ঢাকা     শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতনে প্রথম একুশে উদ্‌যাপন

হাসান মাহামুদ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১১:০৩, ২১ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতনে প্রথম একুশে উদ্‌যাপন

হাসান মাহামুদ : পৃথিবীতে মুখের ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে এমন জাতির সংখ্যা খুব বেশি নয়। এদিক থেকে বিশ্বে আমাদের আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের কাহিনী অনেকের কাছেই উদাহরণ। আমাদের ভাষা সৈনিকরা রাজপথ রাঙিয়েছেন রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করতে। এমনকি মুখের ভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত বিসর্জন দিয়েছে এমন নজিরও বোধহয় আর নেই।

একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি ইতিহাসের গৌরবোজ্জ্বল একটি দিন। বাঙালির ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ এবং অহঙ্কারের স্মৃতিবিজড়িত দিন। বর্তমানে আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস আন্তর্জাতিক পরিধিতে পা রেখেছে। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ এখন জাতীয় শহীদ দিবসের পাশাপাশি ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে সুপরিচিত। পৃথিবীর সকল দেশে আমাদের ভাষা দিবস একযোগে উদযাপিত হয়। কিন্তু একটি চমৎকৃত তথ্য হচ্ছে, ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকীতেই অর্থাৎ ১৯৫৩ সালে বাংলাদেশের বাইরে একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্‌যাপিত হয়েছিল। তাও আবার পশ্চিমবঙ্গের শান্তিনিকেতনে। ১৯৫৩ সালের বসন্তের সেই দিনে শান্তিনিকেতনে সাহিত্যমেলার আয়োজন করা হয়েছিল। এই সাহিত্যমেলার মূল কারিগর ছিলেন বাঙালি লেখক ও ছড়াকার অন্নদাশঙ্কর রায়। উনিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁ ঐতিহ্যের শেষ বুদ্ধিজীবী হিসেবে যাঁর নাম উচ্চারণ করা হয়। ১৯০৪ সালের ১৫ মার্চ ভারতের উড়িষ্যায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন।

পূর্ব পাকিস্তান তথা আমাদের অঞ্চলে বসবাস না করলেও ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য বাঙালির আত্মদান তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। পরের বছর আমাদের ভাষা আন্দোলনকে উপলক্ষ্য করে সেই ঐতিহাসিক সাহিত্য মেলার আয়োজন করেন তিনি। তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) থেকে ওই সাহিত্য মেলায় যোগ দেন কাজী মোতাহার হোসেন, মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন, শামসুর রাহমান, কায়সুল হকসহ আরো অনেকে। কিন্তু বিষয়টি তখন আয়োজকরা খুব বেশি প্রচার করেননি। এ কারণে বিষয়টি ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তেমনভাবে উঠে আসেনি।

ইতিহাসবিদদের মতে, ইতিহাসে পরিণত হওয়া যে কোনো ঘটনার প্রকৃতচিত্র অর্ধশতাব্দি বা পঞ্চাশ বছর পর পুনরায় লেখা হয়ে থাকে। কিন্তু আমাদের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কখনোই বিকৃত হয়নি। যেমনটি বিভিন্ন সময়ে কথা উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে। কিন্তু কিছু বিষয় এখনো অনেকটা অপ্রকাশিত রয়ে গেছে। এর মধ্যে অন্নদাশঙ্কর রায়ের এই অবদানটিও রয়েছে।

বাংলা ভাষার জন্য ভালোবাসার অংশ হিসেবে শান্তিনিকেতনের ওই সাহিত্য মেলা আয়োজন করে অন্নদাশঙ্কর রায় বাঙালি ইতিহাসে এক অনণ্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়ে আছেন। সেই সাহিত্যমেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন অন্নদাশঙ্কর রায়। তিনি তখন শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা। বিশ্বভারতীর দুই শিক্ষার্থী— নিমাই চট্টোপাধ্যায় আর গৌরী দত্ত ওই সাহিত্য মেলা আয়োজনে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, গৌরী দত্ত পরবর্তীকালে আবু সয়ীদ আইয়ুবের সহধর্মিণী হন। সে সুবাদে পরবর্তীকালে তিনি গৌরী আইয়ুব নামে পরিচিত হয়েছিলেন।

১৯৯৯ সালের ১৫ মার্চ বোলপুর থেকে প্রকাশিত ‘পাক্ষিক ১৪০০’ সাহিত্য পত্রিকার ২১ ফেব্রুয়ারি বিশেষ সংখ্যা’য় (বৈশাখ ১৪০৬) নিমাই চট্টোপাধ্যায়ের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়। সেখানে তিনি এই সাহিত্য মেলা আয়োজন নিয়ে কথা বলেছিলেন।

‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস আজ দুনিয়ার কোনো বাঙালির কাছেই অজানা নেই। ১৯৫২- একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্যে যাঁরা প্রাণ দিয়েছিলেন তাঁদের আমরা প্রতি বছরই ওই তারিখে শ্রদ্ধা, কৃতজ্ঞতা ভালবাসার সঙ্গে স্মরণ করি। কিন্তু যে-কথাটা আজ প্রায় কেউই মনে রাখেনি সেটা হল কি পরের বছর ১৯৫৩- একুশে ফেব্রুয়ারি সেই ঘটনার প্রথম স্মরণ বার্ষিকী অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই শান্তিনিকেতনে; এমনকি শান্তিনিকেতনের বর্তমান কর্তৃপক্ষও সে-কথা জানেন না।

১৯৫৩- একুশে ফেব্রুয়ারি অন্নদাশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে গৌরী দত্ত আমি শান্তিকিকেতনে যে সাহিত্যমেলার আয়োজন করি সেটাই ছিল বিভাগোত্তর দুই বাংলার সাহিত্যিক সমাজের সর্বপ্রথম মিলনোৎসব; সেই অনুষ্ঠানেই, শান্তিনিকেতনের সংগীতভবন মঞ্চে দাঁড়িয়ে কাজী মোতাহার হোসেন প্রথম বলেছিলেন : ‘আমাদের মুখের ভাষা যদি ওরা কেড়ে নেয় আমরা তাহলে পাকিস্তান ছেড়ে দিতেও কুণ্ঠা বোধ করব না।তার বেশ কয়েক বছর পরে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়, এবং একুশে ফেব্রুয়ারি অনিবার্যভাবেই বাংলাদেশের বর্ষপঞ্জির একটি অচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠে। কিন্তু দুনিয়ার প্রথম একুশে ফেব্রুয়ারি কবে কোথায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল সে প্রশ্নের উত্তর আপনারা কোনো ইতিহাসগ্রন্থেই পাবেন না।

এর একটা কারণ হল: সাহিত্যমেলার ওই তারিখটির তাৎপর্য গৌরী আমি কাউকেই বলিনি, কারণ আমাদের -আশঙ্কা অমূলক ছিল না যে একুশে ফেব্রুয়ারির স্মৃতিবার্ষিকী বললে পূর্ব পাকিস্তান-কর্তৃপক্ষ কখনোই ওই দেশের পাঁচজন প্রসিদ্ধ লেখককে শান্তিনিকেতনে তখন আসতে দিতেন না।’’

 

১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কো বাংলাদেশের বাঙালি জনগোষ্ঠীর ভাষার জন্য আত্মত্যাগকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে এবং প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০০ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি এ বিশেষ দিবসটিকে বিশ্বের ১৮৮টি দেশ প্রথমবারের মতো ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে পালন করে।

ইউনেস্কোর পর জাতিসংঘও একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০০৮ সালের ৫ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে এ স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পররাষ্ট্র দপ্তর ‘শান্তির জন্য সংস্কৃতি’ শীর্ষক একটি রেজ্যুলেশন জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে তুলে ধরে। ভারত, জাপান, সৌদি আরব, কাতারসহ বিশ্বের ১২৪টি দেশ এতে সমর্থন করে। এরপর ২০০৯ সালের ২৮ মে কানাডার অন্টারিও প্রদেশের প্রাদেশিক আইন পরিষদে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। বাংলাদেশের বাইরে এটাই কোনো দেশের প্রাদেশিক কিংবা কেন্দ্রীয় পার্লামেন্টে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের প্রথম স্বীকৃতি।

বর্তমান যুগকে বলা হয় তথ্যপ্রযুক্তির যুগ। এই তথ্যপ্রযুক্তিতেও সম্পৃক্ত হয়েছে আমাদের বাংলা ভাষা। এরই  মধ্যে বাংলা ভাষা ও বাংলা ভাষার সৃষ্টিসম্ভারকে ইন্টারনেটে বিশ্বের সব ভাষার মানুষের কাছে পাঠযোগ্য করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ উদ্যোগ সফল হলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের মানুষ তাদের নিজ নিজ ভাষায় বাংলা ভাষার সৃষ্টিসম্ভার যেমন পাঠ করতে পারবে, তেমনি অন্যান্য ভাষার সৃষ্টিসম্ভারও বাংলা ভাষায়ই পাঠ করা সম্ভব হবে। বাংলাকে ‘ইউনিভার্সাল নেটওয়ার্কিং ল্যাঙ্গুয়েজে’ (ইউএনএল) পরিণত করার কাজ শুরু করেছে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ।

একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের বেদনার কমলপদ্ম, চেতনার অগ্নিমশাল, পরাধীনতার শেকল ভাঙার প্রথম প্রতিবাদ। তবে একুশে ফেব্রুয়ারি এখন শুধুই বাঙালির নয়- বিশ্বের সব দেশের, সব মানুষের। অমর একুশে এখন বিশ্বের সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর ভাষা ও সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার প্রচেষ্টার এক অনিঃশেষ অনুপ্রেরণার উৎস। যেহেতু বাংলা এখন আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে পৌঁছেছে, সেক্ষেত্রে জাতীয় এখন আমাদের উদ্যোগ নেওয়া উচিত আন্তর্জাতিক অঙ্গণে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন অনুষঙ্গ খুঁজে বের করা এবং পৃষ্টপোষকতা করা।

লেখক : সাংবাদিক



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২১ মার্চ ২০১৭/হাসান/তারা

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়