদাবির কাছে নতি স্বীকার করেন এবং ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারসহ শেখ মুজিব ও তাঁর সহযোগীদের মুক্তি দিয়ে ক্ষমতা ত্যাগ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ ছাত্র জনতার সমাবেশে বাঙালির নয়নের মণি মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হয়। ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ‘বঙ্গবন্ধু’ অবিসংবাদিত একক জাতীয়তাবাদী নেতায় পরিণত হন।

আইয়ুব খানের বিদায়ের পর ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা দখল করে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দেন। নির্বাচনে পূর্ব-বাংলার জনগণ বিপুলভাবে ৬ দফার পক্ষে রায় দিলে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ২৯৮টি আসন পায় আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে জাতীয় পরিষদে ভুট্টোর দল পিপলস পার্টি পায় ৮৩টি আসন। বাংলার জনগণ মনে করলো দীর্ঘ ২৩ বছর পর এবার বুঝি আওয়ামী লীগের কাছে কেন্দ্র ক্ষমতা হস্তান্তর করে বাঙালির ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দেওয়া হবে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরের নামে টাল-বহানা চালাতে থাকলো। ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় সংসদের অধিবেশন আহবান করেও সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধুর সাথে কোনোরকম আলোচনা না করেই ভুট্টোর পরামর্শে ১ মার্চ হঠাৎ করেই ইয়াহিয়া খান অধিবেশন স্থগিত করার ঘোষণা দেন। ইয়াহিয়ার এই ঘোষণায় সমগ্র বাংলা ফুঁসে উঠলো। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বে-ইনসাফী মানবো না, বাঙালিরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচতে চায়।’ বঙ্গবন্ধু পূর্ব-পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন এবং পরিচালিত হতে থাকলো বঙ্গবন্ধুর সফল কৌশলের সর্বোত্তম কীর্তি।

বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে গাড়ির চাকা ঘুরলো না, ব্যাংক-বীমা খুললো না, সারাদেশে পাকিস্তানি কারফিউ উপেক্ষা করে মিছিল সমাবেশ চলতেই থাকলো। বাঙালি মরণপণ করলো-রক্ত চাও, রক্ত নাও কিন্তু স্বাধীনতা দিতেই হবে। অবশেষে ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে প্রায় ১০ লাখ জনতার সমুদ্রে ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গেয়ে উঠলেন স্বাধীনতার অমর গান ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেদিন রেসকোর্স ময়দানে লক্ষ লক্ষ জনতার সামনে বঙ্গবন্ধুর তেজোদীপ্ত ভাষণ বাঙালির বুকে আগুন জ্বেলে দিয়েছিল। সে এক অবিস্মরণীয় দিন। ভাষণটি বিশ্বের অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ ভাষণ। আব্রাহাম লিংকন গেটিসবার্গে যে ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়েছিলেন তা হোয়াইট হাউস থেকে লিখে আনা হয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিব তাৎক্ষণিকভাবে ভাষণ দিয়ে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়তে জাতিকে উদ্ধুদ্ধ করেছিলেন। মূলত বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের পর পরই শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতার জন্য খণ্ড খণ্ড যুদ্ধ। বাঙালি যার যা আছে তাই নিয়ে বাংলার সর্বত্র প্রতিরোধ গড়ে তুললো, আর পশ্চিমারা শুরু করলো হত্যালীলা। অবশেষে ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পৃথিবীর সকল মানবতা পদদলিত করে নিরীহ ঘুমন্ত বাঙালির উপর পাকিস্তানিরা চালাল পৃথিবীর সবচেয়ে বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড।

২৫ মার্চ মধ্যরাতে গণহত্যার সময় এবং পাকিস্তানি আর্মিদের হাতে গ্রেফতার হবার পূর্বমুহূর্তে অর্থাৎ ২৬ মার্চ প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেন, যা ওয়্যারলেস বার্তার মাধ্যমে চট্টগ্রামে দলীয় নেতা জহুর হোসেন চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগ-এর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে পৌঁছে যায়। ২৬ মার্চ প্রথম এই ঘোষণাটি চট্টগ্রাম থেকে রেডিওতে প্রচারিত হয় আওয়ামী লীগ নেতা হান্নানের মাধ্যমে এবং ২৬ মার্চ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাঙালি শুরু করে মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে থাকলেও তিনিই ছিলেন বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের মূল প্রেরণা। এ কারণেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতা হিসেবে শেখ মুজিব সম্পর্কে ‘নিউজ উইক’-এর এক প্রতিবেদনে বলা তাঁকে ‘রাজনীতির কবি’ বলা হয়। দীর্ঘ নয় মাসের মরণপণ সংগ্রাম, ত্রিশ লাখ বাঙালির তাজা রক্ত আর দুই লাখ মা-বোনের লজ্জার বিনিময়ে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলার আকাশে উদিত হলো স্বাধীনতার রক্তিম সূর্য, আমরা পেলাম বাংলাদেশ, পেলাম একটি স্বাধীন দেশের পতাকা আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাঙালি জাতির পিতা।

বিজয়ের পর পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডন থেকে বৃটিশ এয়ারযোগে ১০ জানুয়ারি স্বাধীন বাংলায় পা রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীনতার পরে একটি যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশকে ধ্বংসাবশেষের ভেতর থেকে গড়ে তুলবার দৃঢ় প্রত্যয়ে সকলে যখন বঙ্গবন্ধুর অবিচল নেতৃত্বে নিরলসভাবে কাজ করছিল তখনও স্বাধীনতাবিরোধীরা বসে ছিল না। এই পরাজিত শক্তি অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হতে থাকে। তারা বাংলাদেশবিরোধী আন্তর্জাতিক শক্তির সমর্থনে  বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য নানা রকম ষড়যন্ত্রের জাল বোনে। তারই ফলশ্রুতিতে বাঙালি জাতির জীবনে নেমে এলো সেই অভিশপ্ত রাত ১৫ আগস্ট। সেই থেকে দিনটি আমাদের শোকের দিন, অশ্রু বিসর্জনের দিন। ঘাতকেরা সেদিন এতটাই নির্মম ছিল যে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশু কেউ রক্ষা পায় নি তাদের হাত থেকে। জাতির জনককে হত্যা করার পর এদেশে খন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বে সামরিক জান্তাদের শাসন শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যার বিচার না করে বরং খুনীদের আইন করে রক্ষা করা হয় এবং নানাভাবে পুরস্কৃত করা হতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের রক্ষা করার জন্য মোশতাক কর্তৃক জারিকৃত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশটি ১৯৭৮ সালে জিয়াউর রহমান সংবিধানের চতুর্থ তফসিলে এক অনুচ্ছেদ সংযোজনের মাধ্যমে আইন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেন। পৃথিবীর কোনো সভ্য গণতান্ত্রিক দেশে আইন করে খুনীদের রক্ষা করার এমন দ্বিতীয় কোনো নজির নেই। শুধু তাই নয়, এই খুনি চক্রকে জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে ক্ষমতায় থাকাকালীন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বানিয়ে পুরস্কৃত করেন। ১৫ আগস্ট ট্রাজেডি রচনা করার পর বাংলাদেশ ও বাঙালির মূল্যবোধ একে একে ধ্বংস করে দেশটিকে একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্র রচনা করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ভুলণ্ঠিত করাসহ জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়েছিল, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন থেকে বঙ্গবন্ধুকে নির্বাসিত করা হয়েছিল। শুধ কি তাই? বিএনপি’র পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনীতিতে ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে ধর্ম ব্যবসায়ীরা মৌলবাদী রাজনীতির শিকড় এতোটা শক্তিশালী করেছিল যে, যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতেও আমরা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা দেখেছি। 

বঙ্গবন্ধু আমাদের বাংলাদেশ দিয়েছেন, একটি সংবিধান দিয়েছেন, আমাদের হৃদয়ে বুনে দিয়েছেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রসুধা। যাঁরা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ এ গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছে, যাঁরা ‘শোন একটি মুজিবরের কণ্ঠ থেকে লক্ষ মুজিবরের ধ্বনি প্রতিধ্বনি আকাশে ওঠে রণি’ এই গান গেয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বুকে লালন করছে, মুজিবের কথা মনে হলে যাঁদের দুচোখ ছাপিয়ে জল আসে, মুজিবের জন্য পল্লীর নিভৃতে যে দুঃখিনী মা এখনও রোজা রেখে চোখের জলে বুক ভাসায়, তাদের হৃদয় থেকে এই মহানায়কের নাম মুছে ফেলার সাধ্য কার? বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি শ্লোগান প্রায়ই উচ্চারিত হয়-এক মুজিব লোকান্তরে, লক্ষ মুজিব ঘরে ঘরে। এই শ্লোগানটির মধ্যে শ্বাশ্বত-সত্য লুকিয়ে রয়েছে। বাংলার ঘরে ঘরে আজও এতো মুজিব ভক্ত দেখে মনে হয় তিনি যেন আমাদের মাঝেই বেঁচে আছেন। ঘাতকেরা ভেবেছিল তাঁকে কবরের মাটির তলায় চাপা দিলেই তিনি মুছে যাবেন, শেষ হয়ে যাবেন, কিন্তু বাস্তব সত্য হচ্ছে জাতির জনককে মাটির তলায় চাপা দিয়ে রাখা যায় নি। তিনি কবর থেকে স্বমহিমায় সগৌরবে উঠে এসেছেন এবং মিশে আছেন বাংলার ফসলের আভায়, কৃষকের হাসিতে, শ্রমিকের ঘামে, নদীর ঢেউয়ে, শিশির ভেজা সবুজ দুর্বা ঘাসে, মাঝির ভাটিয়ালী গানে, তরুণ যুবার স্পন্দিত বুকে, কবিতার পঙ্‌ক্তিমালায় আর সাহসী মানুষের মিছিলে। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন এই ধন্য পুরুষ চির অমর হয়ে থাকবেন বাঙালির চেতনায়। কবি শামসুর রাহমানের কবিতার ভাষায়:

‘ধন্য সেই পুরুষ

যাঁর নামের উপর রৌদ্র ঝরে চিরকাল

গান হয়ে নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা

যাঁর নামের উপর কখনও ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া

ধন্য সেই পুরুষ

যাঁর নামের উপর পাখা মেলে দেয় জোছনার সারস।’
 

 

 

লেখক: প্রফেসর, আইন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়





রাইজিংবিডি/ঢাকা/১৬ মার্চ ২০১৭/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়