ঢাকা     শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

একজন ট্রেন যাত্রী, ঢাকার বস্তি আর স্কুল ড্রেসহীন ছেলেটি

সাইফ বরকতুল্লাহ || রাইজিংবিডি.কম

প্রকাশিত: ১৩:৩৮, ২৮ মার্চ ২০১৭   আপডেট: ০৫:২২, ৩১ আগস্ট ২০২০
একজন ট্রেন যাত্রী, ঢাকার বস্তি আর স্কুল ড্রেসহীন ছেলেটি

সাইফ বরকতুল্লাহ : গফুরগাঁও রেল স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি। সকাল ৯টায় ট্রেন আসবে বলে আটটার মধ্যেই আমি স্টেশনে উপস্থিত হই।

প্রচণ্ড শীত উপেক্ষা করে মোটরসাইকেলে ভাড়ায় স্টেশনে পৌঁছেই প্রথমে টিকিট কাউন্টারে যাই। ভিড় নেই। চার-পাঁচ জনের লাইন। টিকিট কাউন্টারে দাঁড়িয়ে টিকিট নেয়ার জন্য ম্যানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে বুকিং কর্মীকে বললাম, অনুগ্রহ করে একটি সিট দেবেন।

জবাবে তিনি বললেন, সিট নেই। শুধু আসনবিহীন টিকিট।

আসন ছাড়াই (এক্সট্রা) টিকিট কেটে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখি কাউন্টারের কাছেই আসন নম্বরসহ টিকিট বিক্রি হচ্ছে, কালোবাজারে। একটু অবাকই হলাম। স্টেশনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও আছেন, রেলকর্মী ও কর্মকর্তারাও আছেন। কিন্তু এর মধ্যেই টিকিট কালোবাজারীরা একেবারে কাউন্টারের কাছেই প্রকাশ্যে টিকিট বিক্রি করছেন।

কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই এ অবস্থা কেন? উত্তরে সবার একটাই কথা, প্রত্যেক জায়গায় ঢুকে গেছে দুর্নীতি। অথচ আমরাই প্রতিদিন স্মরণ করি- দুর্নীতি রুখব-সমাজটাকে গড়ব। কী বিচিত্র!

এদিকে আটটা অতিক্রম করে নয়টা পার হয়ে গেছে। ট্রেনের খবর নাই। অবশেষে সাড়ে নয়টার দিকে ট্রেন এলো। গফরগাঁও স্টেশন পার হয়ে শ্রীপুর অতিক্রম করতেই পাশের সিটে দেখলাম রাজনীতির নানা প্রসঙ্গ নিয়ে কথাবার্তা। এতে শোনা যাচ্ছিলো সমাজ ও জীবনের নানা প্রসঙ্গও। পঞ্চাশের একটু বেশি বয়সি একজন, মুখে দাঁড়ি, মেহেদি রঙ করা। তিনি বলছেন, রাজনীতি এখন হয়ে গেছে অত্যন্ত কঠিন। গ্রামে একজন রিকশাচালকও রাজনীতির প্যাচমোচড় বোঝেন। শুধু তাই নয়, একই পরিবারের ছেলে-মেয়ে ভিন্ন মতাদর্শী। আরেকজন বলছেন, এর কারণও আছে। রাজনীতিতে এখন আর আদর্শ নেই। সুবিধাবাদীদের জয়জয়কার। আরেকজন যাত্রী বললেন, গ্রামে আগে দেখা যেত, একটা বাড়িতে মুরব্বিরা বলে দিতেন, ওমুককে ভোট দিতে হবে, দেখা যেত ভোটে ঔ বাড়ির সবাই তাকেই ভোট দিতেন। আর এখন তেমন অবস্থা নেই। ছেলে কাকে ভোট দেবেন বাবা জানেন না। মা কাকে ভোট দেবেন মেয়ে জানেন না। আবার কোথাও দেখা যায়, বাবা-ছেলে ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বী। সত্যিই বিচিত্র এই সময়!

দুই.
একটি উদ্বেগজনক খবরে মনটা বিষণ্ন হয়ে গেল। আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু অনিশ্চয়তায় বিবর্ণ ঢাকার বস্তিবাসী শিশুর শৈশব। ৭ ডিসেম্বর লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক উন্নয়ন ও মানবকল্যাণ বিষয়ক গবেষণা সংস্থা ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (ওডিআই) নতুন একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ঐ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকায় বস্তিবাসী শিশুশ্রমিকরা সপ্তাহে গড়ে ৬৪ ঘণ্টা কাজ করে। তাদের বেশির ভাগই চাকরি করে পোশাক কারখানায়, যেখানে বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ডগুলোর পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরি করা হয়।

রাজধানী ঢাকার বস্তিবাসী শিশুদের মধ্যে ১৫ শতাংশই স্কুলে যায় না। তাদের বয়স ছয় থেকে ১৫ বছর এবং তারা কারখানাগুলোতে পূর্ণকালীন (ফুলটাইম) চাকরি করে।‘শিশুশ্রম ও শিক্ষা : ঢাকার বস্তিবাস জরিপ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, বস্তি এলাকার দুই-তৃতীয়াংশ কিশোরী দেশটির দ্রুত বিকাশমান পোশাক কারখানাগুলোতে পূর্ণকালীন কাজ করে। জরিপের এই ফল বাংলাদেশের তিন হাজার কোটি ডলারের পোশাক তৈরি শিল্পের জন্য উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। অথচ ভয়ংকর নিরাপত্তা সংক্রান্ত রেকর্ডের পরও বিশ্বের বৃহত্তম পোশাক শিল্পসমৃদ্ধ দেশগুলোর একটি হলো বাংলাদেশ। বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, এ বিষয়ে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ বা দেশটির প্রভাবশালী পোশাক উৎদনকারীদের তরফ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে শ্রমিক নেতারা বলেন, কারখানাগুলোতে শিশুশ্রম দিন দিন বাড়ছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, এটা হচ্ছে বাংলাদেশে শিশুশ্রম ও শিক্ষা নিয়ে সর্ববৃহৎ গবেষণাগুলোর একটি। এতে দেখা গেছে, ঢাকার বস্তিগুলোর ১৪ বছর বয়সী শিশুদের অর্ধেকই শিশুশ্রমে নিয়োজিত। এর মধ্য দিয়ে এই শিশুরা চরম গ্লানিকর অভিজ্ঞতা অর্জন করে।

তাই বলব, আমাদের এখনই ভাবতে হবে এসব শিশুকে নিয়ে। তাদের পড়ালেখা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়াটা জরুরি।  কেননা, শিশুদের আদর্শ মানুষ করে গড়ে তুলতে না পারলে আদর্শ সমাজ বিনির্মাণ সম্ভব নয়।

তিন.
কয়েকদিন আগে খবরের কাগজে দেখলাম, যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার একটি স্কুল পরিদর্শনে গিয়েছিলেন জেলা প্রশাসক হুমায়ুন কবীর। সেই পরিদর্শনে গিয়ে তিনি ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। যে অভিজ্ঞতা বদলে দিয়েছে তার চিন্তাচেতনা।

ঘটনাটা এরকম- স্কুল পরিদর্শনে গিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছবি তুলতে চাইলেন। ছবি তোলার একপর্যায়ে তিনি দেখেলন, চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্র ছবি তুলতে আসছে না। দূর থেকে সে ছবি তোলার দৃশ্য দেখছিল।

এ সময় জেলা প্রশাসক ওই ছাত্রের কাছে গিয়ে বলেন, তুমিও এসো, আমরা একসঙ্গে ছবি তুলি। জবাবে সে বলে, আমার তো স্কুল ড্রেস নেই।

ছেলেটির কথায় জেলা প্রশাসকের মনটা বিষণ্ণ হয়ে যায়। আর এতেই ঘটে যায় জেলা প্রশাসকের হৃদয়ে তোলপাড়।

হুমায়ুন কবীর জানান, তিনি স্কুল পরিদর্শন শেষে কার্যালয়ে ফিরে সব ইউএনওকে বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোয় স্কুল ড্রেস নেই- এমন শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করতে। পাশাপাশি তিনি যশোরের দানশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে থাকেন। এ কাজ করতে গিয়ে অল্প দিনে ব্যাপক সাড়া পাওয়া যায়। তালিকা তৈরির পর ছয় মাসে জেলার ১৫৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে দুই হাজার সেট স্কুল ড্রেস বিতরণ করা হয়।

শুধু তাই নয়, তিনি আরো ভালো কাজ করছেন। উন্নত দেশগুলোর অনুকরণে বাংলাদেশে প্রথম যশোরের তিনটি স্কুলে ‘স্টুডেন্ট অব দ্য মান্থ’ ও ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচনের প্রথাও চালু করেছেন। যশোরে তিন স্কুলের ‘স্টুডেন্ট অব দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত ১৮ জন শিক্ষার্থী এবং সংশ্লিষ্ট স্কুলগুলোর ছয়জন শিক্ষককে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত খরচে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এ ছাড়া যশোর জেলার তিনটি স্কুলে অনলাইন স্কুল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করেছেন।

এরপর মন্ত্রণালয় থেকে দেশের সব জেলা প্রশাসককে চিঠি পাঠিয়ে এ বিষয়ে যশোরের জেলা প্রশাসকের উদ্যোগকে অনুসরণ করতে বলা হয়।

হুমায়ুন কবীর গণমাধ্যমকে জানান, অনেক জেলা প্রশাসক অনলাইন স্কুল ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু করতে যশোরে যোগাযোগ করেছেন। তাদের সব রকম সহযোগিতা করা হয়েছে এবং সফটওয়্যারও দেয়া হয়েছে।

ধন্যবাদ হুমায়ুন কবীর আপনাকে। আপনার আলোয় আলোকিত হোক দেশ। স্যালুট আপনাকে।

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।



রাইজিংবিডি/ঢাকা/২৮ মার্চ ২০১৭/সাইফ/শাহনেওয়াজ

রাইজিংবিডি.কম

আরো পড়ুন  



সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়